দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কোনও দিন সে
অর্থে আলোকবৃত্তে আসেননি। অথচ, তাঁরা গোটা জীবন ধরে জেলার মনন এবং
সাংস্কৃতিক মানচিত্রকে রঙিন করে তুলেছেন। মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব মানুষের কথা। |
জন্মসূত্রে আদিবাসী। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈষ্ণব বিনয়। অধীত বিদ্যা আয়ুর্বেদ। ধন্বন্তরি নির্দেশিত চিকিৎসাবিদ্যার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই নেই এই বৈদ্য, বৈদ্যনাথ হেমব্রমের। গুরুগৃহের পাঠ বাঁকুড়ারই সাতপাটা-মণ্ডলকুলীর প্রয়াত প্রমথ মাহাতর কাছে। কিন্তু যে জন্য বৈদ্যনাথের খ্যাতি তা হল তাঁর অসম্ভব ভাল প্রকৃতি-পাঠ। নিজের হাতের তালুর চেয়েও অনেক বেশি চেনেন সে সব। কোন গাছ, লতা কোন ঋতুতে ফুল-ফল দেয় এবং তা সঠিক সময়ে সংগ্রহ করে ওষুধ বানিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের হাতে তুলে কবিরাজ ‘মহাশয়’। দেখলে মনে পনে যেতে বাধ্য তারাশঙ্করের ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর ‘মশায়’-এর কথা। বয়স আশির কোঠায়। রোদ্দুরের মতো উজ্জ্বল গায়ের রং। ‘নিদান’ দেন রোগীর পারিবারিক বিধান মেনে। সেটা কী? পরিবারের গড়ন-গঠন, কে কী খায়, কোথায় থাকে, পরিবারের কে কী নেশা করে, মানে তামাকু, গুটখা, মদ-তাড়ি খায় ক’জন। এক কথায় রোগীর কেস হিস্ট্রি, মাইক্রো লেভেলে।
কারণ? “আমি যে মানুষটিকে রোগমুক্ত করব, তার পরিবারের সকলে আমাকে যদি সাহায্য না করেন, তবে আমার চিকিৎসা কাজে লাগবে না। তাই চিকিৎসা করি তো ‘ধাত’ জেনে।” ময়রা গ্রামের বৈদ্যালয়ে বসে কথা শেষ করেন বৈদ্যনাথ। বাঁকুড়া শহর থেকে ময়রার দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। প্রতি শনি ও রবিবার নিজের বাড়িতেই বসেন রোগী দেখতে। প্রয়োজনে আধুনিক চিকিৎসকদের মতো অন্য জায়গায় গিয়েও চিকিৎসা করেন। কখনও ঝাড়খণ্ড, কখনও বিহার।
প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মুদ্রিত তথ্যে আমরা পাই, ওষুধ তৈরি করে তা প্রথমে ধন্বন্তরি দেবতাকে ‘নিবেদন’ করা হত। ‘ঔষধ জাগানো’ পর্ব। বৈদ্যমহাশয় পি ও বোরিং সাহেবের দু’খণ্ডের ‘সানতাল মেডিসিন’ গ্রন্থ দেখেননি। দেখেননি হাজার পৃষ্ঠার জবাকুসুম হাউস প্রকাশিত ‘আয়ুর্বেদ সংগ্রহ’ গ্রন্থটিও। শোনেননি ‘লোকৌষধি’-র কোনও গ্রন্থের নামও। তবে কেমন করে শিখলেন এই আয়ুর্বেদ চিকিৎসা?
“সামান্য লেখাপড়া জানি মাত্র। শিখতে পারলাম তো সামান্যই। ওই গুরুর আশীর্বাদ ও মহাপ্রভুর কৃপা। তবে মানুষের বসতের চারপাশে যত প্রকার গাছ-গাছড়া আছে তা সবই ওষুধ। প্রয়োগ করতে করতে চেনা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার ওষুধ খেতে চাইলে কড়া ‘নিয়ম’ মানতে হবে। ‘পালুনি’ না মানলে আমি পালাব। রোগী তাড়াব। দেখব না। প্রথমেই সমস্ত রকমের নেশা থেকে পুরো পরিবার দশ ক্রোশ দূর।” নিজের চিকিৎসা নিয়ে যথেষ্ট কঠোর বৈদ্যনাথ। ফের শুরু করেন, “আপনারা কেন সারা বছর বাজারের অসময়ের শাক-সবজি, ফল-ফলারি খান? শহরে গিয়ে দেখি, রাস্তার ধারে অনেকেই নুডুলস খাচ্ছে, ও তো মরবার পথ। বাবা, শরীর তো মন্দির, নিয়ম-নিষ্ঠা না মানলে বিগড়াবে। ‘...যা সহাবে...’ তা এক সময় সইবে না শরীর মহাশয়।” বিনয়ের সঙ্গে করজোড়ে জানালেন, চার দশকের অভিজ্ঞ লোক কবিরাজ। |