|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
অসামান্য জীবনবাসনার শিল্পী |
সত্যজিৎ চৌধুরী |
দুখুশ্যাম চিত্রকর/পটুয়া সঙ্গীত, সুজিত কুমার মণ্ডল সম্পাদিত। গাঙচিল, ৫০০.০০ |
ভারতবর্ষে পট আঁকার পরম্পরা বেশ পুরনো। সংস্কৃতে পট্ট বা পট বলতে বোঝায় কাপড়। সেই কাপড়ে রঙ বুলিয়ে তাতে নানা পুরাণকথার চিত্র লিখে তা জনসমক্ষে দেখিয়ে (সঙ্গে দরকারে গেয়ে বা নেচে) এক শ্রেণির লোকশিল্পী জীবিকা অর্জন করতেন। তাঁদের বলা হত পটকার বা পট্টিকার। সবচেয়ে পুরনো পটকারের উল্লেখ পাওয়া গেছে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে-- নালন্দা গ্রামের পটকার মঙ্খের সন্তান ছিলেন গোশাল মঙ্খলিপুত্ত, আজীবিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ আর পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্যে’ ভ্রাম্যমাণ পটকারদের প্রসঙ্গ আছে। বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে এমন পথ পটুয়াদের বলা হয়েছে শৌভিক বা শৌভনিক। অনুমান করা যায়, এই ঐতিহ্যের ধারাপথেই গৌড়বঙ্গের পটুয়াশিল্প এসেছে কোনও সময়ে, যার কালনির্ণয় অসম্ভব।
দেবস্থানের আশেপাশে বসবাস করতেন পোটো পরিবারগুলি। ভক্তমণ্ডলীর ভিড়ে তাঁদের পট প্রদর্শন করে (বিষয় পৌরাণিক) আর চৌকো পট বেচে দিন গুজরান হত। কালীঘাটের পোটোরা অবশ্য তাঁদের জীবন অবলোকনের বলিষ্ঠতা থেকে পটের মধ্যে আনেন সমকালীন সমাজের তির্যক চিত্রণ। সেই পোটোরা আর নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে এক সচল ও সজীব পট নির্মাণের ধারা গ্রামে-গ্রামান্তরে বিশেষত বীরভূম, মেদিনীপুর আর মুর্শিদাবাদ জেলার ভেতর বাগে। বাংলার পটুয়াদের নিজস্ব গ্রামিক রূপকর্ম সভ্য পাঠকের গোচরে আনেন গুরুসদয় দত্ত, যিনি পেশায় ছিলেন আই সি এস আমলা আর নেশায় দেশজ শিল্প-সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের চারণ। তাঁর সংগ্রহ থেকেই মূলত বাঙালি সুপটু পটুয়ার লীলায়িত তুলিকার বর্ণময় চিত্রসম্ভার আর তার অনুষঙ্গী গানের ঐশ্বর্য আমরা জানতে পারি এবং পরবর্তী সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে সচেতন ক্রিয়াত্মকতা শুরু হয়। তাতে স্বদেশি ও বিদেশি যুগ্ম প্রয়াস লক্ষ করা যায়। গুরুসদয় দত্তের দিশা নিয়ে পরে যাঁরা মূল্যবান কাজ করেছেন সরেজমিনে তাঁদের মধ্যে নাম করা উচিত প্রয়াত তারাপদ সাঁতরা ও ডেভিড ম্যাক্কাচ্চনের। জীবিতদের মধ্যে অশোক ভট্টাচার্য, মহম্মদ মতিয়র রহমান, দীপক বড়পণ্ডা, চিত্তরঞ্জন মাইতি ও বিশেষ উল্লেখ্য দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। সুধাংশু রায়ের কাজ স্মরণীয় এবং ইংরেজিতে লেখা বই বিনয় ভট্টাচার্যের। এই সমৃদ্ধ তালিকায় এ বারে সংযোজিত হল এক উদ্যমী তরুণের নাম, সুজিত কুমার মণ্ডল।
