নাটক সমালোচনা...
প্রতিবাদ ফুরোয় না
কালের যাত্রার ধ্বনি সব শিল্পরূপ শুনতে পায় না। কাজটি কঠিন। এই কারণেই কঠিন যে, সময়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য নিবিড় সাহস প্রয়োজন। শিল্পকর্মের আধারে সেই সাহস জ্বলে ওঠে কল্পনার অনুষঙ্গে। ‘স্বপ্নসন্ধানী’র সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘নটীর পূজা’ সেই দুঃসাহসী কল্পনার দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। রবীন্দ্রনাথের একটি সৃষ্টি, তাকে স্থাপন করা হল সমকালের আধারে। ‘নটীর পূজা’র শ্রীমতীর বিভঙ্গে মিশে গেল ইরম শর্মিলা চানু-র নীরব এবং উজ্জ্বল প্রতিবাদ। ভাবনার এই অন্য ধাঁচ এবং তার যথাযথ দৃশ্যায়নের জন্য নাট্য-রূপকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় এবং নির্দেশক কৌশিক সেন-এর অভিনন্দন প্রাপ্য।
১৮ আশ্বিন, ১৩০৬-এ রচিত ‘পূজারিণী’ কবিতারই নাট্যরূপ ‘নটীর পূজা’। রূপকার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। নির্মলকুমারী মহলানবিশ জানিয়েছেন, প্রতিমা দেবীর ইচ্ছে ছিল, শুধু মেয়েদের নিয়ে একটি নাটক অভিনীত হোক। সেই সূত্রেই এই নাটক। ‘স্বপ্নসন্ধানী’র প্রযোজনায় সেই নাটক আদ্যন্ত বদলেছে, বলা উচিত হবে না, কিন্তু অন্তটি পরিবর্তিত হয়েছে আশ্চর্য ভাবে। রাজ-অনুজ্ঞা অমান্য করায় শ্রীমতীর শিরশ্ছেদ ছিল মূল নাটকে। স্বপ্নসন্ধানীর প্রযোজনায় শ্রীমতীর নিধন নেই, আছে এক বিচিত্র নির্বাসন। রাজা অজাতশত্রু শ্রীমতীকে হত্যা করতে নারাজ (‘মরলে ও অমর হয়ে যাবে’, স্পষ্ট জানান তিনি)। রাজা চান, বেঁচে থাকুক এই প্রতিবাদিনী, কিন্তু ঠাঁই বদলাক। সে চলে যাক কেন্দ্র থেকে প্রান্তে। এই ভাবে ‘শেষ হয়ে না হইল শেষ’-এর একটি দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে এই নাটক, যেন অনন্তের দিকে ভেসে যায়।
এক দিকে রাষ্ট্রযন্ত্র, অন্য দিকে ব্যক্তির সত্তা, ব্যক্তির প্রতিবাদ। কোথায় দেখা হয় এদের? কী ভাবে? কোন মোহানার ধারে? যে রাষ্ট্র সর্বদর্শী, সর্বত্রগামী, সে কী ভাবে নিঃসঙ্গ করে দেয় এককের কণ্ঠ? আবার, ধরা যাক, সেই যে একাকিনী, বলতে গেলে একলা পাগল, তার সঙ্গেই বা বাইরের এই ছড়ানো সমাজের দেওয়া-নেওয়া চলে কী ভাবে? সমাজ কি একলার এই বিদ্রোহের কথা মনে রাখে? রাষ্ট্রই বা কতটুকু জমি ছাড়ে তাকে? কেন-ই বা ছাড়ে? স্বপ্নসন্ধানীর ‘নটীর পূজা’ এই সব বিস্ফোরক প্রশ্ন নিয়ে খেলা করে। নাটকের শেষে, পরিচালকের আশ্চর্য দৃশ্যকল্পনায়, বছরের পরে বছর চলে যায়, শ্রীমতী পড়ে থাকেন, পড়েই থাকেন। কারা ওই সমুখ দিয়ে আসে যায়, কিন্তু খবর নেয় কি? স্বপ্নসন্ধানী সেই খবরটাই নিতে চেয়েছে। স্পষ্ট জানিয়েছে, দমনমূলক বিধি ‘আফস্পা’ তুলে নেওয়ার দাবিতে মণিপুরের ইরম শর্মিলার যে অনশন, তারই একটি ছবি হয়ে জেগে রইল এই নাটক। ‘কৃত্রিম সৌজন্যের দিন আমার গিয়েছে’, সরাসরিই বলে শ্রীমতী। তাই নিছকই রূপক নাট্য বললে বোধকরি সবটুকু বোঝানো যাবে না। এই নাটকে একটি প্রাচীন কাহিনির শরীরে সমকালের প্রক্ষেপটি স্পষ্ট, কিন্তু তা কখনওই চিৎকৃত নয়, বরং শিল্পিত।
অভিনয় এই নাটকের সম্পদ। অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় শ্রীমতীর চরিত্রে মঞ্চাবতরণ করেছেন অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে। এক দিকে নটীর বিনয়, অন্য দিকে তার নিজস্ব বিশ্বাস, এবং সেই বিশ্বাসে দ্যুতিমান স্পর্ধা সফল ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। বেশ কয়েক বছর আগে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অসুখ’ ছবিতে তাঁর গলায় রবীন্দ্রনাথের গান শোনা গিয়েছিল। ‘নটীর পূজা’ই প্রমাণ, কণ্ঠটি অমলিন আছে। পাশাপাশি, নৃত্যবিভঙ্গেও তিনি অনবদ্য।
