খেলাধুলা...
কর্কট ব্যূহে
তারিখটা পরিষ্কার মনে আছে। ১২ ডিসেম্বর।
চন্ডীগড়ের ১২ নম্বর সেক্টরের পিজিআই হাসপাতালের ১২ তলার ১২ নম্বর কেবিন। যোগরাজ সিংহ আর আমি দাঁড়িয়ে আছি দরজার বাইরে। যোগরাজের বৌ ২০ বছরের শবনমের একটি ঈষৎ মোটাসোটা ছেলে হল। ওজন ৩.৮ কেজি।
যুবরাজ সিংহের জন্মের এত ছোটখাটো ডিটেলগুলো এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
আর উজ্জ্বল আছে ছেলেকে দেখে যোগরাজের প্রথম রিঅ্যাকশন “যা নিজে পারিনি ওকে দিয়ে আমি সেই সব কিছু অ্যাচিভ করাব।”
বাবা আর ছেলে, দু’জনের জীবনকেই আমূল পাল্টে দিয়েছিল মুম্বই।
কপিল দেবের সমসাময়িক হয়েও যোগরাজ বরাবরই খবরের বাইরে ছিল। ১৯৮০-তে যোগের (যোগরাজের ডাকনাম) ক্রিকেটীয় পুনরুত্থান ঘটিয়েছিল মুম্বইয়ের মফতলাল ক্রিকেট দল। মুম্বইয়ে খেলার এক বছরের মধ্যে যোগ উঠে পড়েছিল জাতীয় দলের ফ্লাইটে। ১৯৮০-৮১’র সিজনে সেই ভারতীয় দল গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর ফিজি সফরে।
যোগরাজ কিন্তু স্বীকার করে যে নিজের ক্রিকেটীয় প্রতিভার প্রতি ন্যায়বিচার সে কোনও দিনই করেনি। মুম্বইয়ের ময়দান আর জিমখানায় আলোচনা হত, ভারতীয় দলে যোগরাজের একটা দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া উচিত ছিল।
যোগকে খানিকটা এগিয়েও থেমে যেতে হয়েছিল। ওর ক্রিকেটীয় স্বপ্নগুলো অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল।
আর তখনই ওর জীবনে এল যুবরাজ। যুবি।
যখন বড় হচ্ছে যুবি, স্কেটিং নিয়ে খুব মেতেছিল। সাব-জুনিয়র পর্যায়ে চ্যাম্পিয়নশিপও জিতেছিল। কিন্তু সে আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। একদিন যোগ ছেলের স্কেটগুলো নিয়ে স্রেফ ছুড়ে ফেলে দিল। ব্যাপারটা তাতেই থেমে থাকেনি। বাবা ছেলেকে বরাবরের জন্য স্কেটিং-এর কোনও চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতেই বারণ করে দিল।
সেই দিন থেকে যুবরাজের জীবনে ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু থাকল না।
চন্ডীগড়ের সেক্টর ১১ বি-র বাড়িতে যোগ জিমনেসিয়াম বানিয়ে দিয়েছিল ছেলের জন্য। কিনে দিয়েছিল এক ডজন ক্রিকেট ব্যাট, ক্রিকেট বল আর টেনিস বল। শবনম খুব সুন্দর বাগান বানিয়েছিল বাড়ির সামনে। শিবালিক পাহাড়ের পটভূমিকায় ফুলে ভর্তি বাগানটা একটা দারুণ দৃশ্য তৈরি করত। সেই বাগানকে খুঁড়ে ফেলেছিল যোগরাজ। কী? না ছেলের ক্রিকেট প্র্যাক্টিসের জন্য পিচ বানাতে হবে। সেই পিচে বাপ-ছেলে মিলে ক্রিকেট প্র্যাক্টিস করত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। এমনকী ছেলের পড়াশোনাটাও গুরুত্ব হারিয়েছিল ওর কাছে।
