মলদ্বীপ সঙ্কটে। ত্রিশ বছরের স্বৈরশাসক মাউমুন আবদুল গায়ুমকে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পরাজিত করিয়া যিনি এই দ্বীপপুঞ্জে গণতান্ত্রিক সংবিধান ও শাসনপ্রণালী কায়েম করিয়াছিলেন, সেই মহম্মদ নাসিদ এক ‘অভ্যুত্থান’-এ অপসারিত হইয়াছেন। প্রেসিডেন্ট পদ হইতে তিনি নিজে ইস্তফা দিলেও নাসিদ জানাইয়াছেন, স্বেচ্ছায় তিনি এ কাজ করেন নাই, সেনা-অফিসাররা তাঁহাকে ইহা করিতে বাধ্য করিয়াছে। বস্তুত, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একাংশ গদিচ্যুত স্বৈরাচারী গায়ুম প্ররোচিত প্রতিবাদ-আন্দোলনের সমর্থনে আগাইয়া আসে। তখন গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা ও রক্তপাতের সম্ভাবনা রোধ করিতেই নাসিদ প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দেন। কিন্তু তাঁহার বিরোধীরাই যে এই সুযোগে রাষ্ট্রক্ষমতার দখল লইয়াছে, তাহার প্রমাণ নাসিদের বিরুদ্ধে জারি হওয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং রাস্তায় নামিয়া তাঁহার প্রতিবাদের সময় ক্রুদ্ধ পুলিশের হাতে তাঁহার নিগ্রহ। চব্বিশ ঘণ্টা আগেও যিনি দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন, রাজধানী মালের পুলিশ তাঁহার উপর যখন কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটায়, তখন সন্দেহ হয়, গণতন্ত্র-বিরোধীরা প্রেসিডেন্ট নাসিদের প্রশাসনেই লুকাইয়া ছিল।
বস্তুত, দেশের পার্লামেন্টেও গরিষ্ঠসংখ্যক সদস্য গায়ুমের সমর্থক এবং নাসিদের দলের বিরোধীই ছিলেন। নাসিদ সম্ভবত এ জন্যই আশু নির্বাচন দাবি করিয়াছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদে তাঁহার স্থলাভিষিক্ত মহম্মদ ওয়াহিদ সে দাবি উড়াইয়া দিয়াছেন। পদে বসিয়াই তিনি যে সদ্য-প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের প্রতি খড়্গহস্ত হইয়াছেন, সেটাও সুলক্ষণ নয়। এই অবস্থায় নূতন প্রেসিডেন্টের প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের তড়িঘড়ি শুভেচ্ছা ও সমর্থনের বার্তা পাঠানোটা বিচক্ষণতার কাজ হয় নাই। মলদ্বীপ ভারত মহাসাগরের বারোশো দ্বীপ লইয়া গঠিত এমন একটি রাষ্ট্র, ক্ষুদ্র হইলেও যাহার রণনৈতিক তাৎপর্য অপরিসীম। এই দ্বীপরাষ্ট্রেই ১৯৮৮ সালে শ্রীলঙ্কার একটি জঙ্গি গোষ্ঠীর সামরিক অভ্যুত্থানের অপচেষ্টা বানচাল করিতে ভারতীয় নৌবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করিতে হইয়াছিল। ত্রিশ হাজার ভারতীয় এই দ্বীপপুঞ্জে বসবাস করে। ইহার নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতি ও অর্থনৈতিক বিকাশে নয়াদিল্লির স্বার্থ আছে। সেখানে একটা অনিশ্চিত গোলমালের পরিস্থিতিতে আগ বাড়াইয়া কোনও একটি রাজনৈতিক পক্ষকে প্রকাশ্যে সমর্থন করিয়া বসা বিজ্ঞ কূটনীতি নয়।
ত্রিশ বছর ধরিয়া মলদ্বীপে স্বৈরশাসন চালানো গায়ুম প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলির সঙ্গে আপস করিয়া ক্ষমতায় ফিরিবার তাল করিতেছেন। গোঁড়া ইসলামপন্থীরা ক্রমশ মলদ্বীপে মাথা-চাড়া দিতেছে এবং শরিয়ত অনুযায়ী দেশের বিচারব্যবস্থাকে ঢালিয়া সাজিতে চাপ সৃষ্টি করিতেছে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নাসিদকে তাহারা ‘ইসলাম-বিরোধী’ আখ্যাও দিয়াছে। এই শক্তিগুলির সহিত যদি গায়ুমের সমর্থকরা জোটবদ্ধ হয়, তবে মলদ্বীপে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হইতে বাধ্য। নয়াদিল্লির উচিত ছিল সমগ্র পরিস্থিতি খতাইয়া দেখিয়া সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া জানানো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত-বার্তা তেমন সুচিন্তিত কূটনীতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। ইতিপূর্বে শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দেখা গিয়াছে, সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনাবশ্যক রকম দীর্ঘসূত্রিতায় ভুগিতেছে। মায়ানমারের ক্ষেত্রেও সরকারের একই রকম দ্বিধা, দোদুল্যমানতা ও সিদ্ধান্তহীনতার পরিচয় মিলিয়াছে। মলদ্বীপের বেলায় আবার বিপরীত চিত্র। ভাল করিয়া পরিস্থিতি বিচার না করিয়াই সেখানকার অস্থির পট-পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া জানাইয়া দেওয়া হইল। এখন সামাল দিবার চেষ্টা চলিবে। |