|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
সৃষ্টি থেকে জীবনের অভিমুখে |
স্বপন মজুমদার |
রবীন্দ্রনাথ টেগোর: অ্যান ইন্টারপ্রিটেশন, সব্যসাচী ভট্টাচার্য। পেঙ্গুইন ভাইকিং ২০১১, ৪৯৯.০০
|
ভাবতে একটু অবাকই লাগে, রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনী-বই বাংলায় লেখা হয়নি, হয়েছিল ইংরেজিতে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দু’বছরের মধ্যেই আটলান্টিকের দুই তীর থেকে, একই বছরে (১৯১৫), প্রকাশিত হয়েছিল দু’টি বই: ইংল্যান্ড থেকে আর্নেস্ট রিজ-এর রবীন্দ্রনাথ টেগোর: আ বায়োগ্রাফিক্যাল স্টাডি (ম্যাক্মিলান) ও আমেরিকা থেকে বসন্তকুমার রায়ের রবীন্দ্রনাথ টেগোর: দ্য ম্যান অ্যান্ড হিজ পোয়েট্রি (ডড মিড)। আর রবীন্দ্রনাথের সাম্প্রতিকতম জীবনী, অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্যের ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর: অ্যান ইন্টারপ্রেটেশন’ প্রকাশিত হল ২০১১-এর শেষ চতুষ্কে। অর্থাৎ, ছিয়ানব্বই বছরের বেশ সম্পন্ন একটি ধারার নবীনতম প্রকাশটি এখন আমাদের সামনে উপস্থিত।
নবীন: আরও একটি কারণে; নিছক কালানুক্রমিক ঘটনার আখ্যানে গ্রথিত নয় এই জীবনী। একে বলা সঙ্গত: জীবনভাষ্য; ভাবনা থেকে জীবনের দিকে যাওয়া। বাংলায় যে কয়টি উদাহরণ আছে এমন রচনার, ভাষ্য ও তথ্যের সমতা সেখানে প্রায়শই রয়ে গিয়েছে অধরা। অবশ্য প্রভাতকুমারের মহৎ প্রয়াসে ‘সাহিত্য-প্রবেশক’ উপনামটি অযথা নয়। জীবনের সঙ্গে কর্ম-প্রসঙ্গ ততটা না হলেও, সাহিত্য-প্রসঙ্গ অনেক ক্ষেত্রেই যুক্ত করে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। কবির জীবনকালে লেখা বলে রবীন্দ্রনাথের বহু মৌখিক কথন বা মন্তব্য সংযোজনের সুযোগ ছিল প্রভাতকুমারের। সে গৌরবে অনন্য হয়ে থাকবেন তিনি চিরকাল। সব্যসাচী ভট্টাচার্যের বইয়ের সব থেকে বড় গুণ ও গুরুত্ব, রবীন্দ্রনাথের কর্ম, চিন্তা, কল্পনা তাঁর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত করে দেখতে, দেখাতে চেয়েছেন তিনি। তাঁর অধীত ইতিহাসবিদ্যার বৈশিষ্ট্য সময়ের পরম্পরা বিস্মৃত হননি কখনও, কিন্তু সেই পরম্পরাকে একটি কাঠামোর বেশি প্রভুত্ব করতে দেননি তিনি। রবীন্দ্রনাথের তথ্যময় জীবন আর সমকালীন ঘটনার কালপঞ্জি অধ্যায় অনুযায়ী বইয়ের শেষে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন লেখক। আখ্যানকে তথ্যের ভারে বিড়ম্বিত না-করে তথ্য ও সত্যের স্বতন্ত্র কিন্তু পরম্পরা-সাপেক্ষ এই বিন্যাসপদ্ধতি বিশেষ করে সাহিত্য ও ইতিহাস-সম্পৃক্ত বিষয়ে যথেষ্ট উপযোগী হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস করি। তার মানে এই নয়, আখ্যান রচনায় সন-তারিখ বা তথ্য পরিহার করেছেন তিনি, প্রসঙ্গসূত্রে প্রয়োজন হলে আলোচ্য সময়ের রবীন্দ্র-জীবনের বিগত বা অনাগত ঘটনার সমান্তর বা বিপ্রতীপ অভিজ্ঞতাও তুলে এনেছেন সাহসভরে। ইতিহাসের প্রচলিত পথে চললে এমন ছিন্নবাধা বয়ান তিনি রচনা করতেন না। এক জন সৃজনশীল কর্মী ও লেখকের জীবনের ইতিহাস লিখতে গেলে কোন যোগসূত্রে বাঁধা তার ধ্রুবপদ, তাকে আবিষ্কার করেই যে তৈরি হয়ে ওঠে এক কবি-শিল্পীর জীবনী, রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে সেই অচিরাচরিত পথেই চলেছেন অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্য।
টীকা ও আনুষঙ্গিক তথ্যপঞ্জি সব মিলিয়ে ৬৪ পৃষ্ঠা বাদ দিলে মাত্র ২৪২ পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের জীবনভাষ্য রচনা করেছেন অধ্যাপক ভট্টাচার্য। ভূমিকায় প্রথম দু’টি পরিচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সময় এবং তাঁর চিন্তার বিবর্তন বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলাপের পর ছয়টি অধ্যায়ের চুম্বকে সম্পূর্ণ বইটির বক্তব্য যেমন প্রাঞ্জল ও পরিমিত ভাবে পরিবেশন করেছেন তিনি, আমাদের অনেকের পক্ষেই যথেষ্ট শিক্ষণীয় সেই প্রমিতি। অথবা উত্তরভাষে যে-ভাবে এক দিকে ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে উত্তরণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে, অন্য দিকে প্রতীচ্যে তাঁকে গ্রহণ-বর্জনের পটভূমিকায় রেখে, ভারতসাহিত্যের সম্ভাব্য সত্তানির্মাণে ‘অজানিত ভাবে’ হলেও রবীন্দ্রনাথের অবস্থান নির্ণয় করতে চেয়েছেন, ঈষৎ দ্রুত সিদ্ধান্ত বা তর্কসাপেক্ষ হলেও, তার মধ্যে ভাবনার বীজ আছে। ভূমিকা ও উত্তরভাষ ছাড়া বইয়ের ছয়টি অধ্যায়ের শিরোনাম: দ্য ইনার লাইফ, দ্য এনচান্টেড গার্ডেন: ১৮৬১-৯০, ইনটু দ্য ওয়র্ল্ড: টেগোর ইন দ্য পাবলিক স্ফিয়র ১৮৯১-১৯০৮, ‘দ্য সেজ অব শান্তিনিকেতন’ ১৯০৯-১৯, নিউ ডিরেকশনস ১৯১৯-২৯ ও টুঅর্ডস দ্য রিলিজন অব ম্যান ১৯৩০-৪১।
রবীন্দ্রনাথের সৃজনসত্তার গভীরে তাঁর অন্তর্জীবন, তাঁর ‘মনের কারখানাঘর’-এর দ্বার খোলাই, মনে হয়, শ্রীভট্টাচার্যের প্রধান অভিপ্রায়। নিঃসঙ্গতাই রবীন্দ্র-জীবনের ভবিতব্য মনে করেন তিনি। আর এই একাকিত্ব থেকেই আসে অবসন্নতার ছায়া। পরিবারে, সমাজে, সৃষ্টিক্ষেত্রে তাঁর বহুবিচিত্র ভূমিকায় অন্তর্বিরোধও লক্ষ করেন জীবনীকার। আমাদের সমাজে জনপরিসর গড়ে ওঠেনি, ঔপনিবেশিক শিক্ষায় গড়ে ওঠেনি স্বাধীন মননের পরিবেশ। সঙ্কীর্ণ ও ব্যাহত জীবনধারায় আমাদের মন রয়ে গিয়েছে প্রাদেশিক: রবীন্দ্রনাথেরই এমন বিবেচনা নির্ভর করে অধ্যাপক ভট্টাচার্য দেখাতে চান, ইতিহাস-নির্ধারিত বহির্জীবন থেকে মুক্ত হয়ে সৃষ্টির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্জীবন কী ভাবে পূর্ণ হয়ে ওঠে স্বমহিমায়।
