রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
মেঘ-অরণ্যের রাজধানী
৯১১। হিরাম বিংহাম আবিষ্কার করলেন পেরুর বিখ্যাত ‘হারানো শহর’ মাচু পিছু। বই বেরোল, ‘লস্ট সিটি অব দি ইনকাজ’। মাচু পিছুর মায়াবি কাহিনি পশ্চিমি পর্যটকদের পাগল করে তুলল। বিংহাম ছিলেন আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন অধ্যাপক। ১৯০৯ সালে তিনি পেরুর কাসকো শহরে পর্যটনের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। এই সময় তিনি চারশো বছর ধরে সমাধান না হওয়া এক রহস্যের কাহিনি শোনেন।
ষোড়শ শতাব্দীতে স্প্যানিশ কনকুইস্তাদররা যখন পেরু আক্রমণ করে তখন ইনকাদের একটি দল পালিয়ে গিয়ে পেরুর দুর্ভেদ্য মেঘ-অরণ্যে আশ্রয় নেয়। তাদের সঙ্গে নাকি তারা নিয়ে গিয়েছিল সাম্রাজ্যের পবিত্র আর অভাবনীয় মূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদ খুঁজতে খুঁজতে ১৯১১ সালের ২৪ জুলাই বিংহাম পৌঁছে যান, দেখেন মাচু পিছুর অবিস্মরণীয় জ্যামিতিক মহিমা। এমনই অকল্পনীয় ছিল এই ধ্বংসাবশেষের রূপ যে, বিংহাম বলে উঠেছিলেন, ‘আমি যে কী পেলাম সেটা কেউ কি বিশ্বাস করবে?’
বিংহামের এই আবিষ্কার নিয়ে জল ঘোলাও কিন্তু কম হয়নি। বিংহামকে ‘কবর-লুঠেরা’ আখ্যান দিয়ে পেরুর পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় চুরি করা জাতীয় সম্পদ পেরুকে ফেরত দিক। মামলা রুজু হলে যে অসংখ্য লেখাপত্র প্রকাশিত হতে থাকে তাতে প্রশ্ন ওঠে বিংহাম (যিনি ইতিমধ্যে ১৯৫৬ সালে মারা গিয়েছেন) কি সত্যিই মাচু পিছু আবিষ্কার করেছিলেন? তিনি কি গোপনে পেরুর সম্পদ আমেরিকায় পাচারের দায়ে দোষী? পেরুর কাসকো শহরের এক মহিলা এও দাবি করতে শুরু করলেন, যে মাচু পিছু এলাকার আসল মালিক তাঁর পরিবার।
বিংহামের আবিষ্কারের গল্প যেন এক ভৌগোলিক গোয়েন্দা কাহিনির মতোই রোমহর্ষক, তার পরতে পরতে আবার মিশে আছে এক মুছে যাওয়া ইতিহাসের আখ্যান।
বিংহামের অভিযান শুরু হয়েছিল এক হারানো শহর খুঁজে পাওয়ার জন্যে। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রশ্নটা হয়ে উঠল কী করে ওই রকম এক দুর্গম বিচ্ছিন্ন পাহাড় চূড়ায়, যেখানে কুয়াশা ঢাকা আন্দিজ পর্বতমালার দেখা হয় আমাজোন নদী আর তার পরিবেশের সঙ্গে, ওই বিশাল গ্র্যানাইট শহর তৈরি হয়েছিল। কেনই বা হয়েছিল? কারাই বা করেছিল?