তাঁর সংকলিত ও সম্পাদিত বইটি হাতে নিয়েই মন প্রসন্নতায় ভরে যায় দু’টি কারণে। এক, আগাগোড়া আর্ট পেপারে ছাপা বইটিতে পঞ্চাশ পৃষ্ঠাব্যাপী সুবিস্তৃত ও সানুপুঙ্খ পটচিত্রশোভিত দৃষ্টিনন্দন ও বর্ণময় চিত্রমুদ্রণ অসামান্য দক্ষতায় পরিস্ফুট। দুই, গড়পড়তা উন্নাসিকতা তাঁকে গ্রাস করেনি বলে গ্রামীণ পোটোদের তিনি মূল্য ও মর্যাদা দিয়েছেন, যা সাধুবাদযোগ্য ও উদাহরণীয়।
বইটির প্রধান লক্ষ্য সার্বিক পটুয়াসমাজের উন্মোচন বা তাদের কষ্ট করে বেঁচে থাকার কাহিনিকথন নয়। মাইক্রো-গবেষণার ধাঁচে সুজিত বেছে নিয়েছেন এক জন সফল ও নিত্য সৃজনক্ষম ব্যক্তি পটুয়াকে। তাঁর নাম দুখুশ্যাম চিত্রকর জন্ম ১৯৪৬, কলকাতায় শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। শৈশবে বাবা মারা গেলে মা তাঁকে নিয়ে যান মামার বাড়ি, তমলুকের ঠেকুয়াচকে। সেখান থেকে মামার সঙ্গে নয়া গ্রামে। তার মানে, দুখুশ্যামের ঘরানা হল মেদিনীপুরি। তাঁর আত্মকথায় আছে ‘নয়ায় বাড়ি পিংলা থানা
পশ্চিম মেদিনীপুর এই ঠিকানা
দুখুশ্যামের এই ভাবনা পট দেখিয়ে গান করি।’
একেবারে আঁটোসাটো আত্মকথা গান গেয়ে পট দেখানো, তা বেচার চেষ্টা, পটের সূত্রেই বিদেশযাত্রা, নানা সংযোগে বহু রকম বিষয়ে পট আঁকার স্বচ্ছন্দ সাবলীলতা। যেমন, পট এঁকে গান বেঁধেছেন আজব কলকাতা বিষয়ে। সঙ্গে গান বেঁধেছেন ও পটে দেখিয়েছেন গাজন, মাছের বিয়ে, ট্রামের মাহাত্ম্য তার পাশে গঙ্গা ও টেমস নদী। এইচ আই ভি আর ডিপ টিউবওয়েলের বিষয়ে তাঁর গান ও পট চমকপ্রদ এবং অনিবার্য ভাবে আছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রসঙ্গে। বিদ্যাসাগর, বিপ্লবী সুভাষ থেকে রবীন্দ্রপট সবই অনবদ্য। সুজিত সবই সংকলিত করে এক বড় নিদর্শন রাখলেন সঙ্গে দুখুশ্যামের সঙ্গে মনোরম ইন্টারভিউ ও তার সম্পূরক প্রয়াস দুখুর নিজের বয়ানে আত্মকথন।
যথা—
বড় মামা আঁকা শিখাইল
জামাইবাবু গান শিখাইল।
জনমদুখি কপালপোড়া আমি এক জন
আমার দুঃখে দুঃখে জনম গেল।
