সালকিয়া উড়ালপুল
পাথর নড়ার আশা
পাথর কি শেষমেশ নড়বে?
সালকিয়া উড়ালপুল নিয়ে প্রশাসনিক তৎপরতা দেখে হাওড়াবাসীর কাছে এখন এটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।
হাওড়া উন্নয়ন সংস্থার (এইচআইটি) দাবি, এই প্রকল্প ঘিরে দীর্ঘ দিনের সমস্যার জট কেটে গিয়েছে। এখন শুধুই কাজ শুরুর অপেক্ষা। অর্থ সংস্থানের জন্য রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দফতরের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে এইচআইটি সূত্রে বলা হয়েছে। সংস্থার দাবি, খুব শীঘ্রই এই সমস্যা মিটবে। এ ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে রাজ্য সরকারও।
এইচআইটি সূত্রের খবর, ২০০৭ সালে এই প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিল ৩০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর পরে সেই খরচ এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ কোটি টাকায়। সংস্থার এক কর্তা জানান, ২০০৭-এ সংস্থার তৎকালীন চেয়ারম্যান স্বদেশ চক্রবর্তী হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্স-এর (এইচআরবিসি) থেকে ১৫ কোটি ও রাজ্য পরিবহণ দফতর থেকে ১৫ কোটি টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এইচআরবিসি থেকে ১৫ কোটি টাকা পাওয়াও গিয়েছিল। সেই টাকা পুনর্বাসন ও জমি কেনার জন্য জেলা প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু উড়ালপুলকে কেন্দ্র করে জমিজট, পুনর্বাসন-সহ বিভিন্ন সমস্যা থাকায় কাজ শুরু হয়নি।
এইচআইটি’র চিফ ইঞ্জিনিয়ার মৃণ্ময় চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এখন পর্যায়ক্রমে টাকার যোগান নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। আমরা পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর, পরিবহণ দফতর-সহ এইচআরবিসি-কেও অর্থের জন্য চিঠি দিয়েছি। পাশাপাশি, কেএমডিএ-র সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। টাকা পেলেই পুনর্বাসন থেকে শুরু করে উড়ালপুল, সবেরই কাজ শুরু করা যাবে। ১৮ মাসেই কাজটি শেষ হয়ে যাবে।”
পড়ে আছে বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য তৈরি ফ্ল্যাট।
যদিও রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “কোনও চিঠি এখনও হাতে পাইনি। এইচআইটি পুরো প্রকল্প রিপোর্ট তৈরি করে আমার সঙ্গে দেখা করুক। তা হলে বোঝা যাবে কত খরচ হবে বা কোথা থেকে সেই টাকার যোগান আসবে। তবে কোনও ভাবেই এই প্রকল্পটি আর ধামাচাপা পড়তে দেওয়া যাবে না।” একই অভিমত পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রেরও। তিনি বলেন, “পরিবহণ দফতর থেকে সমস্ত রকম সাহায্যই পাওয়া যাবে। কিন্তু কাজটা শুরু হোক।”
উত্তর হাওড়ার যানজট কমাতে ১৯৯০ সালে হাওড়া পুরসভা সালকিয়া উড়ালপুল তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। কাজের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন নিয়ে ২২৭ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে পুর কর্তৃপক্ষের টালবাহানা শুরু হয়। ব্যবসায়ীরা কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও করেন। সালকিয়া বিজনেসমেন’স অ্যাসোসিয়েশনের তরফে জানা গিয়েছে, তাঁরা দাবি করেছিলেন, এমন জায়গায় পুর্নবাসন দিতে হবে যেখানে ব্যবসা চলবে। কিন্তু এর পরে হাওড়া পুরসভা থেকে উড়ালপুলের দায়িত্ব পুরোপুরি এইচআইটি-র হাতে গেলেও সমস্যা মেটেনি। কেননা, এইচআইটি ঢোলগোবিন্দ সিংহ লেনে যে বিকল্প জমি দেখিয়েছিল তা ব্যবসায়ীদের কাছে অনুপোযোগী বলে মনে হয়।
