চিদম্বরম কাঠগড়ায় উঠবেন কি না, তার ফয়সালা হওয়ার কথা ছিল আজ। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগের আঙুল না তুললেও গোটা টুজি স্পেকট্রাম বণ্টন প্রক্রিয়াটি বাতিল করে দিয়ে মনমোহন সিংহ সরকার তথা কংগ্রেসকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল সুপ্রিম কোর্ট। জানিয়ে দিল, আন্দিমুথু রাজার আমলে যে ৯টি সংস্থাকে ‘আগে এলে আগে সুযোগ’-এর ভিত্তিতে ১২২টি টুজি স্পেকট্রাম লাইসেন্স বণ্টন করা হয়েছে, তা ‘একতরফা’ এবং ‘সংবিধান-বহির্ভূত’।
চিদম্বরমের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার নিম্ন আদালতের উপরেই ছেড়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের আজকের নিশানায় মূলত ছিলেন প্রাক্তন টেলিকমমন্ত্রী এ রাজা, ঘটনাচক্রে এ দিন যাঁর হাজতবাসের এক বছর পূর্ণ হল। যে ভাবে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে ‘অন্ধকারে রেখে’ রাজা টুজি স্পেকট্রাম বণ্টন করেন, তাকে জাতীয় সম্পদ ‘উপহার দেওয়া’ বলে ব্যাখ্যা করেছে শীর্ষ আদালতের বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় ও বিচারপতি জি এস সিঙ্ঘভির ডিভিশন বেঞ্চ। একই সঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এ কথা তৎকালীন অর্থমন্ত্রী চিদম্বরমকেও জানাননি রাজা।
উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে পরিস্থিতি সামলাতে মনমোহন ও চিদম্বরমের সম্পর্কে শীর্ষ আদালতের এই পর্যবেক্ষণকেই অস্ত্র করে আজ পাল্টা আক্রমণে নেমে পড়ে কংগ্রেস। তাদের আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল মূলত দু’টি। প্রথমত, এই দুর্নীতিতে বিজেপিকেও জড়িয়ে নেওয়া। কারণ, ‘আগে এলে আগে সুযোগ’-এর ভিত্তিতে বণ্টন এনডিএ জমানা থেকে শুরু হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আদালতের রায়ের সূত্র ধরে রাজাকেই সরাসরি কাঠগড়ায় তোলা।
কিন্তু এ সবে প্রধান বিরোধী দল বিজেপিকে থামানো যায়নি। এই রায়ের পরে চিদম্বরমের পদত্যাগের দাবিতে অনড় বিজেপি মনমোহন-সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তাদের যুক্তি, আদালতের রায় থেকেই পরিষ্কার, স্পেকট্রাম বণ্টনে দুর্নীতি হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তার নৈতিক দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। তাঁকে এর জবাবদিহি করতে হবে। অরুণ জেটলির যুক্তি, “এটা শুধু এক জনের সিদ্ধান্ত নয়, গোটা সরকারের সিদ্ধান্ত।” এ বিষয়ে সনিয়া গাঁধী ও রাহুল গাঁধীর বক্তব্যও দাবি করেছে বিজেপি। জেটলির পাশাপাশি গুজরাত থেকে নরেন্দ্র মোদী, বিহার থেকে নীতীশ কুমাররাও দাবি তুলেছেন, এর পরে মনমোহন-সরকার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। বস্তুত, টুজি মামলায় এই নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় বার কংগ্রেসকে জোর ধাক্কা দিল সুপ্রিম কোর্ট। এ দিন সরাসরি চিদম্বরম বা মনমোহনকে কাঠগড়ায় না তুললেও এর আগে রাজার বিরুদ্ধে মামলা চালানোর অনুমতি দিতে কেন ১৬ মাস দেরি হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের ভূমিকার সমালোচনা করেছিল তারা।
বিস্তারিত জানতে
ছবিতে ক্লিক করুন |
|
উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে এই ঘটনায় কংগ্রেস যথেষ্ট বেকায়দায় পড়ল বলে মনে করছে দলেরই একাংশ। এ দিন সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণার পরপরই বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ৭ রেসকোর্স রোডে যান বর্তমান টেলিকমমন্ত্রী কপিল সিব্বল। পরে তিনি নর্থ ব্লকে চিদম্বরমের সঙ্গেও দেখা করেন। বিকেলে তিনি সাংবাদিক বৈঠক করেন। সেখানে কংগ্রেসের পাল্টা আক্রমণের কৌশলটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আবার মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। সেখানে মনমোহন, চিদম্বরম, সিব্বল ছাড়াও ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং এ কে অ্যান্টনি।
কংগ্রেসের একটি অংশ মনে করছে, রাহুল গাঁধীর প্রচারে ভর করে দল যখন উত্তরপ্রদেশ নিয়ে আশায় বুক বাঁধছে, তখন সুপ্রিম কোর্টের এই রায় বিরোধীদের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দিল। উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রচারে প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে দুর্নীতিই। রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া অর্থ নয়ছয় হচ্ছে বলে উত্তরপ্রদেশে প্রচার চালাচ্ছেন রাহুল। এ বার স্পেকট্রাম দুর্নীতি নিয়ে শীর্ষ আদালতের রায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই প্রচারের অস্ত্র হয়ে উঠবে। তাতে ভোটে ধাক্কা খাওয়ার যথেষ্টই সম্ভাবনা।
দলের মধ্যেই আর একটি অংশ কিন্তু আশা করছে, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে টুজি স্পেকট্রামের থেকেও বড় বিষয় হবে মায়াবতী সরকারের দুর্নীতি। এই অংশটির বক্তব্য, টেলিকম দুর্নীতি নিয়ে এর মধ্যেই রাজা-সহ মূল অভিযুক্তদের জেলে পাঠানো হয়েছে। বরং দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে মায়াবতী যে ভাবে তাঁর সরকারেরই ২১ জন মন্ত্রীকে ভোটের আগে সরিয়ে দিয়েছেন, তা অনেক গুরুতর প্রশ্ন হয়ে উঠবে। এ কথা মাথায় রেখে পাল্টা আক্রমণকেই ‘আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়’ হিসেবে বেছে নিয়েছে কংগ্রেস। বিজেপি যখন ‘কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সামগ্রিক দায়িত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তখন কংগ্রেস নেতা জনার্দন দ্বিবেদী তাই বলছেন, “সামগ্রিক দায়ের কথা বললে বিজেপিকেও দায় নিতে হবে। বিজেপি দলকে তা হলে কি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে?”
