|
|
|
|
ওগো বিষ্ণুপ্রিয়া |
শান্তিপুর ডুবুডুবু... নদিয়া কণিকামাত্র, কৃষ্ণপ্রেমে জগৎ ভাসিয়েছিলেন নিমাই সন্ন্যাসী।
কিন্তু তাঁর ঘরের মানুষটি? প্রেম না পেয়ে যাঁকে ভক্তিমার্গেই সহধর্মিণী হতে হল?
সেই নারীর কথা লিখছেন তিলোত্তমা মজুমদার |
খুব ছোটবেলায় একটি যাত্রা দেখেছিলাম, ‘ওগো বিষ্ণুপ্রিয়া’। কোন কোম্পানির মঞ্চায়ন এবং কলাকুশলী কারা, সে আর এখন মনে পড়ে না। কিন্তু, হিটলার থেকে ফুলনদেবী পর্যন্ত যতেক বিষয়ের প্রাথমিক জ্ঞানোন্মেষ যেমন যাত্রা থেকেই আমার হয়, তেমনি বিষ্ণুপ্রিয়া সম্পর্কেও।
সেই যাত্রা দেখতে বসে ভারী চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। নিমাই সন্ন্যাস গ্রহণের সঙ্কল্প নিয়েছেন, নিমাইয়ের স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া কেঁদে কেঁদে বলছেন, ওগো এ ভাবে আমাকে ছেড়ে যেও না... ইত্যাদি। আর দর্শকাসনে, আমার চেনা-অচেনা, তরুণী থেকে বর্ষীয়সী রমণীকুল বিষ্ণুপ্রিয়ার দুঃখে কেঁদে ভাসাচ্ছেন। ‘নিমাই সন্ন্যাস’ নামে এক যাত্রাতেও সেই দৃশ্য! যেহেতু নিমাইয়ের সন্ন্যাস গ্রহণের গূঢ় কারণ সেই সময় বোধগম্য ছিল না, তাই, যা সহজ সেই দুঃখিনী মেয়ের বিষাদবিলাপ তার প্রতিই ছিল আমারও পক্ষপাতিত্ব। আজও মনে তার রেশ রয়েছে। এখানে-সেখানে, প্রেমপূজারী শ্রীচৈতন্যের দিকে করুণ চোখে চেয়ে থাকা জোড়হস্ত বিষ্ণুপ্রিয়ার ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার দেখে, উঠতি বয়সে যে চৈতন্যদেবের প্রতি ক্রোধ জন্মায়নি, তেমনও নয়। যে ব্যক্তি, হরিপ্রেমের ভাবোন্মত্ততার মধ্যে দিয়ে সর্বাশ্লেষী ধর্মের অবতারণা করছেন, তিনি কেন পত্নীকে প্রেমানন্দে বঞ্চিত রাখলেন? বিষ্ণুপ্রিয়া, সীতা, দ্রৌপদী ইত্যাদি নাম রাখলে মেয়ে দুঃখিনী হয় এমন সব কথা যখন ঠাকুমা-দিদিমাকে বলতে শুনেছি, বুঝেছি আমার মতো আরও বহুজনই বিষ্ণুপ্রিয়ার কষ্টে চিরকাতর।
নিমাইয়ের জন্মকাল ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ। দরিদ্র কিন্তু পণ্ডিতের বংশ তাঁর। বাল্যে পিতৃহারা নিমাই একই সঙ্গে পড়ছেন এবং পড়াচ্ছেন। এ কালের ছাত্রছাত্রীদের টিউশন করার মতো। তাদের মতোই, তাঁরও, বয়সের ধর্মে, হৃদয়ে প্রেমের সঞ্চার হচ্ছে গঙ্গার ঘাটে সুন্দরী লক্ষ্মীদেবীকে দেখে। তাঁদের পরিণয়ের সময় নিমাইয়ের বয়স প্রায় ষোলো।
নিমাইয়ের পাণ্ডিত্য অর্জন এর পরেও চলেছে। সঙ্গে চলেছে সমাজবীক্ষণ। এক ষোড়শ বর্ষীয় তরুণ যুবক পণ্ডিত হতে হতে, চিন্তার জগতে হয়ে উঠছিলেন ভিন্নতর ব্যক্তি। তিনি বঙ্গ পরিভ্রমণে বেরোলেন। ধনোপার্জন কিংবা পাণ্ডিত্য প্রতিষ্ঠা যে কারণেই তিনি ভ্রমণে গিয়ে থাকুন, সেই সময়কালে লক্ষণীয় তাঁর দলগঠনের ক্ষমতা। তাঁকে ঘিরে এক বান্ধব ও ভক্তের বলয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলেছে। তাঁদের কেউ ধর্মসেবী, কেউ ভগবৎসাধক, কেউ বিত্তশালী জমিদার। নিমাই তাঁদের সঙ্গ করেন, আলোচনা করেন বিভিন্ন তত্ত্ব। এবং ভ্রমণশেষে নবদ্বীপে ফিরে পান সেই অপ্রত্যাশিত শোকসংবাদ লক্ষ্মীদেবী সর্পাঘাতে মারা গিয়েছেন।
নিমাইয়ের ওপর বায়ুব্যাধির প্রকোপ ছিল। অনুমান করা যায়, প্রাণপ্রিয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে সেই ব্যাধি তাঁকে ছাড়বে না। যদিও সেই সময়ও তিনি অধ্যাপনা করে চলেছেন। তবু, তাঁর বিচলিতচিত্ততাই সম্ভবত তাঁর শুভার্থীদের তাঁর জন্য দ্বিতীয় দার সংগ্রহে প্ররোচিত করে। এখানে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম, লক্ষ্মীদেবীর পিতা দরিদ্র বল্লভাচার্য পাঁচটি হত্তুকি পণ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, সে ছিল অনাড়ম্বর বিবাহ, তবে সে পরিণয়ে অনুরাগ ছিল। বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে বিবাহ শুভার্থীদের আয়োজিত। শুধু আয়োজিত নয়, সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত, যে আড়ম্বরের ব্যয়ভার বহন করছেন নিমাইয়ের হিতৈষী জমিদার বুদ্ধিমন্ত খান প্রমুখ। কিন্তু এই বিবাহে নিমাইয়ের হৃদয়ে অনুরাগ নেই।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, হিতৈষীগণের কার্যক্রমে বোঝা যায় নিমাই তখন আর কেবল শচীদেবীর আদরের দুলাল নন, বিষ্ণুপ্রিয়ার স্বামী নন, তিনি অনেক বেশি সামাজিক ব্যক্তিত্ব।
এর পর যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রতি পতিপ্রেম সঞ্চারের আগেই নিমাই হরিপ্রেমে অভিভূত। তাঁর অদ্ভুত আচরণ দেখে বিষ্ণুপ্রিয়া কাছে ঘেঁষতে সাহস পান না। অদ্বৈতের সঙ্গে দিবারাত্র পড়ে থাকেন নিমাই, আর তা দেখে শচীদেবী পর্যন্ত বিরক্ত!
