|
|
|
|
|
বড়রাই বরং ভাবুন,
ছেলেমেয়েরা কেন এমন করে
নীলাঞ্জনা সান্যাল |
|
শিশু-মনস্তত্ত্বের আঙ্গিকে বয়স-সন্ধি বা তার প্রাক্কালীন সময় শরীর ও মনকে উদ্বেলিত করা অজস্র অজানা, অচেনা ইচ্ছে বা চাহিদার আধার। কী চাইছি, কেন চাইছি এর সদুত্তর মেলা দুষ্কর। তাই এই সময়ের কিশোর-কিশোরীদের ব্যবহারে এমন কিছু বিষয় লক্ষ করা যায়, যা ওদের কাছ থেকে অনেক সময়েই অপ্রত্যাশিত মনে হয়। কিন্তু প্রত্যাশার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে কেন, তা যে বড়দেরই লক্ষ করার বিষয়! ছুটন্ত জীবনের চৌহদ্দিতে আজকের দিনে আমাদের সে সময় বা মন থাকছে কি? বোধহয় না। তা না-হলে এত কিশোর-কিশোরীর আত্মহনন, অসামাজিক ব্যবহার, অশালীন আচরণ মাত্রায় বোধহয় বাড়ত না।
হারিয়ে গেল আরও দু’জন কিশোর-কিশোরী, সাজিরহাটের জনবসতিতে। চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে এক সঙ্গে লাফিয়ে পড়ে তারা। কিশোরী মৃত, কিশোর নিভে আসা প্রাণ নিয়ে লড়াই করছে। ওরা জানিয়েছে, ওরা প্রেমে আবদ্ধ ছিল। কিন্তু এতে ওদের বাবা-মায়েদের প্রচণ্ড আপত্তি ওঠে। কিশোর বয়সের এই সময়টায় প্রেমের ইশারা, ঘনিষ্ঠতার হাতছানি স্বাভাবিক নিয়মেই জীবনের রাস্তা ধরে আসে। কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুনিশ্চিত ঘেরাটোপ ওদের মন দিতে বলে পড়াশোনা, খেলাধুলো বা অন্য সৃজনশীলতায়।
সদ্য বড় হয়ে ওঠার সন্ধিক্ষণে নতুন সম্পর্ক স্থাপনের যে ইচ্ছে, তা কিছুটা দমিয়ে রাখা যায় ভবিষ্যতে পাওনার সুবিধায়। যে কিশোর তা করতে পারে না, যে কিশোরী বাড়ির বাইরে আর কারও সঙ্গ মনপ্রাণ দিয়ে কামনা করে, তারা কি এক ধরনের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বের অন্ধকারে বিরাজ করে না? মা-বাবা যেখানে সন্তানকে বোঝেন, সময়ে-অসময়ে অনেক কিছু বোঝান, মন দিয়ে সন্তানকে ঘিরে থাকেন, সেখানে কিন্তু অসময়ের এই একাকিত্ব বা আবেগের উদ্বেল অবস্থার মতো দুর্বলতা প্রত্যাশিত নয়। |
|
কিশোরদের ভালবাসার প্রকাশটা বদলে গিয়েছে। এখন ছেলেমেয়েরা অনেক সহজে মেলামেশার সুযোগ পায়। সিনেমা-থিয়েটার দেখে তাদের সাহস অনেক বাড়ছে, কমছে লজ্জা। তবে এতটা আবেগপ্রবণতা এ যুগের সঙ্গে মানায় না।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক |
|
|
এখনকার সিনেমা তো এখনকার জীবনযাপনেরই গল্প বলে। বাবা-মায়েদেরও বুঝতে হবে, তাঁদের পারিপার্শ্বিক, জীবনযাপন সবই বদলেছে। এখন যুগটাই খোলামেলা। ছেলেমেয়েরাও সেটাই শিখছে। ওদের সঙ্গে যদি বন্ধুর মতো মেশা যায়, এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সহজ হবে।
রুদ্রনীল ঘোষ, অভিনেতা |
|
|
আমাদের সমাজের প্রাপ্তবয়স্কেরা এখনও প্রাপ্তমনস্ক হননি বলেই এত সমস্যা। বড়রা ছোটদের চিন্তা-ভাবনাকে স্বীকৃতি দিতে শিখছেন না। যা ঘটল, তা তো শুধুই গ্রহণযোগ্যতার অভাব থেকেই। সমাজ পরিণতমনস্ক হলেই অপ্রাপ্তবয়স্কদের এই প্রেম বড়রা সহজ ভাবে গ্রহণ করতে রতেন।
অভিজিৎ মিত্র, সমাজতত্ত্বের শিক্ষক |
