সরকারি কর্মচারীরা কারখানার শ্রমিক নন, অতএব তাঁদের ট্রেড ইউনিয়ন করার প্রশ্ন ওঠে না বলে বৃহস্পতিবার সওয়াল করলেন রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু।
সরকারি কর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্য জুড়ে যখন চাপানউতোর শুরু হয়েছে, শিল্পমহলের স্বাগতবার্তার পাশাপাশি প্রতিবাদে মুখর হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, তখন নিজের অবস্থানে অনড় থাকার কথা আরও এক বার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন শ্রমমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “মহাকরণ কারখানার গেট নয়। আর অধিকাংশ সরকারি কর্মীরা কায়িক পরিশ্রম করেন না। যে সব সরকারি অফিসে উৎপাদনমূলক কাজ হয়, সেখানে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অন্যত্র নয়।”
কিন্তু সরকারের এই নতুন ঘোষণার বিরুদ্ধে তো কর্মীরা ইতিমধ্যে বিক্ষোভ-মিছিল করতে শুরু করেছেন? জবাবে পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, “অনুমতি না নিয়ে মিটিং-মিছিল করা ঠিক নয়।” তবে কি সরকার কোনও ব্যবস্থা নেবে? সরাসরি উত্তর এড়িয়ে মন্ত্রীর জবাব, “যথা সময়, যথোপযুক্ত জায়গায় এই কথা পৌঁছে দেবে।”
|
পূর্ণেন্দু বসু |
এ দিনই দুপুরে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় এবং অবসরপ্রাপ্তদের পুনর্নিয়োগ বন্ধ করার দাবিতে মহাকরণের ভিতরে মিছিল করে অ-বাম কর্মী সংগঠন নবপর্যায়। সরকারি ঘোষণার বিরুদ্ধে এ দিন বিকাশ ভবনে মিটিং করেছে তৃণমূল সমর্থিত স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশনও। তবে নতুন সরকারের সিদ্ধান্তকে ইতিমধ্যেই স্বাগত জানিয়েছে শিল্পমহল। এর ফলে রাজ্যে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে বলে আশা শিল্প ও বণিক মহলের। যা দেখে মহাকরণে নবপর্যায়ের সাধারণ সম্পাদক সমীররঞ্জন মজুমদারের মন্তব্য, “শিল্পমহলকে খুশি করতে সরকার এই সব করছে। অথচ এরাই কয়েক মাস আগে টাটাকে তাড়ানোর জন্য আন্দোলন করেছিল। এখন সরকারে এসে উল্টো, জনবিরোধী কথা বলছে।”
ট্রেড ইউনিয়নের নামে কাজের সময় নষ্ট করে বন্ধ-মিটিং-মিছিল করে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানোর শুরু ছয়ের দশকে যুক্তফ্রন্টের আমল থেকে। ১৯৮১ সালে সরকারি কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দিয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। দিন কয়েক আগে সেই ‘ধারাবাহিকতায়’ ছেদ টানার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
শ্রমমন্ত্রী এ দিন ফের অভিযোগ করেন, বিগত সরকার দলতন্ত্র চালানোর জন্য কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দিয়েছিল। ইউনিয়নগুলির অঙ্গুলি হেলনে কর্মীদের বদলি, পদোন্নতি নিয়ন্ত্রিত হত। ট্রেড ইউনিয়নের নামে বেলা দু’টো-আড়াইটেয় বেরিয়ে যাওয়া, শক্তি জাহির করা, কাজ না-করার অজুহাত খোঁজা হত। এই মৌরসিপাট্টা ভেঙে দিতে চায় সরকার। পূর্ণেন্দুবাবুর কথায়, “ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা দিলেই গণতন্ত্র হবে, তা নয়। বরং এর মাধ্যমে শুধুই দলীয় আধিপত্য কায়েম হয়েছে এবং তা থেকে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে।” পূর্ণেন্দুবাবুর মতে, “সরকারি কর্মীদের একটি ইউনিয়ন থাকলেই ভাল হয়।” যদিও সেটা কতটা সম্ভব তা নিয়ে নিজেই সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
পূর্ণেন্দুবাবু এ দিন জানান, বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। ওঁরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। পার্থবাবু পরে বলেন, “কর্মীদের অধিকার কোথাও খর্ব করা হচ্ছে না। তাঁদের অভাব অভিযোগ নিশ্চয় শোনা হবে। অ্যাসোসিয়েশনের ক্ষেত্রে আইনত যে বিধান রয়েছে, তা অবশ্যই সরকার দেখবে।”
সরকারি ঘোষণার বিরুদ্ধে ধর্মতলায় এক সভায় এ দিন সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, “ট্রেড ইউনিয়ন করা সরকারি কর্মীদের অর্জিত অধিকার। তা অর্জন করা কঠিন। কিন্তু জোর করে কেড়ে নেওয়া আরও কঠিন। সেই চেষ্টা হলে তার ফল হবে সাংঘাতিক। গোটা রাজ্য অচল হয়ে যাবে।” সরকারি কর্মীরা রাজ্য সরকারের ‘হৃৎপিণ্ড’ বলে মন্তব্য করে শ্যামলবাবু বলেন, “যদি সেই হৃৎপিণ্ড নিয়ে কেউ নাড়াচাড়া করেন, তা হলে সরকারি অফিসে ধুলো ঝাড়ার লোক পাওয়া যাবে না।” শ্যামলবাবুর মতে, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থাকলেই যে কথায় কথায় সরকারি কর্মীরা ধর্মঘট করবেন, তা নয়। তিনি বলেন, “বামফ্রন্টের আমলে সরকারি হাসপাতালে বামেদের বড় সংগঠন ছিল। কিন্তু তাঁরা কখনও কাজ বন্ধ করে আন্দোলন করেননি।”
সরকারি অবস্থানের প্রতিবাদে এ দিন দুপুর দেড়টা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা সল্টলেকে বিকাশ ভবনের ভিতরে মিটিং করে তৃণমূল সমর্থিত স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশনও। সংগঠনের সভাপতি মনোজ চক্রবর্তীর দাবি, “এই সময় কর্মীদের মধ্যে জনমত তৈরি করতে হবে। না হলে বামপন্থী সংগঠনগুলি তার সুযোগ নেবে।” তৃণমূল সংগঠনের মিটিংয়ের কথা শুনে ক্ষুব্ধ হন শিল্পমন্ত্রী। নগরায়ন ভবনে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি বলেন, “বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ এই নিয়ে সরকারের কাছে অভিযোগ জানালে তা খতিয়ে দেখা হবে। সরকারি কাজ বন্ধ করে মিটিং-মিছিল করা কখনও বরদাস্ত করা হবে না।” মনোজবাবু অবশ্য বলেন, “আমরা টিফিনের সময় মিটিং করেছি।”
সরকারের নতুন ঘোষণার কথা জেনে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সেই প্রস্তাবে সায় নেই শ্রমমন্ত্রীর। তিনি বলেন, “আমি ওঁদের সঙ্গে আলোচনা করব কেন? প্রয়োজন হলে সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করব।” |