কলাপাতায় ক্রিসমাস
কা একা যত পুরনো ছবি চোখে ভাসে! ট্যাংরার শীল লেনের ঢাউস জনহীন ফ্ল্যাটটায় ভেরনিকা ওরফে আহ্লাদি রোজারিও-র বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই মার্টিন রোজারিও বড়দিনের কেকটা বরাবর নিজের হাতে বানাবেন। দাদুকে ঘিরে বাড়ির কুচোদের ভিড়। সাইমন্ডস, প্রতুল, জেমস, প্রদীপেরা অধীর অপেক্ষায় তাকিয়ে। এমন রাজসূয় যজ্ঞে সক্কলে একটু হাত লাগাতে চায়। ঠাকুরদা হাসতে হাসতে সবাইকে খুশি করছেন। সাইমন্ডসের পেট টিপে, ‘যা তুই ডিমটা ঢাল’! কিংবা, ‘ওরে প্রদীপ, তুই একটু চিনি দে তো!’
রানাঘাটের ক্রিশ্চান কলোনি বা এন্টালির পুরনো বাড়ির এই দৃশ্য মনে মনে দেখতে দেখতেই সত্তরোর্ধ্ব ভেরনিকা হেসে-খেলে ৫০ জনের রান্না রেঁধে ফেলবেন। বছরভর যে যেখানেই ব্যস্ত থাকুক, ক্রিসমাসের দুপুরে ছেলে-মেয়ে, বৌমা-জামাই, নাতি-নাতনিরা সক্কলে ঠিক একসঙ্গে পাত পেড়ে বসবেই। বাড়ির লাগোয়া সেন্ট সেবাস্তিয়ান ডে স্কুলের শিক্ষককুল-কর্মী, পড়ুয়া এবং নিজের ছেলেদের পরিচিতদের জন্য কেক বানানো অবশ্য দিন দশেক আগেই শুরু হয়েছে। স্রেফ ভ্যানিলাগন্ধী নিরাভরণ প্লেন কেক। ক্রিসমাস থেকে নতুন বছর প্রতি বারই মাসিমা কত কেক তৈরি করেন, হিসেব রাখতে সৃষ্টিকর্তাও নাজেহাল হবেন।
বড়দিনের দুপুর গড়াতেই দুই পুত্র রেস্তোরাঁ-কর্তা প্রদীপ জোসেফ রোজারিও এবং সেবাস্তিয়ান স্কুলের হেডমাস্টার প্রবীর মার্টিন সপরিবার হাজির। স্কুলের কর্মচারীরাও কেউ কেউ এমন নেমন্তন্নের শরিক। মেনুতে বাঙালি ক্রিশ্চান-ঘরের স্বাক্ষর মশলাদার সসেজ ভাজা তো থাকবেই। লুচি-রসগোল্লারও সহাবস্থান। পাত পেড়ে বসলে পরিষ্কার কলাপাতায় আহ্লাদিদেবী প্রথমে একটু টক-মিষ্টি স্যালাড দেবেন। তার পরে মাখো-মাখো পাঙাশ মাছ ভাজা আর লাউয়ের টকের টাকনা। এর পরে একে একে সদ্য কড়া থেকে আবির্ভূত লুচি, সুখা-সুখা মাছ-বেগুনের ভাজাকারি, লাউযোগে আধা মুড়োসুদ্ধ পাঙাশ-বোয়ালের কালতো কারি, ভাত, মাটনের আলু-ঝোল, সর্ষের তেলে ভাজা সসেজ, চর্বির তেল-চপচপে পর্ক ভুনি, পর্ক ভিন্দালু। শেষে দই-রসগোল্লা ও হোম মেড কেক। মার্টিন রোজারিওর জমানা কবেই শেষ হয়েছে। আহ্লাদীদেবীর স্বামী ক্রিস্টোফার ওরফে কেষ্টবাবুও দীর্ঘ দিন গত। কলাপাতায় সাজানো বচ্ছরকার দিনের বাঁধা মেনু আজও অটুট।

