রামচন্দ্র বিশ্বাস। হুগলির উত্তরপাড়ার শিবতলা বাইলেনের মানুষটির বয়স ষাটের কাছে। এই বয়সে গড়পড়তা মানুষ অবসরের দিকে তাকায়। কিন্তু রামচন্দ্রের সে যো নেই। কারণ তাঁর অপেক্ষায় রয়েছে পৃথিবীর আরও ৪৪টি দেশ। ওই দেশগুলিতে এখনও পা রাখেনি রামচন্দ্রের দু’চাকা। মানে সাইকেল। ইতিমধ্যে তিন হাজার দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে তাঁর ঝুলিতে। আর নানা দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার মধ্যেই একটা সুপ্ত বাসনা জেগে উঠেছে রামচন্দ্রের, তা হল গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ নাম তোলা।
পায়ের তলায় সরষে নিয়ে ১৯৮২ সালে শুরু করেছিলেন সাইকেলে দেশ ভ্রমণ। তরতাজা এক যুবক। হাতে সাকুল্যে ২৮ টাকা। কলকাতা থেকে শুরু করে দিল্লি। সম্বল ছিল রাজ্যপাল ভি ডি পাণ্ডে মহাশয়ের আশীর্বাদ-সহ একটি পত্র। সেই চিঠি নিয়ে দিল্লি। এক বাঙালি যুবকের দেশ এমন ভ্রমণপ্রীতি দেখে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গাঁধী উপহার দিয়েছিলেন কেনিয়া যাওয়ার দু’জনের প্লেনের টিকিট। মুম্বই থেকে প্রণব মুখোপাধ্যায় দিয়েছিলেন হাত খরচের জন্য পাঁচ হাজার নগদ। রামচন্দ্রের সঙ্গী ছিলেন উত্তরপাড়ারই আর এক বন্ধু সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। “বয়েস কম থাকতে থাকতে কঠিন দেশ, আফ্রিকার বেশিটা ভ্রমণ করে নিই। প্রায় সমস্ত আফ্রিকা (অরণ্য বাদে) ঘুরেছি। মূলত শহর কেন্দ্রিক জায়গাগুলিই দেখেছি। তবে আশপাশের ছোটখাটো ‘প্লেস অব ফেম’-এ যে যাইনি এমন নয়।” সেদিনের অভিজ্ঞতা গড় গড় করে বলে থামলেন রামচন্দ্র। ভ্রমণের নেশাতেই পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ বিভাগ থেকে মাত্র সাত বছর চাকরি করে ছুটি নিয়ে নেন ‘একলা’ মানুষটি। ২০১১ সালে মা অসুস্থ থাকায় ঘর ছেড়ে আর বেরোনো হয়নি।
ঘুরেছেন কোন কোন মহাদেশে?
“আমেরিকা-জার্মান-ফ্রান্স-সুইডেন দিয়েছে ওই দেশের সম্মানীয় নাগরিকত্ব। নর্থ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ড ঘোরা। ঘুরেছি পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপ। রাশিয়ার চোদ্দোটি দেশ। সাহারার কিছুটা। আমাজান ও আলাস্কার অংশ বিশেষ এবং উত্তর মেরুর কিছুটা। বেশিরভাগটাই সাইকেল, কিছুটা প্লেনে।” জানালেন রামচন্দ্র।
নব্বইয়ের দশকটা রামচন্দ্রের কাছে স্মরণীয়। কারণ? ১৯৯২ সালে দু’চাকায় দেশভ্রমণের এই ‘মিশন’কে সম্মান জানায় নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি। রামচন্দ্র পান, ‘এশিয়ান প্রাইড কমিউনিটি লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’। ওই বছরই ইউনাইটেড নেশন-এর প্রধান অফিসে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পান। কেন এই দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা, কোথায় কেমন অভিজ্ঞতা তা সবই জানিয়েছেন। ’৯২তেই ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির হেড কোয়ার্টার, লসান থেকে রামচন্দ্রের সাইকেলে বিশ্বপরিক্রমাকে (মিশনটিকে) বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করে সার্টিফিকেট দেয়। এ সব ছাড়াও ঝুলিতে রয়েছে আরও নানা বিদেশি সম্মান। তবে সবচেয়ে সুখের, ১৯৯৮ সালে অকল্যান্ডে এডমন্ড হিলারির বাড়িতে পাঁচ দিনের আতিথ্য। ভাবা যায়?
চারখানা সাইকেল রামচন্দ্রের। নানা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া উপহার। সেগুলিকে আরার নিজের প্রয়োজন মতো অদল বদল করেছেন। যখন যেমন প্রয়োজন, সে ভাবে। সাইকেলে থাকে পঞ্চাশ কেজির মতো লাগেজ। রান্নার সরঞ্জামও। “পৃথিবীর হেন খাদ্য নেই যা খেয়ে দেখিনি। নামীদামি গাড়ি, প্লেনে চড়েছি। নামীদামি হোটেলে থেকেছি। পৃথিবীর ৩,২০৫টি শহর ঘোরা হয়ে গিয়েছে। সাইকেল চলেছে ৬,২৭,২০০ কিলোমিটার। পৃথিবীর নানা দেশের পুলিশের দেওয়া সার্টিফিকেট দু’হাজারের বেশি। সাত হাজার রাষ্ট্রনেতার সার্টিফিকেট।” থামলেন রামচন্দ্র।
এর পরেও কি বলা যাবে বাঙালি ভিতু, ঘরকুনো? |