সূর্যের সন্তান
১৪৩৮ থেকে ১৫৩২ ছিল ইনকা সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ। এই সময়ে আন্দিজ এলাকার ২৫০০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিল এই শাসন। প্রজার সংখ্যা ছিল ১ কোটি। কাসকো শহর ছিল তখন এই সাম্রাজ্যের কেন্দ্র। এত পবিত্র ছিল এই শহর যে সাধারণ মানুষের এই শহরে রাত্রিবাস করার অধিকার ছিল না। প্রতি সন্ধ্যায় সূর্য ডুবলে তাদের বের করে দেওয়া হত। এই শহরের মাঝখানে ছিল সূর্যের সোনার মন্দির, কোরিকানচা। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক উইলিয়াম প্রেসকট বলেছিলেন, এই মন্দির হল নতুন দুনিয়ার মহত্তম স্থাপত্য, এর কারুকার্যের আর্থিক মূল্য হিসাব করলে সম্ভবত দুনিয়ার মহার্ঘতমও বটে। এই সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন সাপা ইনকা, তাঁর ক্ষমতা কেবল তাঁর বংশমর্যাদা উদ্ভুত ছিল না। বলা হত তিনি ‘ইন্টি’ বা সূর্যদেবতার সন্তান। এমনই মহিমা ছিল তাঁর যে তিনি যা ছুঁতেন, যে মাংস খেতেন তার হাড়, যে পোশাক পরতেন সেটাও, বছরে এক বার আনুষ্ঠানিক ভাবে জ্বালিয়ে ফেলা হত। তাঁর মাথা থেকে চুল পড়লে সেই কেশ তাঁর সুন্দরী পরিচারিকারা খেয়ে ফেলত। ভগবান বলে তিনি অমর ছিলেন। তাই তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শরীরকে মামি বানানো হয়েছিল, আর তিনি তাঁর সেই রাজভবনেই বিরাজ করে চলেছিলেন, বিশেষ দোভাষীদের মাধ্যমে রাজকীয় উপদেশ দিয়েও চলেছিলেন।

নাচুনে দেওয়াল
ইনকাদের তৈরি করা পাথরের কাঠামো, বিশেষ করে মাচু পিছু এই সাম্রাজ্যের সবচেয়ে পরিচিত উত্তরাধিকার। রাজবংশের ব্যবহার বা ধর্মীয় কারণে তৈরি এই স্থাপত্যগুলো তাদের জ্যামিতিক গঠনের জন্যে ভুবনবিখ্যাত। এই পাথরগুলো কোনও চুন-সুরকি ছাড়াই পরস্পর সংযুক্ত থাকে। এমনই সূক্ষ্ম এই জোড় যে এর ফাঁক দিয়ে একটা ছুরি গলানোও অসম্ভব।
ইনকাদের কাছে কোনও লোহার যন্ত্রপাতি, ভারবাহী জন্তুর ব্যবহারের জ্ঞান এমনকী চাকা লাগানো গাড়ি পর্যন্ত ছিল না। তারা যে কী করে এই পাথরগুলোকে বয়ে এনেছিল আর কাটাকুটি করেছিল তা এক রহস্য হয়ে আছে। সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হল যে, ইনকাদের একটা বিশাল শ্রমিক বাহিনী ছিল যারা পরবর্তী কালে ইউরোপে ব্যবহৃত পদ্ধতির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা পদ্ধতি ব্যবহার করত। ফ্লোরেন্সের এক জন কারিগর যদি একটা বাটালি দিয়ে শ্বেতপাথর কাটত, কাসকোতে এক জন কারিগর বিশেষ ভারী পাথরে তৈরি হাতুড়ি দিয়ে মেরে পাথরে তার কাঙ্ক্ষিত রূপ ফুটিয়ে তুলত। জিগ্ স পাজল-এর মতো করে গাঁথা পাথর শৈল্পিক দিক ছাড়াও স্থাপত্য কারিগরির জন্যে জরুরি ছিল। ভূমিকম্পের সময় সুরকি সাধারণত সরে গিয়ে পাথর আলগা হয়ে পড়ে যায়। কিন্তু এই পাথরে পাথরে জোড় দেওয়া পাথরগুলো নাকি ভূমিকম্পের সময় নাচত, কিন্তু ভাঙত না। কম্পন থেমে গেলে আবার নাচ থামিয়ে নিজের নিজের জায়গায় ফিরে আঁটো হয়ে বসে যেত। ১৯৫০ সালে এক ভূমিকম্পে দখলদার স্প্যানিশদের অনেক পরে তৈরি অট্টালিকা ভেঙে গেলে দেখা গেল তার নীচে ইনকাদের দেওয়াল দিব্যি টিকে আছে।

গুজবে কান...
এমনতো হতেই পারে যে আপনারা কেউ কেউ এক দিন মাচু পিছু দেখতে যাবেন। দেখতে গেলে তো আবার শুধু প্রাচীনকাল দেখে চলে আসা যায় না। বর্তমানের মজাগুলোও তো পেতে হয়। তাই জেনে রাখা ভাল যে, পেরু মানে মাচু পিছুর সন্ধানে যে দেশে আপনাকে যেতে হবে, সেই দেশ কিন্তু এক দারুণ মজার দেশ।
বিংহামের পায়ে পায়ে তাঁর অভিযানের প্রায় ১০০ বছর পরে মার্ক অ্যাডাম বলে যে ভদ্রলোক পেরু গিয়েছিলেন, আর যাঁর বই পড়ে আজ আমার এই লেখা, তিনি কতগুলো ভারী মজার গল্প বলেছেন। শোনা ভাল। ১৯৯৭ সালে মার্ক যখন প্রথম পেরুর রাজধানী লিমা যান, তখন লোকে তাঁকে বলে যে, একটু সাবধানে গাড়ি চালাবেন, এখানকার চোররা কিন্তু দারুণ নতুন ফন্দি বের করেছে। ফন্দিটা হল এ রকম: একটু নিরিবিলি জায়গায় বাচ্চা বাচ্চা চোরেরা লোহা গরম করে তৈরি থাকত। গাড়ি থামলেই ড্রাইভারের দিকের নয়, প্যাসেঞ্জারের দিকের জানালায় সেই লোহা চেপে ধরে কাচটা ফাটিয়ে দিত।আর সেই ফাঁক দিয়ে একটা ইঁদুর গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিত। ড্রাইভার যতক্ষণে ইঁদুরের সঙ্গে কুস্তিতে ব্যস্ত, ততক্ষণে তারা ব্যাগ নিয়ে চম্পট! আর ড্রাইভার যদি ভুল করে গাড়ি থেকে নেমে হুশহুশ করতে থাকতেন, তবে চোর গাড়ি নিয়ে ভাগলবা!
শুধু এই নয়, আরও গল্প আছে। হঠাৎ শোনা গেল, পুলিশ নাকি আবিষ্কার করেছে যে একটা খুনি দল ষাট জন লোককে মেরে তাদের চর্বি চুরি করে বিদেশি পারফিউম -মেকারদের কাছে লিটার দরে বেচে দিয়েছে। পরে বোঝা গেল, এটা একটা উপন্যাসের থেকে নেওয়া বানানো গল্প, সেটাকে সত্যি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভাল কথা, পেরুর ব্যাপারে আর একটা কথা চালু আছে, সেটা হল ‘পেরুভিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম’। ‘এই এক্ষুনি আসছি’ মানে এক্ষুনিও হতে পারে আবার বক্তা জাহাজ ধরে কায়রো চলে যাচ্ছেন তাও হতে পারে! শোনা যায় এক জন লোক তার মা যাতে তার বিয়েতে ঠিক সময়ে আসেন সেটা নিশ্চিত করার জন্যে মাকে মিথ্যে কথা বলেছিল। মাকে সে বলেছিল বিয়েটা দুপুর বারোটায়, যদিও বিয়ের সময় ছিল বিকেল চারটেয়। আর মা ঠিক চারটে বাজতে দশে হাজির হয়েছিলেন, হাঁফাতে, হাঁফাতে।

নখ যাদের তীক্ষ্ণ
১৫৩২ সালের আগে কেউ ভাবতেও পারেনি যে, ইনকাদের তাড়িয়ে লুকিয়ে বাঁচতে বাধ্য করা যায়। দোর্দণ্ড প্রতাপ পাচাকুটেকের নাতি হুয়ানা কাপাক যখন সাম্রাজ্যের দখল নিলেন, ঠিক সেই সময় বাহামায় এসে সান্তা মারিয়া থেকে নামলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস।
