রাজ্য সরকার সম্প্রতি যে ক্লাবগুলিকে আর্থিক সাহায্য দিয়েছে, সেই তালিকায় কার্যত ‘বঞ্চিত’ মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর দিনাজপুর জেলা। ঘটনাচক্রে, ওই দুই জেলায় কংগ্রেসের ‘স্তম্ভ’ সাংসদ অধীর চৌধুরী এবং দীপা দাশমুন্সি। যাঁদের সঙ্গে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সম্পর্ক’ সুবিদিত। শাসক শিবিরের মতে, এই ঘটনা কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ‘বিতর্কে’ নতুন মাত্রা যোগ করল।
মুর্শিদাবাদে মাত্র একটি ক্লাব এবং উত্তর দিনাজপুরে ছ’টি ক্লাব ওই অনুদান পেয়েছে। মুর্শিদাবাদের ক্লাবটি কংগ্রেসের মহম্মদ সোহরাবের বিধানসভা এলাকা ভুক্ত হলেও উত্তর দিনাজপুরের ছ’টি ক্লাবই জেলার তৃণমূল বিধায়কের এলাকাভুক্ত। শাসক শিবিরের একাংশের বক্তব্য, অধীর-দীপার সঙ্গে তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রীর ‘সম্পর্কে’র কারণেই ওই দুই জেলার ক্লাবগুলি রাজ্য ক্রীড়া দফতরের অনুদান থেকে ‘বঞ্চিত’ হয়েছে।
ওই দুই জেলার সঙ্গে ‘দুয়োরানি’সুলভ আচরণের জন্য মুখ্যমন্ত্রীকেই দায়ী করে মুর্শিদাবাদের জেলা সভাপতি তথা বহরমপুরের সাংসদ অধীরবাবুর প্রতিক্রিয়া, “মুখ্যমন্ত্রী তো রাজ্যের সব ক’টা জেলারই মুখ্যমন্ত্রী। উনি যদি ভেবে থাকেন, মুর্শিদাবাদ বা উত্তর দিনাজপুর রাজ্যের বাইরের কোনও জেলা, তা হলে কী আর বলার থাকে! রাজনৈতিক রং না দেখে ক্লাবগুলিকে সরকার সাহায্য করলেই ভাল হত।”
রায়গঞ্জের সাংসদ দীপার বক্তব্য, “এই সরকার দলতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রের কথা মুখে বললেও দলন্ত্রই চলছে এখানে। উত্তর দিনাজপুরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ওই কাজ করা হয়েছে। বাম আমলেও এই জেলার ক্লাবগুলো সরকারি অনুদান পায়নি। এখনও সেটাই হচ্ছে।”
ওই দুই জেলা থেকে ক্লাবের নাম পাঠানোর জন্য সরকারের তরফে তাঁদের কিছু জানানো হয়নি বলে কংগ্রেস বিধায়কদের অভিযোগ। তাঁদের বক্তব্য কী পদ্ধতিতে এবং কোথায় ক্লাবের নাম পাঠাতে হবে, তা সরকারি ভাবে কোনও বিজ্ঞপ্তি বা চিঠি দিয়ে বিধায়কদের জানানো হয়নি।
বিধায়কদের এলাকা পিছু ছ’টি করে ক্লাবকে দু’লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়া হবে বলে মাস কয়েক আগে প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তার পর বিধায়কদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কাগজপত্র খতিয়ে দেখে ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। নাম পাঠানোর জন্য বিজ্ঞপ্তি যে জারি করা হয়নি, বৃহস্পতিবার তা স্বীকার করেও মদনবাবু বলেন, “সরকার অনুমোদিত স্বশাসিত স্পোর্টস কাউন্সিল এবং ক্রীড়া দফতরের বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন এই অনুদান দেওয়া হবে। ওই ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে চার হাজারেরও বেশি আবেদন জমা পড়ে। সেখান থেকেই সব কিছু খতিয়ে দেখে ক্লাব বাছা হয়েছে।” প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, যে সমস্ত বিধায়ক আবেদন করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের এলাকার ক্লাবগুলোর উন্নয়নের তাগিদে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা শুনে ‘স্বতঃপ্রণোদিত’ হয়েই তা করেছিলেন। এখন টাকা না-পেয়ে কংগ্রেস বিধায়করা এমন অভিযোগ তুলছেন।
