|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
সূচিপত্রের আড়ালে |
সুবীর বসু |
ভিড়ে ঠাসা বাসের জানলার ধারে বসে মহা ফুর্তিতে হাওয়া খেতে খেতে চলেছি শ্যামবাজারের দিকে। একটু আগে হাল্কা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। বাস তখন সবে মতিঝিল পেরিয়েছে। হঠাৎ দেখি ‘স্কুল ড্রেস’ চন্দনা আমার উল্টো দিকে, মানে নাগের বাজারের দিকে মুখ করে হেঁটে আসছে। ভাল করে দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল, সামনে জমে থাকা জল দেখে চন্দনার ছোট্ট লাফ। ওই লাফের সঙ্গে তাল রেখে চন্দনার পিঠ থেকে একটা বিনুনি দেখলাম লাফিয়ে কাঁধ পেরিয়ে চলে এল বাঁ দিকের বুক বরাবর। আমি চন্দনার প্রেমে পড়ে গেলাম। এর আগে রাস্তায়, দোকানে, স্কুল যাওয়ার পথে এমনকী ওর বাড়িতে চন্দনাকে আমি অন্তত কয়েকশ বার দেখেছি, কিন্তু কখনওই এমনতর অনুভূতি হয়নি। শ্যামবাজার পৌঁছনো পর্যন্ত আরও অন্তত বিশ বার চোখ বন্ধ করে ভাবলাম দৃশ্যটা। প্রত্যেক বারই দেখলাম ভাল লাগা, থুড়ি প্রেমে পড়ার ইচ্ছেটা বেড়ে যাচ্ছে। নাহ্, কিছু একটা করতেই হয়।
সেই ‘কিছু একটা’ করব বলে পরের দিন বিকেলে চন্দনাদের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। চন্দনার দাদা প্রদীপ আমার বন্ধু, ফলে ওর বাড়ির অন্দর মহলে ঢুকে পড়াটা আমার কাছে তেমন সমস্যার ব্যাপার নয়। সমস্যা হল চন্দনাকে একদম একা পাওয়া, সমস্যা হল কোনও দিন কোনও রকম দুর্বলতার চিহ্ন না দেখিয়ে হঠাৎ করে চন্দনাকে প্রোপোজ করা। কিন্তু ওদের বাড়িতে ঢোকার পর বুঝলাম আমার সমস্যা দূর হয়েছে। মানে, চন্দনা বাড়ি নেই, সে বন্ধুদের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গিয়েছে। প্রদীপ বাড়িতেই ছিল। ওর সঙ্গে ঘণ্টা দুয়েক আড্ডা মেরে যখন ফিরছি, দেখি মোড়ের মাথার ল্যাম্প পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে চন্দনা আমাদের পাশের পাড়ার অরিত্রর সঙ্গে নিরিবিলি, খুব হাসাহাসি আর কথাবার্তায় ব্যস্ত। প্রথম দর্শনেই বোঝা যায় যে, ওরা প্রেমিক-প্রেমিকা। বিশেষ করে চন্দনা যখন আঙুল তুলে চোখ বড় করে গলার স্বর না চড়িয়ে অরিত্রকে শাসন করছিল, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে ওই শাসন আসলে অনুরাগের অন্য নাম। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, চন্দনা আমার সামনে শাটার নামিয়ে দিয়েছে। নিজের উপর বেশ রাগ হচ্ছিল। এই প্রেমে পড়াটা আরও কিছু দিন আগে হলে আমাকে এই ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয় না। সব আমার কপালের দোষ! চন্দনাকে মন থেকে বিদায় দেওয়ার আগে শেষ এক বার ভাল করে দেখে নিতে গিয়ে দেখি, তার সে বিনুনি উধাও। এবং সে এখন প্রায় বয়-কাট! তার মানে আগের দিন রাতেই... পার্লারে...। ধুস, ওই বিনুনিই যদি না থাকল, কীসের প্রেম, ভেবে আমিও বাড়িমুখো হাঁটা দিলাম। |
|