মনে আছে একদিন চন্ডীগড়ে ওদের বাড়িতে গেছি। রাত তখন ১০টা হবে। হঠাৎ শুনি যুবরাজ প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করছে। হুড়মুড় করে বাইরে এসে দেখি ছেলেটা বুকে হাত দিয়ে বসে। একটা ভিজে টেনিস বল সপাটে এসে লেগেছে ওই জায়গায়। ফর্সা মুখখানা ব্যথায় কালো হয়ে গেছে। ভিজে টেনিস বল বেকায়দায় লাগলে কেমন যন্ত্রণা হয়, যারা ক্রিকেট খেলেছে, জানে। যুবরাজকে সেই ১২ বছর বয়স থেকেই ১৭ গজ দূর থেকে ছুটে আসা ভেজা টেনিস বলের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
অনেক বুঝিয়েছিলাম যোগকে। ওই বয়স থেকে একটা ছেলে যদি ১২ ঘণ্টা ক্রিকেট প্র্যাক্টিস করে, তা হলে খেলাটা সম্বন্ধে সব আগ্রহ উবে যাবে। কিন্তু ছেলের বাবা বুঝলে তো! তার তো তখন একটাই লক্ষ্য। ছেলেকে শেখাতে হবে। এবং শেখার জন্য সব চেয়ে শক্ত পথটাই একমাত্র পথ।
যোগ পরে যুবিকে আমার কাছে মুম্বইতে পাঠিয়েছিল। তখন ওর বয়স বোধহয় ১৮ বছর। চার্চগেটে দিলীপ বেঙ্গসরকরের কোচিং অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করে দিয়েছিলাম যুবিকে। মুম্বইয়ের সঙ্গে যুবির প্রথমটায় একটু মানিয়ে নিতে সমস্যা হত। বুঝতে পারতাম, এপ্রিল মাসের গরমে সকাল আটটার মধ্যে আন্ধেরি থেকে চার্চগেটের প্র্যাক্টিসে পৌঁছবার জন্য লোকাল ট্রেনের ওই ভয়ঙ্কর ভিড়ের মধ্যে ক্রিকেট কিট নিয়ে উঠতে ওর কষ্ট হত। তা সত্ত্বেও ও কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সারা দিন প্র্যাক্টিস করত। প্রতিদিন।
ফেরার ট্রেন ধরত সন্ধে ছ’টায়। সেই একই ভিড়। একই রকম সংঘর্ষ। বাড়ি এসে আর কোনও এনার্জিই থাকত না ওর। মাঝে মাঝে বলে ফেলত, “আর পারছি না।” ওকে তখন বলতাম, যুবি, তুমি কিন্তু একা নও। যারা তোমার সঙ্গে প্র্যাক্টিসে যায় তারাও তোমার মতো কষ্ট করেই পৌঁছয়। তাদের মধ্যে অনেকে তোমার থেকেও দূর থেকে আসেভাসি, ভিরার, থানে, কল্যাণ থেকে।
এক মাস ট্রেনিংয়ের পর অ্যাকাডেমির সেই টিমের সঙ্গে যুবি সাতারায় খেলতে গেল। সাতারার যে মাঠে খেলা, সেখানে ঘাসের চেয়ে খোয়া বেশি। তার ওপর ভীষণ গরম। সে দিন ওর পছন্দের ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে দাঁড়িয়ে যুবি ওই খোয়া ভরা মাঠেই ঝাঁপিয়েছিল। নিজের সর্বস্ব দিয়ে ফিল্ডিং করেছিল। এক ফোঁটাও ভয় পায়নি।
ভারতীয় টিম যে যুবরাজ সিংহকে পেয়েছিল সে কিন্তু এই সংঘর্ষময় মুম্বইতে তৈরি হওয়া ক্রিকেটার। সেটা যুবি স্বীকারও করে। যুবি বোধহয় সে কারণেই মুম্বইবাসী হয়েছিল।
টিন এজ থেকেই যুবি পোড়খাওয়া জীবনযোদ্ধা হয়ে উঠেছিল। ওর বাবা যখন ঠিক করল, নিজের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো ওর মধ্যে দিয়ে পূরণ করবে, তখন ছেলেটার আর কিছু করারও ছিল না। শীতকালের চন্ডীগড়ে কনকনে ঠান্ডায়, দিনের পর দিন ওর বাবা ওকে বিছানা থেকে টেনে তুলেছে ভোরবেলা। প্র্যাক্টিসে কোনও দিন কামাই করতে দেয়নি।