স্বপ্নসন্ধানীর আদি সদস্য, অধুনা চলচ্চিত্র ও নানা অভিনয়-মাধ্যমে সুনামী কাঞ্চন মল্লিক মনটা ঈষৎ বিষণ্ণই করে দেন। তাঁর মতো শক্তিমান অভিনেতা নিছক ভাঁড়ে পর্যবসিত হলে সেই ক্ষতি পূরণ করা কঠিন। মাধবাচার্য্য-এর মতো খল চরিত্রেও মাঝেমধ্যে ঝলসে ওঠে কাঞ্চনের অব্যর্থ কমিক টাইমিং। ‘রানী লোকেশ্বরী’র চরিত্রে দিতিপ্রিয়া সরকার অনবদ্য। তিতাস ভৌমিকের ‘রত্নাবলী’ নজর কাড়ে। অন্যরাও যোগ্য সঙ্গত করেছেন এই চারটি মুখ্য চরিত্রের সঙ্গে।
প্রকৃতপক্ষে, এই নাটকের পঞ্চম কেন্দ্র চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথের গান। চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত ভাবনা মঞ্চের উপরে আলো তৈরি করেছে। বিভিন্ন গানের কিছু ছিন্ন অংশ যে ভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করেছেন তিনি, তা স্মরণীয়। ‘অজানা সুর কে দিয়ে যায়’, ‘আর রেখো না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’ বা ‘পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে’র মতো গানের প্রয়োগ অন্য মাত্রা আনে মঞ্চাভিনয়ে। এই সব গানের টুকরো একই সঙ্গে চরিত্রের সংলাপ এবং দৃশ্যের আবহ হয়ে ওঠে। অশোক প্রামাণিকের আলো যথাযথ, সঞ্চয়ন ঘোষের মঞ্চ পরিকল্পনাকে নির্দেশক কৌশিক খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। সেই পরিসর খুবই নমনীয়, পরিভাষায় বললে ‘ফ্লেক্সিবল’ তার মধ্যে বিভিন্ন কালপর্ব, বাস্তব ও স্বপ্ন, বা দুঃস্বপ্ন খেলা করে।
একই সঙ্গে, এই নাটকের বিভিন্ন চরিত্র-কল্পনার মধ্যেও কাজ করে সেই নমনীয়তা। সাদা-কালোর চেনা এবং সহজ ছকে চরিত্রদের আটকে রাখেন না পরিচালক। কোনও মুহূর্তে মাধবাচার্য্যের মতো নিষ্ঠুরও প্রকাশ করে ফেলেন তাঁর চরিত্রে নিহিত ধূসরতা। এক দিকে বলিষ্ঠ বক্তব্য, অন্য দিকে ধূসরতার সন্ধান এই দু’টিকে মেলানো মোটেই সহজ কর্ম নয়। ‘নটীর পূজা’ তা করেছে। দু’-একটি আলতো কথা মনে আসে অবশ্য। নাটকের গোড়ায়, একটু অ-দীক্ষিত দর্শকদের জন্য কি কাহিনির একটা আদল ধরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিল? রাজা অজাতশত্রু প্রায় অন্তিমপর্বে সশরীরে মঞ্চে আসেন, যদিও আগে তাঁর নামোল্লেখ হয় একাধিক বার। একটু খটকাই লাগে, রাজার যে রূপটি দেখা গেল, তার পূর্বাভাস কি সে ভাবে পাওয়া গিয়েছিল মঞ্চে? তিনি যে শুধুই মাধবাচার্য্যের ক্রীড়নক নন, সেই ইশারা কি সে ভাবে ছিল আগে? এবং, ‘আর রেখো না আঁধারে’র অন্তিম চরণ ‘যে মোর আলো লুকিয়ে আছে রাতের পারে আমায় দেখতে দাও’ কি আসতে পারত না শ্রীমতীর কণ্ঠে। তিনি তো একসময় জানিয়েই দেন, অন্য কোনও অবলম্বন নয়, নিজেই নিজের আশ্রয় হওয়াই শ্রেষ্ঠতম পন্থা।
নাটকের শেষে শ্রীমতী যখন একা বসে থাকেন, কঙ্কালসার গান্ধার বুদ্ধের আদলে নির্মিত বেদি আঁকড়ে স্তব্ধ, রোগা একটি আলো এসে পড়ে তাঁর শরীরে, প্রায় সবাই তাঁকে জেনেশুনে তবু ভুলে থাকে, অথচ প্রতিবাদ যে ফুরোয় না, তারও আভাস থাকে অন্য একটি নিঃসঙ্গ আর্তরবে ঠিক তখনই এই নাটক বাস্তবের সীমানা ছাড়িয়ে উড়াল দেয় অনন্তের দিকে।
ইরম শর্মিলা চানুর প্রতিবাদেও যে অনন্তের স্পর্শ আছে, তা আমরা প্রায়শই বিস্মৃত হই।
একটি শিল্পিত কশাঘাতে ‘স্বপ্নসন্ধানী’ তা আর এক বার মনে করিয়ে দিল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.