বাড়ি ফিরেও মনে সেই বিনুনির নড়াচড়া টের পাই। এটা ঠিক অরিত্র আমার থেকে অনেক ভাল ছেলে। ও দেখতে ভাল, পড়াশোনায় ভাল, বাবার অনেক পয়সা আছে। আর আমি হলাম ‘নেই রাজ্যের বাসিন্দা’। মাস গেলে টিউশনি বাবদ যা হাতে আসে, সেটার বেশির ভাগই খরচ হয়ে যায় নিজের পড়াশোনার পিছনে। অরিত্র ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফাইনাল ইয়ার, আমি বি এ, অনার্সহীন। তুলনাটা অনর্থক। যা হয়েছে ভালই হয়েছে ভেবে অন্ধকার নামতেই আবার বেরোলাম রাস্তায়। ভুল করে কি না জানি না, আমি হাঁটতে হাঁটতে সেই চন্দনাদের বাড়ির পাশেই চলে এলাম। কানে এল, জানলার পাশে বসা চন্দনা সুর করে পড়ছে, ‘মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্যে কে দায়ী... মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্যে কে দায়ী...।’ কী মনে হল, পরের বার ‘কে দায়ী’ শোনা মাত্র একটু চেঁচিয়েই বলে বসলাম, ‘অরিত্র মজুমদার’। ব্যস! ও দিক থেকে চিৎকার, এই কে রে, কে রে ওখানে? আমি ততক্ষণে চন্দনার নাগাল পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছি সুরের মাঠে। তাড়াতাড়ি হাঁটার জন্যে আমি তখন রীতিমত হাঁপাচ্ছি। আকাশে একাদশীর চাঁদ। বেশ বুঝতে পারছিলাম, সে চাঁদও আড়চোখে এই ‘নেই রাজ্যের বাসিন্দা’কে মাপছে। ওই মাপার জন্যেই কিনা জানি না, হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে উদয় হলেন জনৈক চন্দ্রাহত। তার পরনে বাবরের আমলের একটা ঢিলেঢালা আলখাল্লা। আমার দিকে দু’পা এগিয়ে ‘আলখাল্লার সেই তিনি’ দেখলাম আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার খুব কাছাকাছি এসে মাটিতে বসে পড়লেন। ভাবলাম, বাঁচা গেল। ‘মুক্তি, ওরে মুক্তি কোথায় পাবি?’! সে তার পর হাত দিয়ে মাটি একটু ঝেড়ে নিয়ে আমাকে বলল, দেখ ভাই, এই জায়গাটা খুব একটা ভাল নয়। আমি অনেক দিন ধরে এই জায়গাটাতেই রাত কাটাই, তাই জানি, এই জায়গাটা থাকার পক্ষে খুব একটা ভাল নয়। ভাল রে ভাল! বুঝলাম সে ভয় পাচ্ছে, তার অমন সাধের জায়গার দখল অন্যের হাতে চলে যেতে পারে ভেবে। এর পর আর ওখানে দাঁড়ানো চলে না। বাড়ি ফেরার পথে খেয়াল করলাম, চন্দনাদের জানলা বন্ধ।
তার পর ওই বয়সে যা হয় আর কী, আমার প্রচুর চেষ্টা সত্ত্বেও দেখলাম একটার পর একটা জানলা চোখের সামনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হতাশ আমিও ‘সব ছেড়ে দিয়ে’ মন দিলাম চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। এখানে কিন্তু জানলাটা খুব তাড়াতাড়ি খুলে গেল। বেশ ভাল একটা চাকরি পেয়ে গেলাম। চাকরি পাওয়ার পর বাসা বদল। পুরনো পাড়ায় আর ভাল লাগছিল না। চলে এলাম ব্যারাকপুর। অফিসের পর সময়-সুযোগ পেলেই চলে যাই ব্যারাকপুর গাঁধীঘাটে। গঙ্গার হাওয়া, প্রকৃতির সঙ্গে শুদ্ধ কোলাকুলি, এই নিয়ে ভালই চলছিল দিনগুলো। তবু চাঁদ উঠলে কখনও কখনও মনে পড়ত সেই চন্দ্রাহত লোকটার কথা। জানি না সে জন্যেই কিনা, আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার ভিতরে একটা পরিবর্তন আসছে। সব কিছু আর তেমন সহজ ভাবে আমি ভাবতে পারি না আজকাল। কোথায় যেন এক ছন্দপতন!