লক্ষ করার মতো, তাঁর ৮০ বছরের জীবনকে অধ্যাপক ভট্টাচার্যও পর্বায়িত করেছেন পাঁচটি পর্যায়ে, যেন এক পঞ্চাঙ্ক নাটক তাঁর জীবন, অনেকটা একই ভাবে যেমন দেখতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ১৮৬১ থেকে ৯০, ১৮৯১ থেকে ১৯০৮, ১৯০৯ থেকে ১৯, আবার ১৯১৯ থেকে ১৯২৯ আর ১৯৩০ থেকে ৪১: এই ভাবে জীবনীকার দেখতে চান রবীন্দ্র-জীবনের পর্ব-পর্বান্তর। এর মধ্যে একমাত্র ১৯১৯-কেই তিনি রেখেছেন দুই পর্বের মিলনবিন্দুতে। চিন্তার বাঁক ফেরাকেই যুগবিভাগের শুরু বা শেষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন তিনি। সাহিত্যসৃষ্টির দিক থেকে হয়তো ততটা গ্রহণযোগ্য হবে না এই পর্বায়ণ। ১৮৯১ বা ১৯১৯ সাহিত্যের বিচারে কি সত্যি কোনও কালফলক রবীন্দ্রনাথের জীবনে? কিন্তু তাঁর বিবেচনাপদ্ধতি মানলেও, ১৯০৮ বা ১৯২৯ সাহিত্য প্রকাশের দিক থেকে বিবেচ্য হলেও ঘটনার ক্রান্তিকাল হিসেবে মানতে দ্বিধা হবে অনেকেরই।
আসলে, এই বইকে মান দিতে হবে, কারণ এখানে জীবনীকার জীবনী-ইতিহাস থেকে সৃজন-বৃত্তান্তে যেতে চাননি; চলেছেন সৃজনক্ষেত্র থেকে সে কর্মের বিচারে হোক অথবা শিল্পের জীবনের দিকে পৌঁছনোর চেষ্টায়। অন্তর্জীবন থেকে বহির্জীবনের দিকে। এই ইতিহাসবিদের মন ভরে আছে তাঁর কবির মতো, হয়তো অজ্ঞাতসারেই, সৃষ্টিরসের সন্ধানে, সাহিত্যের অনুভবে প্রধানত। আর তাই সাহিত্যের নিদর্শন নির্বাচনে স্রষ্টার মানসিকতা পরিবর্তনের ইঙ্গিত তিনি ধরতে পারেন অব্যর্থ। |
|
নিঃসঙ্গ! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রামকিঙ্কর বেজ-কৃত আবক্ষমূর্তি |
|
‘মোহন কানন: ১৮৬১-৯০’ আর ‘বিশ্বসাথে ১৮৯১-১৯০৮’ অধ্যায়ে জীবনীকার বেছে নিয়েছেন পরিবার-পরিজনের মধ্য থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর আপ্তমনস্ক হয়ে ওঠার পিছনে শাসন-প্রতিবাদ, মৃত্যু-গার্হস্থ্যের কয়েকটি ঘটনা আর সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তাঁর জীবনদৃষ্টি পরিবর্তনের কিছু অন্তর্বয়ান।
গোরা, ঘরে-বাইরে আর ‘স্ত্রীর পত্র’-র সাক্ষ্যে পরম্পরা ও আধুনিকতা, জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা, নারীত্বের হিন্দু ধারণা ও স্বনির্ভরতা প্রসঙ্গে ‘শান্তিনিকেতনের ঋষি’র (১৯০৯-১৯) মধ্যে আদর্শগত বিরোধ লক্ষ করেছেন জীবনীকার। সমাজে সে-বিরোধ অবশ্যই ছিল; তাঁর লেখায় বিষয় হিসেবে গ্রহণ করলেও তাঁর মনে কি এমন সব প্রসঙ্গে সংশয় ছিল কোনও? সম্ভবত নয়।
১৯১৯ থেকে ২৯: ‘নবীন অভিমুখ’ পর্বের সূচনা অবশ্যই জালিয়ানওয়ালাবাগ ও খেতাব-বর্জন মনে রেখে, সমাপ্তি কিন্তু সাহিত্যগৌরবে। মুক্তধারা, রক্তকরবী, যোগাযোগ ও শেষের কবিতা স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়ে আলোচনা করেন জীবনীকার। যন্ত্রদানব তার সম্পদমোহ, বিবাহ আর প্রেম, সমাজ আর মানুষ বিষয়ে নিরাসক্ত মনে আর শাণিত বচনে কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ, যার স্বর আর সুর আগের রবীন্দ্রনাথের থেকে অনেকটাই আলাদা।