|
|
ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে স্কুলে পড়ুক বা না পড়ুক, এই বয়সে প্রেম বা যৌনতা নিয়ে কৌতুহল থাকাটাই স্বাভাবিক। সব স্কুলেই যৌনশিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে ছেলেমেয়েরা সচেতন হবে। কৌতূহল তাদের ভুল পথে নিয়ে যাবে না। তবে বাবা-মায়েদেরও উচিত ছেলেমেয়েদের মন বোঝা। ছেলেমেয়েদের
মানসিকতাও তো পাল্টেছে।
রীতা চট্টোপাধ্যায়, স্কুলের প্রধান |
|
|
বিশ্বায়নের যুগে ছেলেমেয়েরা এখন অনেক কিছুই দেখে, শেখে, বোঝে। সব তো আটকানো যায় না। কিন্তু কোনটা ওদের উপযোগী, কোনটা নয়, সেটা বোঝার মতো জায়গায় ওদের নিয়ে যেতে হবে। তার জন্য এক দিকে যেমন দরকার বাবা-মায়েদের বন্ধুর মতো পাশে থাকা, অন্য দিকে দরকার যৌনশিক্ষা।
ঊষসী চক্রবর্তী, অভিনেত্রী |
|
এই বয়স বৌদ্ধিক মনন অভ্যাসের বয়স। নতুন কিছু শেখা, নতুন জানার বয়স। নতুন আবেগের ইঙ্গিতও সেখানে থাকবে। কিন্তু আবেগের প্রাবল্য সুস্থ পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে না।
মা-বাবার ব্যস্ততা বা ঔদাসীন্য ছাড়াও যে বাড়িতে বড়দের মধ্যে প্রবল অশান্তি, সেখানেও শিশু অসহায়তায় ভোগে। মনের মতো বন্ধু পেলে তাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। মিডিয়ার ‘দাক্ষিণ্যে’ও প্রেমের দৃশ্যের ছড়াছড়িতে আজকের কিশোর-কিশোরী অনেকাংশে অনুপ্রাণিত। প্রেমের বহরে এক জন আর এক জনকে না-পেলে হাত কেটে রক্তারক্তি করার ঘটনা দুর্লভ নয়। সব ক’টি বিষয়ই জানাচ্ছে, লেখাপড়া বা বয়সোচিত কাজ থেকে সরে আসা, অসংযত মননের এক অদ্ভুত একাকিত্ব। এ ছাড়াও আছে কম্পিউটারে যৌনতার ছবি-সহ আদিম প্রবৃত্তির বিভিন্ন তথ্য। যে তত্ত্ব বা তথ্য হজম করার মতো মানসিক শক্তি তৈরি হয়নি। তা বদহজমে কিশোরদের নেতিমূলক দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দরকার ওদের আর একটু খেয়াল রাখার।
প্রতিযোগিতামূলক সামাজিক প্রেক্ষাপট, আত্মপরিচিতির আঁচড় কাটার তাগিদ আজ ছোট থেকেই। অনুপ্রেরণার উৎস প্রথমে বড়রা। পরে ওরা নিজেরাই, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নিজের ক্ষমতার তুলনামূলক বিচারে। এ দিক থেকে দেখতে গেলেও যে কিশোর বা কিশোরী এগিয়ে যাওয়ার রাস্তায় পিছিয়ে পড়েছে, জগতের জমিতে আত্মপরিচিতির উজ্জ্বল দাগ কাটতে পারছে না, অথচ যারা খুব কম বুদ্ধিসম্পন্ন নয়, ফলে না-পারা সম্পর্কে যার আত্মসচেতনতা আছে, তারাও কিন্তু আবেগতাড়িত হয়ে ভেসে যাচ্ছে ভুল পথে।
কোথাও কোথাও একমাত্র সন্তান হওয়ার জন্য চাহিদা পূরণের অভ্যাস, বড়দের অতিরিক্ত আদরের মাত্রা এদের সহনশীলতার বহর কেটে ছোট করে দিচ্ছে। ফল, শুধুই দুর্ঘটনা। আসলে ভালমন্দ মিশিয়ে সমাজ চলবেই। জীবনের গতি সব অবস্থায় অব্যাহত থাকবে। তরতাজা প্রাণগুলিকে সযত্নে বড় করতে পারলে পৃথিবীটা কি আরও সুন্দর হবে না? আমরা বড়রা কি ভাবব না আর একটু এ বিষয়ে?
|
(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক) |
|
|
|
|
|