১৫১৩ সালে ভাস্কো নুনেজ দ্য বালবোয়া প্রশান্ত মহাসাগর চোখে দেখা প্রথম ইউরোপীয়ান হলেন। এর ছ’বছর পরে হেরনান কর্তেজ এখনকার মেক্সিকোর পুব তটে এসে নামলেন। দু’বছরের মধ্যে তিনি আজটেক সাম্রাজ্য ও তাদের রাজা মন্টেজুমাকে বশ করে অকল্পনীয় ধন আহরণ করলেন। বালবোয়ার বাহিনীতে বরিষ্ঠ আধিকারিক ছিলেন ফ্রান্সিসকো পিজারো। একটু কম উচ্চাকাঙ্ক্ষী কেউ পানামায় জায়গিরদার হয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু পিজারোর গল্প সেটা নয়। এই নিরক্ষর অবৈধ সন্তানটি নিজের অবস্থানকে ডিঙিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মত্ত ছিলেন। বালবোয়া আর কর্তেজের মতো পিজারোও ছিলেন ইবেরিয়ার এক্সত্রেমাদুরা প্রদেশের লোক। এই কঠিন ভূমি থেকে সেই আবিষ্কারের যুগের কঠোরতম অভিযাত্রীদের দেখা মিলেছিল।
১৯৩২-এ পিজারো টাম্বেজ-এ পৌঁছন। ইনকাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সেই শহর তখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পাচাকুটেক-এর পৌত্র হুয়ানাকাপাক মারা গিয়েছিলেন বসন্ত রোগে। এই রোগ নিয়ে এসেছিল স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা। কাপাক-এর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে হুয়াসকার সিংহাসনে বসেন। যদিও যুদ্ধের থেকে আমোদপ্রমোদ ও নারী-প্রেমের জন্যে হুয়াসকার বেশি খ্যাত ছিলেন।
হুয়াসকারের বৈমাত্রেয় ভাই আটাহুয়ালপা সিংহাসনের দাবি জানান। ইকুয়াডরে নিজের ঘাঁটি থেকে একের পর এক আক্রমণে তিনি হুয়াসকারকে বিধ্বস্ত করেন। পিজারো এসে পৌঁছনোর ক’দিন আগেই হুয়াসকার গ্রেফতার হন।
আটাহুয়ালপার বাহিনীতে ছিলেন অন্তত চল্লিশ হাজার সৈনিক। অন্য দিকে পিজারোর দলে ছিল ১৬৮ জন সদস্য। পিজারো জানতেন যে কোনও মতে সম্রাটকে ধরে ফেলতে পারলে তাঁর অবস্থান খুবই সুবিধেজনক হয়ে উঠবে। কারণ, ইনকাদের কাছে আটাহুয়ালপা ছিলেন এক জন দেবতা। সূর্যের সন্তান। সংখ্যায় কম হলেও পিজারোর একটা সুবিধে ছিল, তাঁর সঙ্গে ঘোড়া ছিল। ইনকারা কখনও ঘোড়া দেখেনি। পিজারোর সঙ্গে পুরনো ধরনের লম্বা নলা কামান জাতীয় একটা অস্ত্রও ছিল। যা থেকে খুব ভাল গোলা ছোড়া না গেলেও, আওয়াজ শুনিয়ে ভয় পাওয়ানো যেত খুবই। আর সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হল পিজারোর কাছে টোলেডো ইস্পাতে তৈরি তরোয়াল ছিল। উল্টো দিকে ইনকাদের হাতে অস্ত্র বলতে ছিল শুধু গুলতি।
সোনার সিংহাসনে চেপে আটাহুয়ালপা কাজামার্কার টাউন স্কোয়ারে পিজারোর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সঙ্গী সৈনিকরা ছিল নিরস্ত্র। আচমকা কামান দেগে পিজারো বন্দি করলেন সম্রাটকে। কাটা পড়ল হাজার হাজার ইনকা।