‘মানুষের ধর্মের দিকে ১৯৩০-৪১’ প্রসঙ্গ-বৈচিত্রে যেমন রবীন্দ্র-জীবনে, তেমনি এই বইয়ের আলোচনায় বিপুল বৈভবে উপস্থিত। শিক্ষায়-ধর্মে, শিল্পে-বিজ্ঞানে, সাহিত্যে-সংগীতে তাঁর সমন্বয়ী সংস্কৃতির ধারণা তখন বিশ্বভারতীকে অবলম্বন করে ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-বিদেশে। এরই পাশে তথাকথিত শিশুপাঠ্য ‘আজগুবি’ রচনা খাপছাড়া, ছড়ার ছবি, সে বা প্রহাসিনী জীবনীকারের নজর এড়ায় না। কিন্তু শেষ দশকের কবিতা যখন তিনি তিনটি (তিনের প্রতি একটু পক্ষপাত আছে মনে হয় বইটি জুড়ে) উপপর্বে: পুনশ্চ থেকে শ্যামলী, প্রান্তিক আর সেঁজুতি নিয়ে একটি আর আকাশপ্রদীপ থেকে সানাই দিয়ে আরএকটি ভাগ করেন, তখন একটু দূরকল্পনা মনে হয় এই বিভাজন।
রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে পাঠকের আগ্রহ যদি নিভে গিয়ে না থাকে, এ বইয়ের পুনর্মুদ্রণের আয়োজন হবে অচিরে। সেই সুযোগে দু-একটি ত্বরিত মন্তব্য সংস্কারের অবকাশ আছে। যেমন, পঁয়ত্রিশ বছরের রবীন্দ্রনাথকে ‘অপেক্ষাকৃত অপরিচিত কবি’ মানসী থেকে চিত্রা আর কাব্য-গ্রন্থাবলী বেরিয়ে গেছে তত দিনে, বলা সঙ্গত কি? ব্রাহ্ম সমাজের সংস্কারবাদী আন্দোলনের বিবর্তনে তাঁর ভূমিকা সত্যিই কি উল্লেখযোগ্য? খ্যাতি বৃদ্ধির পর তাঁকে বিক্রি করে দিতে হয়েছিল বেশির ভাগ বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব ব্যক্তিগত ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য, তথ্য হিসেবে কি প্রমাণ করা যাবে? অথবা, এক নিশ্বাসে কি বলে ফেলা যাবে, দেশ গঠনে কবির বিকল্প পথ, পল্লিপুনর্গঠন কোনও সাড়া পেল না, অথবা ২০-র দশকে বিশ্বভারতীর প্রতিশ্রুতি দেখা গেলেও পরবর্তী কালে সে সম্ভাবনা অধরা থেকে গেল?
রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, শিক্ষাবিস্তার আর পল্লিসঞ্জীবন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ দুই কাজ। জীবনীলেখকের কাছে এই দু’টির বিশেষ করে দ্বিতীয়টির কি আর একটু বিস্তার আশা করতে পারেন পাঠক পরের সংস্করণে? ভাণ্ডার বা শিলাইদহের কোনও উল্লেখ থাকবে না রবীন্দ্র-জীবনে?
অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্যের রবীন্দ্রনাথ টেগোর: অ্যান ইন্টারপ্রিটেশন সুখপাঠ্য হলেও ঘুমপাড়ানিয়া নয় একেবারেই। নিজের মত ও ব্যাখ্যান স্পষ্ট করে বলার তেজ আছে তাঁর। ২০১৩-র উপক্রমে দাঁড়িয়ে তাঁর একটি বাক্য এই বইয়ের দাম উসুল করে দেয়: ‘ইন টার্মস অব হিজ ইন্টেলেকচুয়াল লাইফ, ইট ইজ ডাউটফুল ইফ দিস (নোবেল) এপিসোড ওয়জ সিগনিফিক্যান্ট।’ অনতিবিলম্বে বইটির বাংলা অনুবাদ হোক, এই প্রত্যাশা।
প্রকাশক বইটিকে প্রায় নির্ভুল করে প্রকাশ করলেও, অহেতুক হাইফেন যুক্ত করে বাংলা গ্রন্থনামগুলি অনেকটা অপরিচিত করে তুলেছেন। নির্দেশিকাও মর্মান্তিক ভাবে অসম্পূর্ণ। অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত পরিচ্ছেদ-নামগুলি সূচিপত্রে স্থান পেলে পাঠকের আগ্রহ বাড়াত বলে মনে হয়। |
|
|
|
|
|