শুধু সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট তৈরি করা, নতুন যন্ত্র কেনা বা ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানোটাই যথেষ্ট নয়। কিশোরী মায়ের সংখ্যা না-কমালে যে প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুতে রাশ টানা অসম্ভব, তা বুঝে এ বার জেলা হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিনের চিকিৎসকদের প্রচারে নামানোর সিদ্ধান্ত নিল স্বাস্থ্য দফতর। সম্প্রতি যে জেলাটি শিশু মৃত্যুর জেরে জর্জরিত, সেই মালদহেই প্রথম কাজ শুরু হচ্ছে। ক্যাম্প করে, এলাকায় ঘুরে ডাক্তারেরা মানুষকে বোঝাবেন, কেন অল্প বয়সে মা হলে মা ও সন্তানের জীবনের ঝুঁকি থেকে যায়।
মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, “পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অন্তত ৪০% ক্ষেত্রে এখানকার মায়েরা কৈশোর পার করেননি। গরিবঘরের মেয়েরা এমনিতেই দু’বেলা পেট ভরে খেতে পান না। তার উপরে এত অল্প বয়সে সন্তানধারণের জন্য তাঁদের শরীর প্রস্তুত থাকে না। হাসপাতালের ডাক্তার এবং জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য-আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে প্রচারের বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি হবে।”
তবে সরকারি তরফে যতই চেক-আপের ব্যবস্থা থাকুক কিংবা আয়রন ট্যাবলেট বিলি হোক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়েছে, কম বয়সে মা হলে অপরিণত সন্তান জন্মানোর ঝুঁকি ৪০% থেকে ৪৫%। বিশেষজ্ঞেরাও মেনে নিচ্ছেন, কৈশোর-মাতৃত্ব কমাতে না-পারলে প্রসূতি মৃত্যু বা শিশু মৃত্যু কোনওটাই কমবে না। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্য প্রকল্প-অধিকর্তা দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, “বহু ক্ষেত্রে লাগাতার প্রচারে ফল মিলেছে। এ ক্ষেত্রেও পরিবারের বড়দের যদি অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ের কুফল বোঝানো যায়, তা হলে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসবেই। সমস্যার উৎস কিন্তু এটাই।” |
রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীও শিশুমৃত্যু ঠেকাতে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে ঠেকানোয় জোর দিয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁরা নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করবেন। নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র জানাচ্ছেন, অঙ্গনওয়ারি কর্মীরাও বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষকে সচেতন করবেন। এ জন্য তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রীর কথায়, “পঞ্চায়েতকেও যুক্ত করার চেষ্টা চলছে। কেউ নাবালিকার বিয়ে রুখলে তাঁকে পুরস্কৃত করার ভাবনাও রয়েছে।”
ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে-র রিপোর্ট মোতাবেক, নাবালিকা-বিবাহের সংখ্যাগত বিচারে দেশে পশ্চিমবঙ্গ সপ্তম স্থানে। এ রাজ্যে বিয়ে করতে বসা মেয়েদের ৫৩.৯ শতাংশের বয়স আঠারোর কম। ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে এখনও প্রতি দু’জন মেয়ের এক জনের বিয়ে হয় নাবালিকা অবস্থায়। এবং তাঁদের ৭% পনেরো বছর বয়স না-হতেই মা হয়। আঠারোর আগে সন্তানধারণ করেন ৩৪.৮%। আর ৫০% মেয়ে উনিশের আগে জননী হচ্ছেন।
চিকিৎসকদের মতে, অল্প বয়সে সন্তানধারণ করলে মা ও শিশু উভয়েরই ক্ষতির আশঙ্কা খুব বেশি। কেন? স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক আরতি বসু সেনগুপ্তের ব্যাখ্যা, বলেন, “এই সময়ে জঠরাস্থি (পেলভিস) ঠিকমতো তৈরি থাকে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সময়ের আগে প্রসব হয়ে যায়। আর সময়ের আগে জন্মানো বাচ্চা অপুষ্ট হবেই।” শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষও জানিয়েছেন, সময়ের আগে প্রসব হলে বাচ্চার জীবনের ঝুঁকি অনেকটা বেড়ে যায়। তাঁর মন্তব্য, “মায়ের স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে তবেই আমরা সুস্থ সন্তানের আশা করতে পারি।” |