এর পরে এইচআইটি-র সঙ্গে ফের বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ১৯৯৯-তে সুপ্রিম কোর্টে এইচআইটি’র বিরুদ্ধে মামলা করেন। সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দেয়, ব্যবসায়ীদের সীতানাথ বোস লেন থেকে শ্রীরাম ঢ্যাং রোডের মধ্যে জিটি রোডের ধারেই পুনর্বাসন দিতে হবে। শুধু গ্যারাজ, কারখানা, পেট্রোল পাম্প সেই সুবিধা পাবে না। পাশাপাশি, পুনর্বাসন নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। ব্যবসায়ীরা জিটি রোডের ধারে যে জমি পছন্দ করবেন সেখানেই এইচআইটি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পরেই পুরো প্রকল্পটি ধামাচাপা পড়ে যায়। পাশাপাশি, বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য সীতানাথ বোস লেনে তৈরি ৬৪টি ফ্ল্যাটও বেহাল হয়ে যায়। ঢোলগোবিন্দ সিংহ লেনে যে ৪০টি অস্থায়ী দোকান বানানো হয়েছিল সেগুলিও বেহাল হয়ে পড়ে।
এখানে পুনর্বাসনে রাজি হয়নি স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন।
এইচআইটি সূত্রে খবর, এই প্রকল্পের জন্য মোট প্রয়োজনীয় ২৬০ কাঠা জমির পুরোটা সম্প্রতি পাওয়া গিয়েছে। যাঁদের জমি নেওয়া হচ্ছে তাঁরাও ক্ষতিপূরণ পেয়ে গিয়েছেন। ৬৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে এই মুহূর্তে কটি ফ্ল্যাট কোন কোন পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য দেওয়া যাবে, সম্প্রতি একটি বৈঠকে সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়েছে। সীতানাথ বোস লেন থেকে শ্রীরাম ঢ্যাং রোড পর্যন্ত জিটি রোডের ধারে চারটি জমি ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য চিহ্নিতও করা হয়েছে। ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষে অসীমকুমার দাস বলেন, “মামলা-মোকদ্দমা মিটে গিয়েছে। নতুন চারটি জায়গা আমরাই চিহ্নিত করে দিয়েছি। সেখানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেই চলে যাব।” উত্তর হাওড়ার তৃণমূল বিধায়ক অশোক ঘোষ বলেন, “টাকার জন্য কোনও কাজ আটকাবে না। পুর, পরিবহণ দুই দফতরের মন্ত্রীই আশ্বাস দিয়েছেন, টাকার অসুবিধা হবে না। এত দিন প্রকল্পের ফাইল ঠান্ডা ঘরে পড়ে ছিল। এখন ব্যবসায়ী, এইচআইটি, সবার সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে সমস্যা মিটিয়েছি। কিন্তু এইচআইটি কেন যে এত ঢিমেতালে সব কিছু করছে বোঝা যাচ্ছে না।” ব্যবসায়ী সংগঠনের সম্পাদক বরুণ দে’র বক্তব্য: “সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশ যদি ফের এইচআইটি না মানে তা হলে আমাদের আবার মামলা-মোকদ্দমায় যেতে হবে। টাকার অসুবিধা থাকলে পিপিপি মডেলেও ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে রাজি আছি। কেননা উড়ালপুল তৈরির জটে আটকে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কোনও দোকানের ট্রেড লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ হচ্ছে না। আবার জমির মালিক এইচআইটি হলেও তারা ভাড়াও নিচ্ছে না।”
এইচআইটি সূত্রে খবর, জিটি রোডের সমান্তরাল এই দুই লেনের উড়ালপুলটি হাওড়ার দিকে সীতানাথ বোস লেনের কাছ থেকে শুরু হয়ে সালকিয়া চৌরাস্তা পার করে শ্রীরাম ঢ্যাং লেনের কাছে গিয়ে ফের জিটি রোডে মিশবে। প্রায় ৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই উড়ালপুলটি ৮.৪ মিটার চওড়া হবে। এটি তৈরি হলে খুব সহজেই হাওড়া থেকে লিলুয়া ও বালির দিকে যাতায়াত করা যাবে। উড়ালপুল তৈরির সময় জিটি রোড বন্ধ রাখতে হবে না বলেই মনে করেন এইচআইটি’র কর্তারা। তাঁদের কথায়, উড়ালপুল তৈরির জন্য সীতানাথ বোস লেনের দিক থেকে শ্রীরাম ঢ্যাং রোড পর্যন্ত বেশির ভাগই ভাঙতে হবে রাস্তার বাঁ দিকের অংশ। তাই ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের পুনর্বাসন হয়ে গেলে ওই অংশে রাস্তা তৈরি করা হবে। তার পাশের অংশে, অর্থাৎ এখন যেটি জিটি রোড সেখানে উড়ালপুলের কাজ শুরু হবে। ফলে তৈরি হওয়া ওই নতুন রাস্তা দিয়েই যানবাহন যাতায়াত করতে পারবে।

ছবি: রাজীব বসু




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.