বন্দি আটাহুয়ালপা পিজারোকে যে মুক্তিপণ দেবেন বললেন, তা ইতিহাসে অশ্রুতপূর্ব ধন। আটাহুয়ালপা বলেন, বাইশ বাই সাতাশ ফুট ঘর তিনি প্রথমে সোনা দিয়ে ও পরে দু’বার রুপো দিয়ে আট ফুট উঁচু করে ভরে দেবেন। বলা হয় ছ’টনেরও বেশি সোনা এবং তার দ্বিগুণেরও বেশি রুপো জাহাজে করে পেরু থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
কৃতজ্ঞতার চিহ্ন হিসেবে পিজারো ওই টাউন স্কোয়ারেই আটাহুয়ালপাকে ফাঁসিতে ঝোলান। সিংহাসনে বসানো হয় আটাহুয়ালপার ভাই মানকো ইনকা ইপানকুই’কে। কিন্তু এই সদ্ভাব খুবই ক্ষণস্থায়ী ছিল। পিজারো মানকোকে আজকের এটিএম-এর মতোই ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ যখন ইচ্ছে টাকা বার করার জন্য।
যুদ্ধে নামলেন মানকো। এবং বহু রক্তাক্ত সংঘর্ষের পর পালিয়ে গেলেন উরুবাম্বা উপত্যকার দিকে।

পায়ে পায়ে ইতিহাস
আসলে মাচু পিছু ঠিক উড়োজাহাজে চেপে পৌঁছে যাওয়ার জায়গা নয়, ওখানে যেতে হয় ইতিহাসের পায়ে পায়ে।
মানকো যেমন পালাতে পালাতে নতুন রাজধানী তৈরি করলেন, আরও দূরে আরও অনধিগম্য এলাকায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর প্রিয় স্ত্রী কুরা অক্লো। পালিয়ে গিয়েও কিন্তু মানকো বাঁচাতে পারলেন না স্ত্রীকে। অকস্মাৎ আক্রমণ করে পিজারোর বাহিনী ঘিরে ধরল মানকোকে।
আত্মসমর্পণের প্রস্তাব জানিয়ে ইনকা রাজের কাছে পাঠানো হল টাট্টু আর ধনদৌলত। মানকো কিন্তু প্রত্যাখ্যান করলেন সেই প্রস্তাব। মেরে দিলেন টাট্টুটাকে। প্রতিহিংসায় উন্মত্ত পিজারো ইনকা রানিকে নগ্ন করে বেঁধে দিলেন একটি স্তম্ভে। ইনকাদের শত্রু কানারি-ইন্ডিয়ানরা তির মারল রানির দেহে। সেই দেহ বস্তাবন্দি করে ভাসিয়ে দেওয়া হল নদীতে, যাতে ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছয় মানকোর বাহিনীর কাছে।

সাদা মানুষ হলুদ চুল
২৪ জুলাই ১৯১১। সকাল থেকে বর্ষা। বিংহাম এসে পৌঁছলেন মাচু পিছুর কাছে। সরাই মালিক মেলকর আর্তেগার সেই বৃষ্টির ভোরে নড়নচড়নের খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। তার নাকের ডগায় রুপোর ডলার দোলালেন বিংহাম। সকাল ১০টা ৭। তিন জনের বাহিনী রওনা হল। ৪০ মিনিটের মাথায় দুরন্ত ঝোরার ওপরে ঝুলন্ত আদিম এক সেতুতে এসে হাজির হলেন তাঁরা। পার হওয়া হল সেই সেতু। পেরুর মানুষেরা হেঁটে আর বিংহাম হামাগুড়ি দিয়ে। পাহাড় চূড়ার পুব দিক বেয়ে উঠতে ৮০ মিনিট। তার অনেকটাই চার পায়ে। বিংহাম বলেছেন, কখনও শুধু আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ছিলাম। আর্তেগা বললেন, বিষাক্ত সাপ থেকে সাবধান! হঠাৎ ভোরের মেঘ সরে গেল, যেন সূর্যের তাপে গলে গেল। দিনটা হয়ে উঠল উষ্ণ। বিংহামের চোখের সামনে ফুটে উঠল মাচু পিছুর প্রথম স্থাপত্য একটি কেচুয়া কুটির। সেই কুটিরের বাসিন্দারা বিংহামের মতো ছ’ফুট চার ইঞ্চির সাদা মানুষ, হলুদ চুল, আর সঙ্গে আবার এক জন মিলিটারি এসকর্ট দেখে হকচকিয়েই গেল! তবে ভদ্রতার অভাব হল না। অথিতি পেলেন মিষ্টি আলু আর সুস্বাদু ঠান্ডা জলে ভরা লাউয়ের খোল।