এ ভাবেই চন্ডীগড়ের ‘চকোলেট বয়’ একদিন শক্তসামর্থ্য উত্তর-ভারতীয় পুরুষ হয়ে উঠল। বয়সে বড় ছেলেদের চ্যালেঞ্জ করত অনায়াসে। ওকে সহজে ভয় পাওয়ানো যেত না। আর তার পাশাপাশি ক্রিকেটের সঙ্গে প্রেমটাও জমে উঠছিল ওর জীবনে। কিন্তু এটাও বুঝতে পারত যে, আঞ্চলিক পর্যায়ে যত ভালই খেলুক, যতই খাটুক, জাতীয় দলে ঢোকাটা সহজ নয়।
ওড়িশার বিরুদ্ধে প্রথম রঞ্জি ম্যাচটা খেলার পর যুবি টিম থেকে বাদ যায়। সে সময়ে ওর কেমন যেন ধারণা হয়, টিম-গেম-এর থেকে একক পারদর্শিতা দেখানো যায়, এমন খেলাতে চলে যাওয়া উচিত। টেনিসটা ভাল খেলত বরাবরই। রঞ্জিতে বাদ পড়ার পর দু’বছর ও জুনিয়র লেভেলে টেনিস খেলেছিল।
যুবির ক্রিকেটে সব চেয়ে আকর্ষক জিনিসটা ছিল ও নিজের ফিল্ডিংটা ভীষণ এনজয় করত। মুম্বইয়ের গরমে, মুম্বইয়ের ছেলেদের সঙ্গে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সমানে-সমানে পাল্লা দিয়ে যেত।
কৈলাস গাট্টানির দলের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর সেরে যখন যুবি দেশে ফিরল, লক্ষ করলাম ওর মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। সেই সফরে ও সব চেয়ে বেশি সংখ্যক রান করেছিল। নিজের খেলাটাকেও অনেক আঁটোসাটো করে ফেলেছিল। ক্রিকেটের অন্তরটাকে বুঝতে শুরু করেছিল। সফরটা ওর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
ওর খেলার মধ্যে একটা স্বাভাবিক আক্রমণাত্মক ভঙ্গি ছিল। শিক্ষক হিসেবে দিলীপ (বেঙ্গসরকর) সেটাকে সমর্থন করত। দিলীপ বরাবর বিশ্বাস করত ব্যাটসম্যানকে নিজস্ব স্টাইলেই খেলতে দেওয়া উচিত। ভুল করুক। তার থেকে শিক্ষা নিক। কিন্তু স্টাইলটা যেন নিজস্ব হয়। যুবির বোধহয় এমন শিক্ষকই দরকার ছিল। টেকনিক্যাল কচকচি ওর খেলাটাকে গুলিয়ে দিতে পারত।
আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রয়োজন ছিল এক জন মেন্টরের। সেই মেন্টর ও খুঁজে পায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে। ২০০৪ সালে সৌরভ তো ওকে সহবাগের পাশাপাশি ওপেনারও বানাতে চেষ্টা করেছিল। পরীক্ষাটা সফল হয়নি, সে কথা অন্য। কিন্তু যুবি ওর ‘দাদা’কে পাগলের মতো সম্মান করে এখনও। এমনকী ঘনিষ্ঠ আড্ডাতেও সৌরভের প্রসঙ্গ উঠলে দেখেছি ও কী অসম্ভব সম্ভ্রমের সঙ্গে কথা বলে।
জাতীয় দলের প্রথম এগারোয় যখন ও ঢুকতে পারছে না, তখন ওকে টেনস্ড লাগত। কিন্তু মিড্ল অর্ডার তখন ভর্তি। কার জায়গায় ঢুকবে ও? নিজেকে সারা ক্ষণ বোঝাত যে প্রথম এগারোয় কেউ আহত হলে নির্বাচকেরা নিশ্চয়ই ওর কথা ভাববেন। নিজেকে বোঝাত যে কত ক্রিকেটার তো সারা জীবন টেস্ট ম্যাচ খেলতেই পায় না।