দমদমে অক্সিলিয়াম কনভেন্টের কাছের ছোট্ট ঘরটা এখন কেকের আঁতুড়ঘর। শেষ ডিসেম্বরের সকাল মানেই অশীতিপর জন গোমসও ঠুকঠুকিয়ে হাজির। একদা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ডাকসাইটে শেফ, দীর্ঘ দিন সপরিবার গোরাবাজারবাসী এই বঙ্গসন্তান। ইদানীং কানে কিছুটা খাটো। একটা চোখেও ছানি কাটা হয়েছে। তবু কেকের মাখন-চিনি ঠিকঠাক পেষা হল কি না, কেকে ডিমের কুসুম আর সাদা কখন কোনটা মেশানো হচ্ছে সে দিকে শ্যেন দৃষ্টি। চিনি-ময়দা-মাখনের খামিরে ক’টা ডিম পড়ছে, দিশি হলে কতগুলো আর পোলট্রি হলে ক’টা লাগবে সব এখনও নিজে তদারক না করলে বৃদ্ধের শান্তি নেই।
দুই পুত্র ফ্রান্সিস এবং মাইকেল ওরফে তপন দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্লাবের লাঞ্চ-ডিনার আয়োজনে ব্যস্ত। বাড়ির হেঁসেল বৌমারা সামলালেও জনের হাতেই রিমোট কন্ট্রোল। এ কালে ঘরে ঘরে তরিবত করে কেক বানানোর সময় কোথায়! কিন্তু চেনা-জানাদের আব্দারে দমদমের গোমসদের এ সময়টা অঢেল কেক বানাতে হয়। লাগাতার গুরুভোজে ঘরের লোকে প্লেন কেকটাই পছন্দ করলেও প্রিয়জনের অনেকেরই দাবি, ফ্রুট কেক বা রিচ প্লাম কেক। এর জন্য কম করে এক মাস আগে থেকে শুকনো ফল ঝেড়ে-বেছে রাম-ব্র্যান্ডিতে চোবানো। সুগন্ধী অরেঞ্জপিল রোদে দেওয়া। তার উপরে ক্রিসমাস ইভ কি বড়দিনে সগুষ্টি মহাভোজের হ্যাপা। পুজোর পর পরই মেনু ঠিক করা থেকে গোটা পর্বটা এই প্রবীণ গৃহকর্তার নেতৃত্বে।
দুই বৌমা রাণু গোমস ও অ্যাডেলিন শিল্পী গোমসকে হাতে ধরে তৈরি করেছিলেন জনের স্ত্রী রোজি। সে কালের বড়দিন সত্যিই বড়দিন ছিল বটে! কেক ছাড়াও গুড়-নারকোলের পুর-ঠাসা লম্বাটে পাউন-পিঠা বা সরুচাকলি তথা রুটি-পিঠা বানানোর ধুম। টার্কির জন্য এ পরিবার জম্মেও নিউ মার্কেটের পরোয়া করেনি। ডায়মন্ড হারবারের কাছের কোন গ্রাম থেকে জনের হটলাইন যোগাযোগে পক্ষীশাবক আসত অন্তত ৭-৮ মাস আগে। বাড়িতে খেয়ে-পরে সেটি তাগড়াই হওয়ার পরে তবে বড়দিনের টেবিলে ঠাঁই পাবে। ক্লাব-রেস্তোরাঁয় মিষ্টি মিষ্টি ক্র্যানবেরি সসে টার্কির স্টেক রোস্ট মিললেও এই ভেতো বাঙালিবাড়ির অন্য ধারা। ক্রিসমাস-পক্ষীর মাংস মজিয়ে টক টক মাখো মাখো টার্কি ভিন্দালু বানানোর প্রক্রিয়া যিশুর জন্মদিনের দু’রাত আগেই শুরু হয়েছে।
বৌমাদের কাজে নজরদারির ফাঁকে নিজের প্রয়াত স্ত্রীর হাতের রান্নার কথা মনে পড়ে জনের বুকটা হঠাৎই হু হু করে।