মাচু পিছুতে প্রথম বার আসা যে কোনও পর্যটকের মতো বিংহামেরও খানিকটা সময় লাগল পৃথিবীর এক অপূর্বতম দৃশ্য দেখে ধাতস্থ হতে। নীচে উরুবাম্বার সাদা ফেনিল জলপ্রপাত। চার পাশে অসীম সবুজ। তারই মধ্যে সোজা দু’হাজার ফুট উঠে যাওয়া এক গ্র্যানাইট শৃঙ্গ। বাঁ পাশে হুয়ানাপিছুর উঁচু মাথা। চার দিকে অগম্য খাদ। দূরে মেঘ ঢাকা পর্বতমালা।
এর মাঝে আমাদের ঝুম চাষের মতো পুড়িয়ে বা জঙ্গল কেটে তৈরি করা ইনকা খেত নেমে গিয়েছে ধাপে ধাপে। আরও অনেক বছর পর গবেষকরা আবিষ্কার করবেন যে, ইনকারা কেবল এই জমিগুলোকে উর্বর মাটি দিয়ে ভরে ছিল তা-ই নয়, পাথর কেটে টুকরো সাজিয়ে এক বহু তল জলসেচ ব্যবস্থাও তৈরি করেছিল।
মাচু পিছুর যে কোনও সাধারণ ছবিতে আমরা দেখব বাড়িগুলো ডান দিক বাঁ দিক দুটো ভাগে বিভক্ত। বিংহাম ও তাঁর সহযাত্রীরা পাহাড়ের ধার ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। যেখানে তাঁরা দেখতে পেলেন অনেক স্তরের এক পাথুরে স্থাপত্য। হয়তো সংখ্যায় একশোটা। তার প্রতিটি বহু শত ফুট লম্বা, আর দশ ফুট উঁচু। আরও অনেক চমক ছিল। খুঁজতে খুঁজতে তাঁরা পেলেন এক ঝাঁক সুদৃশ্য গ্র্যানাইটের বাড়ি। শত শত বছরের লতা আর গুল্মে ঢাকা। এই অংশকেই এখন ‘ইস্টার্ন আরবান সেক্টর’ বলা হয়।
হাঁটতে হাঁটতে বিংহামের মাথা ঠুকে গেল একটি গুহায়। গুহার ভিতরে ভারী সুন্দর পাথরের কাজ। তার মধ্যস্থলে চারটে সাদা পাথরের ধাপ। একটু অসমান করে তৈরি, যাতে কেমন এক রহস্যময় ছায়ার মায়াজাল তৈরি হয়।
ঠিক এই গুহার ওপরেই ইনকারা তৈরি করেছিল একটা উঁচু অর্ধবৃত্তাকার দেওয়াল। তাতে ছিল দু’টি জানলা। এই স্থাপত্যটিকে এখন বলা হয় ‘টরিয়ন’ বা সূর্যের মন্দির। সাদা গ্রানাইটের দেওয়াল থেকে এক ধরনের উজ্জ্বল সৌন্দর্য ঠিকরে বেরোছিল। বিংহাম বললেন, আস্তে আস্তে আমি বুঝতে পারলাম যে এই দেওয়াল আর ওই অর্ধবৃত্তাকার মন্দির পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থাপত্যের নিদর্শন। উত্তজনায় আমার দম আটকে এল।
বিংহামের অভিযানের প্রায় ১০০ বছর পর মার্ক অ্যাডামস তাঁর পায়ে পায়ে গেলেন মাচু পিছু। আসলে মাচু পিছুর গোটা গল্পটা আজও বোঝা যায়নি। তার মজাটাই হল, আধেক ধরা দিয়েছ গো, আধেক আছে বাকি। ইতিহাসের খুঁটিনাটি পেরিয়েও থেকে যায় এক রহস্য। সন-তারিখ দিয়ে, তর্ক দিয়ে তার কিনারা হয় না। সে যেন শেষ বিচারে আমাদের দাঁড় করায় আমাদেরই সামনে। মনে হয় বিপুলা এই ধরণীর কতটুকু জানি!

ঋণ: মার্ক অ্যাডামস। টার্ন রাইট অ্যাট মাচু পিছু, ডাটন


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.