এক রবিবারের সকালে আমি বাজারে যাচ্ছিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমি বাজারেই যাচ্ছি। পাশের বাড়ির সংঘমিত্রা, যে নিচু হয়ে গাছে জল দিচ্ছিল, আর আমাকে দেখে ওড়না সামলে উঠে দাঁড়িয়েছিল, সেও জানত আমি বাজারে যাচ্ছি। অথচ পাড়ার রমেনবাবু যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী অবিনাশবাবু, বাজারের দিকে নাকি? আমি বলে বসলাম, হ্যাঁ, এই একটু রোববারের দিকে যাচ্ছি, দেখি যদি কয়েকটা বাতিল বুধবার পাওয়া যায়। ভদ্রলোক আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত এক বার মেপে নিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন। আমার কথার মধ্যে এই উল্টো-পাল্টা শব্দ ঢুকে পড়ার রোগটা শুরু হয়েছে চাকরিটা পাওয়ার পর থেকেই। সপ্তাহে অফিসের দিনগুলোতে আমার যাতায়াত রেলপথে। আমি ভেবে দেখেছি আগেও আমার সঙ্গে রেলরাস্তাগুলোর পরিচয় ছিল, কিন্তু তখনও সকাল পাঁচটার চোখে আকাশ ফুটে উঠলে দেওয়ালগুলো এ ভাবে আড়ালে চলে যেত না। হঠাৎ আমার মনে হয়, আরে পরিচিত রেলরাস্তাগুলো তো আমার রোববার দেখেনি কখনও। তা হলে কি এটাই কারণ আমার কথার ভিতরে রোববার ঢুকে পড়ার? আমি ভাবি, কিন্তু বুধবার কেন এল। হুম্ম্, মনে পড়েছে, গত বুধবার স্টেশনে পাওয়া সস্তার বাতিল বইগুলোই এর জন্যে দায়ী। আমি ফের বইগুলোর কথা ভাবি, অনেক টেবিল জুড়ে ভাবি। আমি ঠিক করে নিই রবিবারে আর বাজারে যাব না। আমার শনি-রবি দু’দিন ছুটি। এ বার থেকে শনিবারেই বাজারে যাব ঠিক করে নিলাম।
পরের শনিবার বাজারে যাওয়ার পথে দেখলাম উল্টো দিকের বাড়ির দোতলায় খাঁচায় বন্দি টিয়াপাখিটা হাঁ করে স্বপ্না বউদির ছাদখোলা কলঘরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওই কলঘরে কিছু একটা ঘটছে ভেবে আমি বেশ শিহরিত হয়ে উঠলাম। তার পর মনে পড়ল, স্বপ্না বউদিরা ক’দিনের জন্যে শিমলা বেড়াতে গিয়েছে। তা হলে টিয়াপাখিটা কী দেখছে ওখানে! আমি বিড়বিড় করলাম, ‘বার্ডস আই ভিউ’। আবার রমেনবাবুর সঙ্গে দেখা। ভদ্রলোক কিছু জিজ্ঞেস না করেই চলে যাচ্ছেন দেখে, আমিই আগ বাড়িয়ে বললাম, দাদা, বাজারের দিকে যাচ্ছি। এ বার রমেনবাবুকে কিছু বলতেই হয়। তিনি বললেন, অবিনাশবাবু, আপনি তো রোববারে বাজারে যান, এই সপ্তাহে হঠাৎ শনিবারে? ওঁর এই প্রত্যুত্তর আমার ভাল লাগে। আমিও বেশ গুছিয়ে রমেনবাবুকে বলি, আর বলবেন না, আমি খেয়াল করে দেখেছি, রবিবারে সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগ কামরারই পাতা ওল্টানো হয় না। যা কিছু ধরপাকড়, যেহেতু তা পাওয়া যায় ব্যক্তিগত ছুটির বিনিময়ে, সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোতেই বেশি ভাল লাগে। হতভম্ব