|
|
|
|
শতবর্ষে উজ্জ্বল কুকুড়াখুপি প্রাথমিক স্কুল |
দেবরাজ ঘোষ • সাঁকরাইল |
সেটা ১৯১২ সাল। মানে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লি চলে যাওয়ার ঠিক পরের বছর। স্থানীয় রাজা, কোম্পানি বা ইংল্যান্ডের রানির শাসনের দীর্ঘ মেয়াদেও বাংলার গ্রামগুলিতে তখনও শিক্ষার প্রসার হয়নি তেমন। বিশেষত সেই গ্রাম যদি হয় পশ্চিম-সীমানার জঙ্গলমহলে।
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সাঁকরাইলের প্রত্যন্ত গ্রাম কুকুড়াখুপিতেও তখন স্কুল ছিল না। বিংশ শতাব্দীর সেই প্রথমার্ধে শিক্ষার প্রয়োজন নিয়ে অবশ্য এলাকাবাসীর মধ্যে কোনও সংশয় ছিল না। ত্রৈলোক্যনাথ মহাপাত্র, ক্ষীরোদ মাইতি, শ্রীনিবাস রাউতের মতো শিক্ষানুরাগীরা এলাকাবাসীর সঙ্গে আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেন, গ্রামে গড়ে তুলতে হবে অন্তত একটি প্রাথমিক স্কুল। কুকুড়াখুপি ও তার আশপাশ এলাকা তখন ঝাড়গ্রাম রাজার অধীনে। গ্রামে স্কুল গড়তে উদ্যোগী মানুষজন রাজার কাছেই দরবার করলেন। এলাকার ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে স্কুল চালুর অনুমতি দিতে দ্বিধা করেননি রাজা নরসিংহ মল্লদেব। শেষমেশ ১৯১২-এর শেষ দিকে যাত্রা শুরু সেই প্রাথমিক স্কুলের। সেই শুরু। চলতে চলতে এ বার পদার্পণ শতবষের্র্। প্রত্যন্ত একটি গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শতক পেরিয়ে আসার ঘটনা স্বাভাবিক ভাবেই তরঙ্গ তুলেছে স্থানীয় জনমানসে। গত সোমবারই শতবর্ষ উপলক্ষে স্কুল-প্রাঙ্গণে দিনভর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। পুরনো ছাত্রছাত্রীদের পুনর্মিলন অনুষ্ঠানও হল। প্রাক্তনীদের মধ্যে ফিরে ফিরে এল ফেলে আসা উজ্জ্বল দিনের স্মৃতি। |
|
শতবর্ষ উদযাপন স্কুলের। নিজস্ব চিত্র। |
১৯১২-য় পঠনপাঠন শুরু হয়েছিল খড়ের একচালায়। সেখানেই চলত পঠনপাঠন। কখনও বা গাছতলাতেও ক্লাস হয়েছে। শুরুতে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো শুরু করেছিলেন ক্ষীরোদবাবুই। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও ছিল কম। দিন বদলেছে। বদলেছে কুকুড়াখুপি ও তার আশপাশের এলাকাও। প্রত্যন্ত গ্রামই এখন গঞ্জ হয়ে উঠেছে। বসতি বেড়েছে। সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে। আশপাশের এলাকার মানুষজনের যাতায়াতে হাটের দিনে মুখর থাকে কুকড়াখুপি। এখন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৬০। শিক্ষক ৩ জন। তাঁদের এক জন পার্শ্বশিক্ষক। কিন্তু পরিকাঠামোয় ঘাটতি রয়েই গিয়েছে। স্বাধীন দেশে ৬৫ পার করেও! এখনও স্কুলে ক্লাসঘর মাত্র দু’টি। চার ধারে সীমানা প্রাচীরও নেই। সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেই একমাত্র পরিকাঠামোর উন্নয়ন সম্ভব বলে মনে করছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ জন্য বিভিন্ন মহলে দরবারও করছেন তাঁরা।
এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ দাস। প্রায় স্কুলেরই বয়সী তিনি। সুরেন্দ্রনাথবাবু বলছিলেন, “গোড়ায় একটি চালাঘরেই পড়াশোনা হত। আশপাশের এলাকা থেকেও ছাত্রছাত্রীরা আসত।” স্মৃতিতে ডুব দিয়ে আর এক প্রাক্তন ছাত্র, লোকসংস্কৃতির গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “১৯৫৫ সালে আমার হাতেখড়ি হয়। ওই বছর সরস্বতী পুজোর দিন প্রথম স্কুলে আসি।” সুব্রতবাবু । পুনর্মিলন উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন সুস্মিতা দে, পদ্মা দাস, হেমন্ত মাইতি, শক্তিপদ আচার্যরা। সুস্মিতাদেবী বলছিলেন, “স্কুলবেলার দিনগুলোর কথা ভাবলে এখনও মন কেমন করে। মনে হয়, সেই ছোটবেলাতেই ফিরে যাই। যে স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেছিলাম, সেই স্কুলই আজ শতবর্ষে পদার্পণ করেছে--ভাবতেই দারুণ লাগছে।” একই বক্তব্য হেমন্তবাবুদের। গর্বিত বর্তমান ছাত্রছাত্রীরাও। তৃতীয় শ্রেণির কৌশিক দাস, চতুর্থ শ্রেণির হিমানি সাউরা বলে, “এমন একটা স্কুলে পড়তে পেরে আমরাও গর্বিত।” ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গৌতম বেরার বক্তব্য, “স্কুলের উন্নয়নে সবার সহযোগিতা চাই। তবে এলাকার মানুষ নানা ভাবে সাহায্য করেন।”
শতবর্ষে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। আজও এই স্কুলে অপূর্ণতার যে জায়গাগুলি রয়েছে--সবার সহায়তায় তা আগামী দিনে পূর্ণতা পাবে, এটাই শিক্ষক-প্রাক্তন পড়ুয়াদের প্রত্যাশা। |
|
|
|
|
|