অন্য দিকে, বামেরা এ দিন কপিল সিব্বলের ইস্তফা দাবি করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, সিব্বল যদি আগেই এই লাইসেন্সগুলি বাতিল করে দিতেন, তা হলে আজ আর শীর্ষ আদালত প্রশাসনিক কাজে এ ভাবে নাক গলাতে পারত না।
২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে টুজি স্পেকট্রাম ব্যবহার করার জন্য মোবাইল সংস্থাগুলিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল ‘আগে এলে আগে পাবে’ নীতি মেনে। সিএজি-র (কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল) হিসেবে, নিয়ম-বহির্ভূত উপায়ে স্পেকট্রাম বণ্টনের ফলে সরকারের সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। যে হিসেব উড়িয়ে দিয়ে মনমোহন-সরকারের দাবি ছিল, টুজি স্পেকট্রাম বণ্টনে কোনও ক্ষতিই হয়নি। হলেও তা খুবই সামান্য। কিন্তু সুব্রহ্মণ্যম স্বামীদের যুক্তি ছিল, নিলাম করে টুজি স্পেকট্রাম বিলি করা হলে আরও অনেক বেশি আয় হত সরকারের।
কারণ কয়েকটি সংস্থা লাইসেন্স পেয়েই তা চড়া দামে অন্য সংস্থার কাছে বিক্রি করে দেয়। সঠিক নীতি নেওয়া হলে সেই অর্থ সরকারের কোষাগারেই জমা হতে পারত। রাজার পাশাপাশি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে চিদম্বরমও দায়ী বলে অভিযোগ করেছিলেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। ২০০৮ সালে স্পেকট্রাম বণ্টনের সিদ্ধান্তের সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। টুজি মামলার তদন্তের ভার রয়েছে সিবিআইয়ের হাতে। চিদম্বরমের বিরুদ্ধেও সিবিআই তদন্ত শুরুর আর্জি জানিয়েছিলেন স্বামী।
আজ সুপ্রিম কোর্টে কী হল?
বিচারপতি সিঙ্ঘভি ও বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ জানিয়েছে, চিদম্বরমের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে কি না, তা নিয়ে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিচারক ও পি সাইনির বিশেষ আদালতকে। এই মামলায় জড়িত টেলিকম সংস্থাগুলির আইনজীবীরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় প্রভাব ফেলবে নিম্ন আদালতের রায়ে। তাঁরা তাঁদের মক্কেলদের তরফে এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিল করবেন বলে জানিয়েছেন। আর কংগ্রেস আতঙ্কে রয়েছে, কারণ, শনিবারই নিম্ন আদালতে ফের চিদম্বরমের মামলাটি উঠছে। তার উপরে কাল, শুক্রবার রয়েছে সেনাপ্রধানের বয়স বিতর্ক নিয়ে মামলার শুনানি।
সিবিআই নিরপেক্ষ ভাবে এই কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে না বলে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ করেছিলেন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ। তদন্তের জন্য একটি বিশেষ দল গঠনের আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি। সেই আর্জি খারিজ করে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। এই মামলার তদন্ত রিপোর্ট সিবিআইকে কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনের (সিভিসি) কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বেঞ্চ। পরে বন্ধ খামে ওই রিপোর্ট জমা পড়বে সুপ্রিম কোর্টে। সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর মতে, এই পদ্ধতি আর বিশেষ দলের তদন্তের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আদালতের রায়কে ‘সেরা রায়’ বলে অভিহিত করেছেন তিনি।
লাইসেন্স পাওয়ার পরেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নিজেদের শেয়ার অনেক বেশি দামে বিক্রি করেছিল টাটা, ইউনিটেক ও সোয়ান সংস্থা। তাদের প্রত্যেককে ৫ কোটি টাকা করে জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি সিঙ্ঘভি ও বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ। নিলামে টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টনের জন্য নতুন নীতির সুপারিশ করতে টেলিকম ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ট্রাইকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এই সুপারিশ নিয়ে এক মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কেন্দ্রকে। চার মাসের মধ্যে নিলামে টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে।
এর ফলে ভবিষ্যতে মোবাইলে কথা বলার খরচ বাড়বে কি না, তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তেমনই ফের টুজি লাইসেন্স নিলামে তোলার সুযোগ পেয়ে যাওয়ায় সরকারের সামনে নতুন আয়ের রাস্তাও খুলে গিয়েছে। টুজি-র ক্ষেত্রে ১২২টি লাইসেন্স দিয়ে সরকারের আয় হয়েছিল প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তার পরেই থ্রিজি পরিষেবার জন্য কিছু লাইসেন্স নিলাম করে আয় হয়েছিল ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এখন টুজি-র নিলাম হলে সরকার ৯০ হাজার থেকে এক লক্ষ কোটি টাকা আয় হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আর্থিক ঘাটতি নিয়ে চিন্তিত অর্থ মন্ত্রক যার ফলে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে মনমোহন-সরকারের কাছে সেটাই একমাত্র রুপোলি রেখা। |