রমেনবাবু, ‘যাই ঘর গোছাতে হবে’ বলে হাঁটা দিলেন। এই ‘ঘর গোছাতে হবে’ কথাটা আমার খুব পছন্দ হয়। আমার মনে পড়ে চন্দনার কথা, তার বিনুনির কথা। তার পর হঠাৎ মনে পড়ে সে বার সল্ট লেক স্টেডিয়ামে বইমেলার আকাশটাকে গুছিয়ে ক্যামেরাবন্দি করতে গিয়ে আমার চোখে পড়েছিল স্বল্পবাস এক তরুণী কৃত্রিম রক ক্লাইম্বিং করছে। আকাশ না ওই তরুণী, কাকে ক্যামেরাবন্দি করব ভাবতে ভাবতেই পাশে কে যেন এক জন বলে গেলেন, সব কিছুতেই খালি গোঁজামিল। সে-দিন গুছিয়ে ছবি তোলা হয়নি, অথচ রমেনবাবুর মুখ থেকে ‘ঘর গোছাতে হবে’ শোনার পর থেকেই আমার গায়ে কেমন কাঁটা দিচ্ছে।
বাজার থেকে ফেরার পথে আমার দেখা হল সংঘমিত্রার সঙ্গে। এ বার আর সে নিচু হয়ে কিছু করছে না অথচ কখনও না ঢোকা রেস্তোরাঁর খাবারের গন্ধটা খুব স্পষ্ট টের পাচ্ছি আমি। সংঘমিত্রাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ‘ঘর গোছাতে হবে’ কথাটার মানে জানো? সংঘমিত্রা একটুও না চমকে উত্তর দিল, তুমিও তো দেখছি আমারই মতো আলাপচারিতায় কোনও সূচিপত্র মানো না। সংঘমিত্রার এই ‘তুমি’ ডাক বহু দিন পর আমার শরীরের দাঁড়াগুলোকে সোজা করে দিল। সংঘমিত্রাকে আমার তখন মনে হচ্ছিল সেই পাখিবালিকা, যে বৃষ্টি আসবে কি না আগাম বলে দিতে পারে। তার পরেই চন্দ্রাহতর মতো আমার মনে হয়, আচ্ছা সংঘমিত্রা কি ‘বুলাদি’র নাম শুনেছে? এই প্রশ্নটাই করবে কি না ভাবার আগেই ও দিক থেকে প্রশ্ন ধেয়ে আসে, তুমি নগ্নতা থেকে ঝিঁঝি পোকা সরিয়ে রাখার অর্থ জানো? আমি বুঝতে পারি, অপেক্ষা আসলে এক জেদি হাওয়ার নাম। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম, বিশ্বাস করো, আমি জানি, আমার জমির জ্যোৎস্নায় এক দিন ঠিক খসে পড়বেই অসাবধানী বুলাদি। তখন ঝিঁঝিরাও আত্মরক্ষাহীন হয়ে পড়বে।
তখনই ঝেঁপে বৃষ্টি আসে। আমি দেখি, আমার কংক্রিটের ডায়েরিতে একটা দাঁড়হীন অশ্বত্থ গাছের ছবি আঁকা, তার পাশে বাউলের পোশাক পরে গলা ছেড়ে গান গাইছে এক আত্মরক্ষাহীন ঝিঁঝিপোকা।
তখন আমার চাকরির বয়েস এক বছর। এক টুকরো কাগজে সাগরিকা, আমার কলিগ, আমাকে লিখে পাঠাল, ‘ওহ্ মাই ডিয়ার, আই লাভ ইউ’। আরে এ তো হাত বাড়ালেই সে, একেবারে জব্বর গণতন্ত্র। মনে পড়ে গেল, বাড়ির পাশের বালিকা বিদ্যামন্দিরের ‘নীল’ বিপ্লবে কী গভীর অংশগ্রহণ ছিল ‘আমি’ আর আমার বন্ধুদের। গণতন্ত্র চাই। চাই বললেই হয় নাকি! নাকে চশমা আঁটা ব্রিটিশ পুলিশদের চোখ এড়িয়ে আর কত আন্দোলন করা যায়! আজ এত দিন পর সেই গণতন্ত্র এ ভাবে আমার হাতের মুঠোয়। উফ্, ভাবলেই একটা আলাদা রোমাঞ্চ হচ্ছিল। ‘ওহ্’ শব্দটা মনের গভীরে একটা আলাদা হিল্লোল তৈরি করেছিল। আমি তখন সাগরিকা ভাবছিলাম, ওর ব্যালকনি ভাবছিলাম, শিহরিত হচ্ছিলাম...