শেষমেশ অবশ্য সেই দুঃখের পাঁচালি টেকে না, কারণ, শিল্পী নিজেই কবুল করেন, বর্তমানে তাঁর দুই ছেলের ঘরে দু’খানা টিভি। দুখুশ্যামের বংশলতিকা (সুজিত প্রণীত) থেকে দেখা যাচ্ছে তাঁর দুই পত্নী রহিমন আর মর্জিনা। বর্তমানে তিন কন্যা পাঁচ পুত্র, নাতিনাতনি নিয়ে ভরা সংসার। ‘ভালই তো আছি’ নিজের কবুলতি। সেই সঙ্গে তথ্য হল দ্বিতীয়া স্ত্রী এবং ছয় সাবালক সন্তান সকলেই পট আঁকার কাজে যুক্ত। বাড়তি খবর হল: দুখুশ্যামের কাছে আঁকা শিখেছেন যাঁরা, তাঁদের বেশির ভাগই বিদেশের বাজারের স্বাদ নিতে পেরেছেন রানি, রাধা, গুরুপদ, স্বর্ণ, মণিমালা। নিরঞ্জন, নুরজাহান, গোলাপ, চম্পা, বাবলু, আবেদরা তাঁর কাছে গান শেখে। তাঁর পটের সমঝদারি করেছেন প্রায় সব মান্যমান মহাশয়। সুজিত মণ্ডল মনের সুখে প্রাণ খুলে গ্রামীণ পটুয়ার বহুল বিচিত্র পট এ বইতে হাজির করেছেন, সে কারণেই বইটি অ্যালবামের মর্যাদা পাবে। দুখুশ্যামের সংগৃহীত এমন কতকগুলি দুর্লভ ও ভিন্ন ধাঁচের পট বইতে আছে, যা চমকপ্রদ এবং স্বতন্ত্র ধারাবাহী।
সুজিত মণ্ডল এর আগে বনবিবির পালা সম্পাদনা করেছেন। এই বইটায় আমরা তাঁর অবহেলিত পট ও পটুয়াদের সম্পর্কে আন্তরিক ভালবাসার টান যেমন টের পাই, তেমনই নজর কাড়ে ব্যাপক ডকুমেন্টেশনের শ্রমশীল প্রয়াস। তার একটা সুন্দর উদাহরণ হল পটকাররা কত ভাবে দেশজ উপাদান থেকে তৈরি করেন রঙ তার বৃত্তান্ত। বেল থেকে আঠা তৈরি, অপরাজিতা ফুল থেকে নীল রং, সিমপাতা থেকে সবুজ, পুঁইমেটুলি থেকে বেগুনি, মেহেন্দি থেকে লালচে খয়েরি, সেগুন পাতা থেকে খয়েরি, আতপ চাল বেটে সাদা ও লম্ফ-র শিখা থেকে কালো রং প্রস্তুতি প্রণালী প্রতিটি স্তরে রঙিন আলোকচিত্র দিয়ে বোঝানো আছে তার তৈজসপত্র সমেত। হেলেঞ্চা, ছান্চি শাক, তেঁতুল, চালতার বীজ, জবাফুল ও তেলাকুচোর ফল দেখে বেশ উত্তেজনা হয় এই যে কত কত বছর ধরে বাঙালি পটুয়ারা তাঁদের চিত্রিত পটে রেখে গিয়েছেন প্রকৃতির সবুজ স্পর্শ। তবে একটা স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ আর একটু বিস্তারে আনা যেত। যাকে নৃতাত্ত্বিক বিনয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন ‘কালচারাল অসিলেশন’ বা পটে বিধৃত সাংস্কৃতিক দোলাচল। বাঙালি পটুয়ারা ঠাকুর গড়েন, পুরাণকথার পট আঁকেন আবার নমাজ পড়েন। অনেকের আছে দু’-দু’টি নাম যে কমল চিত্রকর, তার অন্য নাম কামাল। ইসলামে মানবমূর্তি আঁকা নিষিদ্ধ, দেবমূর্তি তো একেবারে অলীক সম্ভাবনা। আশ্চর্য এক জীবনদোলায় দুলে দুলে যুগে যুগে দুখুশ্যামরা বাঙালির সমন্বয় ভাবনার এক বলিষ্ঠ রূপায়ণ করে গেছেন। কমলকুমার মজুমদার বলেছিলেন: ‘বাংলাদেশ শিল্পকে কোন নামেই জীবন হইতে বাদ দেয় নাই।’ পটুয়ারা সেই অসামান্য জীবনবাসনার শিল্পী, সামঞ্জস্যই তাঁদের প্রকৃত ধর্ম। |
|
|
|
|
|