সরকারের বক্তব্য ‘যুক্তিহীন’ বলে দাবি ওই দুই জেলার কংগ্রেস বিধায়কদের। তাঁদের অভিমত, সরকারি অনুদান পেতে গেলে সরকারের তরফে বিজ্ঞপ্তি বা চিঠি না-পেলে সচরাচর আবেদন করা যায় না। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের বিধায়ক মোহিত সেনগুপ্তর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার কথা কাগজে পড়েছিলাম। ক্রীড়া দফতর থেকে আমাদের কাছে চিঠি আসবে ভেবেছিলাম। আসেনি। সংবাদপত্রে খবর পড়ে বিধায়করা আবেদন করতে পারেন নাকি! তৃণমূলের বিধায়কদের আবেদন করার জন্য মৌখিক ভাবে বলা হয়েছিল শুনেছি।” কালিয়াগঞ্জের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী প্রমথনাথ রায়ের বক্তব্য, “কোন পর্যায়ের ক্লাবের নাম পাঠাতে হবে, কোথায় পাঠাতে হবে কিছুই জানতাম না। সরকারি ভাবে না-জানালে নাম পাঠাব কী করে!” কেন সব বিধায়কদের না-জানিয়ে এবং সরকারি বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ক্লাব বাছা হল, তা আজ, শুক্রবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ক্রীড়ামন্ত্রীর কাছে তিনি জানতে চাইবেন বলে প্রমথবাবু জানিয়েছেন।
জেলাওয়াড়ি অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাবের যে সরকারি তালিকা আনন্দবাজারের কাছে রয়েছে, তা বলছে, উত্তর দিনাজপুরে অনুদানপ্রাপ্ত ছ’টি ক্লাবই তৃণমূল বিধায়ক অমল আচার্যের বিধানসভা এলাকা ইটাহারের। মুর্শিদাবাদের অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাবটি কংগ্রেস বিধায়ক মহম্মদ সোহরাবের জঙ্গিপুর বিধানসভা এলাকার হলেও সরকারি তালিকায় সেটিকে মালদহ জেলার ক্লাব হিসেবে দেখানো হয়েছে। যা নিয়েও ‘ক্ষুব্ধ’ মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস নেতৃত্ব। আর সোহরাব বলেন, “ক্লাবের নাম পাঠানোর জন্য সরকারের তরফে কিছুই জানানো হয়নি। আমার এলাকার যে ক্লাবটির নাম রয়েছে, তার হালহকিকৎ জানি না। আমার নাম করে হয়তো অন্য কেউ নাম পাঠিয়েছেন।”
তবে মুর্শিদাবাদের একমাত্র তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত সাহার বিধানসভা কেন্দ্র সাগরদিঘিরও কোনও ক্লাবও ওই তালিকায় নেই। মন্ত্রী অবশ্য বলেন, “ক্লাবগুলোর রেজিস্ট্রেশন ছিল না। তাই কাগজপত্র তৈরি করে চারটে ক্লাবের নাম পাঠাতে অনেক দেরি হয়েছিল। তাই তারা টাকা পায়নি। হয়তো পরে পাবে।”
ক্রীড়ামন্ত্রীর অবশ্য দাবি, “কোনও রাজনৈতিক রং না-দেখেই ক্লাবগুলিকে টাকা দেওয়া হয়েছে। ক্লাবের নামে তো কোথাও তৃণমূল, কংগ্রেস বা সিপিএম লেখা নেই!” দেখার, মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁকে কংগ্রেসের মন্ত্রী প্রশ্ন করলে ক্রীড়ামন্ত্রী কী জবাব দেন। এবং কোন নজরে বিষয়টি দেখেন রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্ব। |