পার্কে বসে, বাদামখোসায় ছবি এঁকে, ফুরফুরে মেজাজে ঝালমুড়ি খেয়ে, ‘আপেলের ঠোঙা’ নিয়ে ঝগড়া করে তার পর কেটে গেল একটা বছর। আর মাত্র সাত দিন পরেই আমাদের বিয়ে। সাজগোজ প্রায় সারা, এখন কুশীলবরা মাঠে নেমে পড়লেই হয়। ব্যারাকপুরের গঙ্গার হাওয়ার প্রভাবে হঠাৎ কবি বনে যাওয়া আমি তখন একলা ঘরে বসে, ‘আপেলের ঠোঙা’ নিয়ে একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছি, হাজির আমার অন্যতম প্রিয় পড়শি স্বপ্না বউদি। এই স্বপ্না বউদির ‘পানিপথের যুদ্ধ’ দেখেই সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে আমার প্রথম একটা ধারণা তৈরি হয়। উত্তেজিত আমি স্পষ্ট দেখলাম স্বপ্না বউদির মুখটা হঠাৎ বহু বার টিভিতে দেখা এক পরিচিত মহিলা সাংবাদিকের মতো হয়ে গেল। ছোট ছোট করে কাটা চুল, মুখে আলতো ঝোলানো হাসি। বেশি উত্তেজিত হওয়ার আগেই, ও পাশ থেকে ঠান্ডা গলায় কিছু প্রশ্ন ধেয়ে এল স্বপ্না বউদি আপনার বিছানায় দেখছি একটা কোলবালিশ আছে। আপনি কি ওটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোন?
আমি গণতন্ত্রের পতাকা ওড়াব, পতাকা দণ্ড তো লাগবেই।
কোলবালিশের কভার আপনি রঙিন না সাদা, কোনটা বেশি পছন্দ করেন?
রঙিন। সাদা রঙে কেমন যেন একটা আত্মসমর্পণের গন্ধ আছে।
বিয়ের পরেও কি ওই কোলবালিশ আপনার সঙ্গে থাকবে?
আলো এসে গেলে, মোমবাতি নিভিয়ে দেব। মোমবাতিটা থাকবে, প্রয়োজনে আবার জ্বালিয়ে নেওয়া যাবে।
এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাইছেন কেন?
ট্রেন বেশি লেট হলে কখনও কখনও দেখা গিয়েছে যে, গত কালের ট্রেন আর আজকের ট্রেন প্রায় একই সময় গন্তব্যে পৌঁছচ্ছে...
পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কিছু ভেবেছেন?
সংসদ সমাচার।
বুঝলাম না।
ওই নামে দূরদর্শনে একটা প্রোগ্রাম আছে, প্রায় কেউই দেখে না...
বিয়ের পর অন্য মেয়েদের প্রতি আসক্তি কমবে কি?
সাম্রাজ্যবাদ মাঝে মাঝেই গণতন্ত্রের হাত ধরে, নাম পাল্টে আসরে নামে।
আপনি তো গণতন্ত্র ভালবাসেন, সাম্রাজ্যবাদ আপনার কাছে কী ভাবে ধরা দেয়?