নিমাই, সেই সময়ের ধর্ম ও সমাজব্যবস্থার থেকে উদ্ভূত ধর্মপ্রণেতা। যা ছিল ছড়ানো-ছেটানো, সেই সব সংহত ও পরিশীলিত করে তিনি নতুন দর্শন দিয়েছিলেন সমাজকে। তাঁর মধ্যেকার ভাঙাগড়ার কালে বিষ্ণুপ্রিয়া এসেছিলেন।
না এলে, নিমাই বা বিষ্ণুপ্রিয়া কারও কোনও ক্ষতি ছিল না। সম্ভবত, বিষ্ণুপ্রিয়ার মনের অবস্থাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা নিমাই ভাবেননি। সমাজ তাঁকে যে দৃষ্টি দিয়েছিল, তাই দিয়ে নারীকে সামান্যা ভেবে অবজ্ঞাই শ্রেয় ছিল এমনকী শ্রীচৈতন্যের মতো কালজয়ী পুরুষের পক্ষেও। যুগপুরুষ হতে গেলে কাছের নারীকে তুচ্ছ করতে হয়, সে দৃষ্টান্ত বুদ্ধদেব থেকে রামায়ণ মহাভারত সর্বত্র উপস্থিত। আসলে বিষ্ণুপ্রিয়া এক মহাঘটনার ভাগ্যহত কুশীলব। এ কালের রাজনৈতিক সভা বা পদযাত্রায় যেমন অকস্মাৎ গুলি খেয়ে মারা যায় কিছু নগণ্য ব্যক্তি, সেই রকম।
আজকের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিমাইয়ের সিদ্ধান্ত অক্ষমণীয় বলে মনে হয়। বিশেষত, সন্ন্যাস গ্রহণের পর মাতা শচীদেবী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে শ্রীচৈতন্য প্রশ্ন করেন, ‘বলো মা, আমি কোথায় থাকব? পুরী, নাকি বৃন্দাবন?’ শচীদেবী পুরীধামের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। বৃন্দাবন যে বহু দূর! তার চেয়ে ঘরের কাছে পুরীতে থাকলে ছেলের খবরাখবর পাওয়া যাবে! এই সময়, মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎপর্ব সম্ভব হলেও সন্ন্যাস ধর্মানুযায়ী স্ত্রীকে কাছে আসতে দেননি তিনি। জানতে চাননি কী তাঁর ইচ্ছা। একটু চোখে দেখার তৃপ্তিও পাননি বিষ্ণুপ্রিয়া। তাই বলে তিনি হার মানেননি। সেই সময় আত্মমর্যাদার সঙ্গে এক জন নারীর যা করার কথা ছিল, তিনি তা-ই করেন। শ্রীচৈতন্যের প্রেমান্দোলনের অংশ হয়ে ওঠেন তিনি। ব্যক্তিগত প্রেমকে ঐশ্বরিক করে তোলেন একান্ত নিষ্ঠায়। হরিনাম সংকীর্তনেও তিনি মেতে উঠতে দ্বিধা করেননি। আবার গৃহকোণে নিজস্ব বিগ্রহ ও স্বামীর পাদুকাতে উৎসর্গ করেছেন প্রেমাঞ্জলি। আজও নবদ্বীপে রক্ষিত আছে বিষ্ণুপ্রিয়া পূজিত শ্রীচৈতন্যের পাদুকা। বাস্তব জীবনে প্রেমের কণামাত্র না পেয়েও, প্রেম ও পূজাকে এক করে জীবনযাপন করতে পারেন যে নারী, তিনি যে নগণ্য নন, তা শ্রীচৈতন্য অনুধাবন করেননি, কিন্তু এ কালের দৃষ্টি তা করতে পারে। এমনকী ভাবীকালও চিরবিরহিণী মহীয়সী বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্য বেদনাহত হয়ে উঠবে। |
অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|