বিজ্ঞান শিক্ষিকার ব্যবহারে বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হইয়া চেন্নাইয়ের স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত লইয়াছিল, বদলা লইবার জন্য শিক্ষিকাকে হত্যা করিতেও দ্বিধা করে নাই। ছেলেটি পড়াশোনা করিতেছে না, পাঠে মনোযোগ হারাইতেছে, ইত্যাদি অভিযোগ করিয়াছিলেন শিক্ষিকা। ফল এই হত্যা। অভিযোগের শাস্তি মৃত্যু। চেন্নাইয়ের বিদ্যালয়ের এই ঘটনাটি মর্মান্তিক, সন্দেহ নাই। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠিতেছে, তাহা হইলে শিক্ষক ও অভিভাবকেরা কী করিবেন? তাঁহারা কি ছাত্রছাত্রী ও সন্তানদের কোনও প্রকার শাসন করিতেই পারিবেন না? চোখের সামনে কোনও ভুল করিতে দেখিলেও অনুজদের কিছু বলা যাইবে না? তবে তো স্বেচ্ছাচার ও নৈরাজ্যই মুখ্য হইয়া উঠিবে! তাহা হইলে উপায়? অপর দিকে কেন পড়ুয়ারা এমন প্রতিহিংসাপরায়ণ ও মারমুখী হইয়া উঠিতেছে তাহা লইয়াও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের শেষ নাই টেলিভিশনে ও চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত হিংস্রতা, সমাজ-বিচ্ছিন্ন পারমাণবিক পরিবারের নিঃসঙ্গতা, বাবা-মায়ের মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ, নানা কারণ নানা দিক হইতে শিশু ও কিশোরদের এইরূপ সহনক্ষমতাশূন্য, মারমুখী করিয়া তুলিতেছে। এই সকল কথা ও আশঙ্কা স্বাভাবিক। অযৌক্তিকও নয়। তবে বিষয়টি অপর একটি দিক দিয়া ভাবা যাইতে পারে। একটি প্রশ্ন তোলা যাইতে পারে। কোথাও কি ‘সংযোগ’-এর অভাব ঘটিতেছে?
চেন্নাইয়ের যে শিক্ষিকা ছাত্রটিকে সাবধান করিয়াছিলেন, অভিভাবকদের নিকট অভিযোগ করিয়াছিলেন, তিনি পড়ুয়াটির হিতাকাঙ্ক্ষীই ছিলেন। কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্যে যাহা বলিয়াছিলেন তাহা পড়ুয়াটির কাছে ঠিক মতো পৌঁছায় নাই, ফলে এই বিপত্তি। অর্থাৎ কথা বলিলেই হইবে না, যাহাকে বলিতেছি তাহার নিকট কথাটি ঠিক মতো উপনীত হইতেছে কি না তাহা বিচার করিয়া দেখিতে হইবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বড়রা কথা বলিয়াই খালাস, জ্ঞান দিয়াই দায় মিটাইতে ব্যগ্র, কথা ঠিক মতো পৌঁছাইল কি না, তাহা খেয়াল করিবার সময় ও মন তাঁহাদের থাকে না। তাঁহারা শ্রেণিগত ভাবে উপরে রহিয়াছেন আর ছাত্র বা সন্তান নীচে ইহা ভাবিতে অভ্যস্ত বলিয়া কাজের কথাও ব্যর্থ হয়। যদি কথা শুনাইতে হয় তাহা হইলে সর্বাগ্রে সমান তলে দাঁড়াইয়া কথা বলিতে হইবে। যাহাকে বলিতেছি তাহার মনের কাছে যাইতে হইবে। এই কাছে যাইতে না পারিলে কথার কথায় কিছু হইবে না। প্রশ্ন হইল, কাছে যাইবার উপায় কী? প্রসঙ্গত, উনিশ শতকীয় একটি রচনায় পুত্র অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁহার পিতা সম্বন্ধে এ কথা বলিয়াছিলেন। কথাটি হইল সাহচর্য শিক্ষা। পিতা গঙ্গাচরণ পুত্র অক্ষয়চন্দ্রকে সাহচর্য শিক্ষা প্রদান করিয়াছিলেন। যাহাকে আমরা কথা শুনাইতে চাই, শাসন করিতে চাই, তাহাকে যথার্থ সাহচর্য প্রদান করিতে হইবে। ইহা হইলেই কথা আর বাহিরের কথা থাকিবে না, শুনিবার মতো ভিতরের কথা হইয়া উঠিবে।
সাহচর্য দান ও যাহাকে কথা শুনাইতে চাই তাহার মনের নিকটে গিয়া তাহার মতো করিয়া কথা বলা, কোনওটাই খুব সহজ কাজ নহে। ইহার জন্য বিশেষ মন-মানসিকতা আবশ্যক। তদুপরি কাজটি অনুশীলনসাপেক্ষ। কথার মাধ্যমে যোগাযোগ সাধনের পারঙ্গমতা অর্জন করিতে হয়, এক দিনে তাহা হইবার নহে। তাই শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতন হইতে হইবে। পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে দোষ দিবার দরকার নাই, দোষ দিয়া লাভও নাই। কথা বলিবার মন ও কলাটি রপ্ত করিলে অবস্থার উন্নতি হইতে পারে। কাজেই গুরুগিরি ছাড়িয়া সমতলে নামিয়া আসিয়া সহচর হইবার প্রয়াস আবশ্যক। ইহা শিল্প সৃষ্টির ন্যায় কঠিন। রীতিমত কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নহে। |