একদল মেয়েকে নিয়ে হারমনিয়াম বাজিয়ে, সমবয়েসি-অসমবয়েসি অন্যান্য ছেলেদের মনে হিংসা জাগিয়ে গান করা আমার কাছে গণতন্ত্র, আর হারমনিয়াম বাজানোর সময় আমার কনুই এবং চোখ জ্ঞানত বা অজ্ঞানত যেটা করে বা করতে চায়, সেটাই সাম্রাজ্যবাদ।
তার মানে কি আপনি এটাই বলতে চাইছেন যে, সেই সাম্রাজ্যবাদ বিয়ের পরেও আপনার চোখ বা কনুই থেকে হারিয়ে যাবে না?
না হারিয়ে যাবে না। কারণ, আমি মনে করি গণতন্ত্র যত বেশি পুরনো হয়, সাম্রাজ্যবাদ তত শক্তিশালী হয়, ডালপালা ছড়ায়।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এমন সহযোগিতা করার জন্যে।
স্বপ্না বউদি খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন আর আমি আগত ‘সানাই’কে কখনও সে নাই, কখনও সাগরিকা নাই ভেবে ‘পানিপথের বিপ্লব’-এ ফিরে গেলাম নিশ্চিন্তে।
আমাদের বিয়ের পর প্রায় এক বছর কেটে গিয়েছে। ব্যারাকপুর গাঁধীঘাট আজকাল আমার আর তেমন ভাল লাগে না। বরং আমাকে অনেক বেশি করে টানে ব্যারাকপুর স্টেশন, সন্ধ্যার ব্যারাকপুর স্টেশন। আমি নিজেও নিশ্চিত নই কেন প্রায় প্রতিটা সন্ধ্যায় আমি ছুটে আসি এই স্টেশন দুর্গে। হতে পারে ভিড়ে মিশে থাকা ‘চন্দনা’, ‘সংঘমিত্রা’দের টানেই হয়তো এই স্টেশন ভ্রমণ। এখানে সন্ধ্যা নামলেই অজস্র পাখিদের কোলাহল, এখানে সন্ধ্যা নামলেই পাখিরা কবিতা হয়ে নেমে আসতে চায় ডায়েরির পাতায়। সে-দিন স্টেশনের ভিড় ছাড়িয়ে পায়ে পায়ে উঠে গেলাম প্রায়ান্ধকার ওভার ব্রিজে। নীচে দেখতে পাচ্ছি মানুষের ভিড়, স্টেশনের ঘনিষ্ঠতা চাওয়া এবং পাওয়া ট্রেনের যাতায়াত। উপরে আমি আমি পাখিদের কাছাকাছি। পাখিদের কোলাহল, তাদের ছোট ছোট বাসা, সন্তান পালন, সব খুব কাছ থেকে দেখে বাড়ি ফিরে এলাম। সে রাতে অনেক দিন পর আমার ডায়েরির পাতায় কিছু লিখতে ইচ্ছে করল। লিখলাম রেলব্রিজে সন্ধ্যার পাখিরালয়ে মিশে গিয়ে দেখি সাজানো নাগালে নীচে থেমে আছে কিছু ট্রেন
যারা কিনা সম্পূর্ণ হওয়ার টানে টানটান পড়ে আছে স্টেশনের ঘনিষ্ঠ সমান্তরাল এই সন্ধ্যা, এই সব ট্রেন আর ব্রিজের সিঁথিতে জমা হওয়া পাখিদের চিহ্নিত কলোনি মন্ত্রমগ্ন, পবিত্র আসে যায় মনে পড়ে, মাতৃরূপেণ সংস্থিতা...
সে রাতে স্বপ্ন দেখলাম চন্দনা, সংঘমিত্রা, স্বপ্না বউদি, সাগরিকা সবাই সবাই একটা গাছে পাখি হয়ে দোল খাচ্ছে, তাদের ঝুলন্ত বাসায় আর সে গাছের নীচ থেকে তখন সুরের মাঠে দেখা সেই চন্দ্রাহত লোকটা একটানা হাত নেড়ে বলে যাচ্ছে, হুশ্, হুশ্, হুশ্... |
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|