আমরি-কাণ্ডে ধৃত চিকিৎসক, তথা ওই হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মণি ছেত্রীর অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করল আলিপুর আদালত। ৯৩ বছরের মণিবাবু বর্তমানে এসএসকেএমের আইসিসিইউয়ে চিকিৎসাধীন। ২৭ জানুয়ারি কলকাতা গোয়েন্দা-পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করার পরে সে দিন তাঁর জামিন খারিজ করে দিয়েছিল আদালত। অসুস্থ বোধ করায় ওই দিন রাতেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আর বৃহস্পতিবার আলিপুরের বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট চৌধুরী হেফাজত করিম অসুস্থতার কারণেই মণিবাবুর অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করে ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ফের আদালতে হাজির করাতে বলেছেন। তবে আমরি-কাণ্ডে অভিযুক্ত ওই হাসপাতালের দুই কর্তা পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাজিদ হোসেন, এবং পরিচালন বোর্ডের অপর চিকিৎসক-সদস্য প্রণব দাশগুপ্তকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। মামলায় ধৃত আমরির অন্যান্য ডিরেক্টরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেল হেফাজত হয়েছে। এ দিন শুনানি শেষ হয়ে গিয়েছিল সন্ধে ছ’টায়। রায় ঘোষণা হয় রাত সাড়ে ন’টায়। মণিবাবুকে অবশ্য এ দিন আদালতে হাজির করানো হয়নি।
মণিবাবুর গ্রেফতারি নিয়ে রাজ্যের চিকিৎসক মহল দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসকদের একাংশ তাঁর জামিনের জন্য সরব হয়েছিলেন। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাও মণিবাবুকে পাহাড়ের ‘আইকন’ হিসেবে দেখিয়ে জামিনের আর্জি জানিয়েছিল। রাজ্য সরকার অবশ্য জানিয়ে দেয়, আইন আইনের পথেই চলবে। মণিবাবুর আইনজীবী সমরাদিত্য পাল এ দিন আদালতে তাঁর মক্কেলের অসুস্থতার প্রসঙ্গ তোলেন। বিচারক রায়ে বলেন, শর্তাধীনে মণিবাবুর জামিন মঞ্জুর হল। পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত তিনি আলিপুর আদালতের অন্তর্গত এলাকার বাইরে যেতে পারবেন না। তদন্তকারীদের সব রকম সাহায্য করতে হবে তাঁকে।
আমরি-র ডিরেক্টরদের মধ্যে রাধেশ্যাম অগ্রবাল আদালতের নির্দেশে এসএসকেএমে ভর্তি। অসুস্থতার যুক্তিতে বার বার তাঁর তরফে আলিপুর আদালতে দাখিল জামিনের আবেদন নাকচ হয়ে গিয়েছে। জামিন চেয়ে রাধেশ্যাম হাইকোর্টে গিয়েছেন। আর এক ডিরেক্টর রাধেশ্যাম গোয়েনকাও হাইকোর্টে জামিন চেয়েছেন। আমরি-র আরও তিন ডিরেক্টরপ্রশান্ত গোয়েনকা, মনীশ গোয়েনকা ও রবি তোদির জামিনের আর্জিও হাইকোর্টে গৃহীত হয়েছে। তাই এই পাঁচ জনের জামিনের আবেদন এ দিন আলিপুর আদালতে করা হয়নি। মণিবাবুর সঙ্গে এসকে তোদি, দয়ানন্দ অগ্রবাল, প্রণব দাশগুপ্ত, পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যব্রত উপাধ্যায়, সাজিদ হোসেন ও সঞ্জীব পালের আইনজীবীরা তাঁদের মক্কেলদের জন্য জামিনের আবেদন করেছিলেন।
মণিবাবু ছাড়া সকলেরই আর্জি খারিজ হয়েছে। সওয়ালের সময়ে মণিবাবুর আইনজীবী সমরাদিত্য পাল দাবি করেছিলেন, আমরি-র অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সময়ে তাঁর মক্কেল আদৌ ওই হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন না। তাঁর বক্তব্য, ২০১১-র মার্চের পরে আমরির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন মণিবাবু। পরে পরিচালন বোর্ডের কয়েকটি বৈঠকে উপস্থিত থাকলেও চিকিৎসা-পরিষেবা ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে তিনি আলোচনা করতেন না। তাই আমরি-কাণ্ডের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই বলে দাবি করে সমরাদিত্যবাবু বিচারককে বলেন, গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁর মক্কেলের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। মানসিক ভাবেও ভেঙে পড়েছেন। এস এস কেএমের মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্টে বলা হয়েছে, মণিবাবুর শারীরিক অবস্থা গুরুতর। তাঁর শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হচ্ছে, যা মস্তিকে পৌঁছালে প্রাণসংশয়ও হতে পারে। তাই তাঁকে অন্তর্বর্তী জামিন দিতে আদালতকে আবেদন করেছিলেন সমরাদিত্যবাবু।
আমরি-কাণ্ডে পুলিশি হেফাজতে থাকা চিকিৎসক প্রণব দাশগুপ্তের আইনজীবী তপেন রায়চৌধুরীও তাঁর মক্কেলের শারীরিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরির-অগ্নিকাণ্ডের পরে ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর প্রণববাবুর বালিগঞ্জ পার্কের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন তদন্তকারীরা। ওই বাড়ি থেকেই ২৭ জানুয়ারি তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তপেনবাবুর কথায়, “এতে বোঝা যায়, ওই সময়ের মধ্যে পালানোর চেষ্টা করেননি প্রণববাবু। তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগও নেই।” অন্যান্য আমরি-কর্তার আইনজীবীরাও দাবি করেন, অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে তাঁদের মক্কেলরা জড়িত ছিলেন না।
জামিনের বিরোধিতা করে সরকারি আইনজীবী শক্তি ভট্টাচার্য ও রাজদীপ মজুমদার বলেন, অভিযুক্তদের হেফাজতে রেখে জেরার প্রয়োজন। শক্তিবাবুর কথায়, “মণি ছেত্রী তদন্তকারীদের জানিয়েছিলেন, তিনি আমরি-র চিকিৎসা পরিষেবা সংক্রান্ত (হেলথ-কেয়ার) বিষয়টি দেখতেন। ওখানে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হতে যাওয়া কয়েক জন দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসা পরিষেবার দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেন না।” সন্ধের মুখে শুনানি শেষ হলেও বিচারক রাত নটা পর্যন্ত নির্দেশ ঘোষণা না-করায় কোর্ট লক আপে বন্দিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন মামলার অভিযুক্তদের জেল থেকে এক সঙ্গে আনা হয়। একই সঙ্গে ফেরতও নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এ দিন আমরি-মামলার নির্দেশ বিচারক না-দেওয়া পর্যন্ত বন্দিদের জেলে ফেরানো যায়নি। সকালে খেয়ে আসা বন্দিরা তাই ‘মানবাধিকার হরণের’ অভিযোগ তুলে চেঁচামেচি শুরু করেন। |