জাতীয় দলে ঢোকার জন্য এই অপেক্ষাটাও ওকে ভেতরে ভেতরে শক্ত করে তুলেছিল। যুবির বইয়ের কালেকশনে প্রচুর আত্মজীবনী আছে। প্রায় সব ক’টাই ‘মোটিভেশনাল’। যুবির ওপর এই বইগুলোর একটা পরিষ্কার প্রভাব পড়ছিল এই সময়। কথাবার্তায় আবেগপ্রবণতা কমছিল। তর্কে নামলে সহজে ধৈর্য হারাত না। তবে হ্যাঁ, ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব যখন পেল না, তখন একটু ভেঙে পড়েছিল। আসলে অভিমানটা হয়েছিল একসময়ের শিক্ষক এবং তখনকার বোর্ড চেয়ারম্যান বেঙ্গসরকরের ওপর। দিলীপ যে প্রাক্তন ছাত্রের থেকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে অধিনায়ক হিসেবে বেশি পছন্দ করছে, এটা ওর মানতে কষ্ট হয়েছিল বোধহয়।
২০১১-র বিশ্বকাপে ওর যে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স, তার পিছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। বিশ্বকাপে সব ক’টা ম্যাচে খেলতে পারবে কি না, যুবি তখনও জানে না। কিন্তু নিজেকে তৈরি করছিল সারা ক্ষণ। নিজের বোলিংটাকে আরও ঘষামাজা করছিল। টিমের স্বার্থে আসতে পারে এমন এক জন ‘পার্সেন্টেজ’ ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে গড়ে নিচ্ছিল। আর মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, জিতলে বহু দিনের রুমমেট সচিন তেন্ডুলকরকে বিশ্বকাপটা উৎসর্গ করবে।
যুবিকে অনেকেই ভুল বুঝেছে। আর মিডিয়া তো পারলেই যুবির জীবনের যে কোনও ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করেছে। সবাই ভাবে যুবি একটা বিতর্কিত চরিত্র। আজ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন। কয়েক জন হাতুড়ের কথায় তৈরি হওয়া বিতর্ক নয়, এখন ওর দরকার পাশে দাঁড়াতে পারে এমন বন্ধু।
১৪ বছর বয়সে যুবি বলত, মুম্বইয়ের একটা ট্রেনে যত জন ওঠে, সারা চন্ডীগড়ে তত জন থাকে না। সেই উপচে পড়া ট্রেনে আমার সঙ্গে ও যখন উঠত, লক্ষ করতাম পা রাখার জন্য বেশ জোরেই ধাক্কা দিত সামনের ভিড়টাকে। কেয়ারই করত না যদি কেউ রেগে গিয়ে দু’টো কথা শোনাত।
মনে পড়ে না কোনও দিন কোনও চ্যালেঞ্জের সামনে থেকে যুবিকে পালিয়ে আসতে দেখেছি বলে। সাইক্লিংয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, ক্যানসারের কবল থেকে ফিরে আসা ল্যান্স আর্মস্ট্রং বলেন, “মানসিক ভাবে তুমি যদি শক্তিশালী হও, যে কোনও লড়াই-ই তুমি জিততে পারবে।”
সেই মানসিক শক্তিটা কিন্তু যুবরাজ সিংহের আছে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, ক্যানসারের সঙ্গে এই লড়াইটাও যেন ছেলেটা জেতে।

ছবি: উৎপল সরকার


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.