হেঁসেলের মাটির গামলাটা এ সময়ে কাজে লাগবেই। এলিয়ট রোডের ওয়ারেন টাকারের আবছা মনে পড়ে তাঁর ঠাকুরদার আমলের কথা। বাড়ির বাগানে গর্ত খুঁড়ে মশলা-মাখা মাংসটা তখন মাটির হাঁড়িতে ঢাকা-চাপা থাকত। মাঝেমধ্যে বার করে শিক দিয়ে একটু ঠেসেঠুসে ফের মাটির গর্ভে। এই ভাবে ছ’-সাত দিন। বার করে একটু ফুটিয়ে নিলেই জন্ম নেবে দেবভোগ্য বস্তুটি। যার নাম সল্ট-মিট। একেলে হেঁসেলেও এর জন্যই মাটির বাসনের আলাদা কদর।
শহরের প্রবীণ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নাগরিক ওয়ারেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু রান্না তাঁর নেশা। সল্ট-মিটে নুন-লেবু-আদা-ভিনিগার ছাড়াও একটু গুড়ের ছোঁয়া লাগে। স্যান্ডউইচ হোক বা শুধুমুদু, এমন তুলতুলে মাংস না কি হয় না! ফি-বড়দিনে বাড়িতে নিজের হাতে এই সল্ট-মিট সৃষ্টি নিয়ে ওয়ারেনের খুঁতখুঁতুনির শেষ নেই।
তবে শুধু ওয়ারেনই নন, বো ব্যারাক্স, কলিন লেন বা মফস্সলেও অ্যাংলো-ঘরে এই মজানো গোমাংস ছাড়া ক্রিসমাস বলেই মনে হবে না। বাঙালি ক্রিশ্চান ঘরেও ক্রমশ জনপ্রিয় বস্তুটির নাম নোনা-মাংস। ওয়ারেনের কথায়, “কলকাতায় সল্ট-মিটের জন্য পলকের মতো ফুরিয়ে যাওয়া এই ক’টা ঠান্ডার দিনই তো ভরসা। এ তল্লাটে শীত ছাড়া এ জিনিস নামবে না।”
নোনাপুকুরের মারিয়া ফার্নান্ডেজের স্মৃতিতে ছোটবেলায় বড়দিনের আগে বড়দের সঙ্গী হয়ে নিউমার্কেটের বল্ডউইনের বাজারে মাংস কিনতে যাওয়ার হইচই। গোয়ান এই পরিবার তিন পুরুষ হল ঘোর ক্যালকাটান। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে তাদের বাদ্যযন্ত্রের দোকান। বড়দিনে গুচ্ছের ঘরোয়া কুকিজ ‘কলকল’ বা ‘রোজ কুকিজ’ ভাজা ছাড়াও বিশেষ পর্ক-পদ সরপটেল ছাড়া গোয়ান-ঘরের বড়দিন মোটেও জমবে না।

কেক, ক্রিসমাস ট্রি, সান্তাক্লজের টুপি কেনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রংবেরঙের এই স্বাদ-গন্ধে ঘরে ঘরে রঙিন কলকাতার বড়দিন। পাড়ার দোকানেও সস্তার কেক বা ক্রিসমাস হ্যাম্পার। নিউমার্কেটে নাহুম-এর চকোলেট ফাজ-সুগন্ধী মার্জিপ্যান-আখরোট ব্রাউনির মহিমাও বড়দিনে বৃদ্ধি পায়।
বো ব্যারাক্সে বড়ুয়াদের দোকানে চিরকেলে ক্রিসমাস কেক ছাড়া অ্যাংলো-ঘরের অনবদ্য ছানার কেকের কদর। এই বড়দিনে ফ্লুরিজ দেশ-বিদেশের চকোলেট ও স্পেশাল টার্কি-পদের আয়োজনে ব্যস্ত। রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের সালদানহার মতো কিছু পারিবারিক বেকারিরও মহা রমরমা।
মধ্যবিত্ত ‘টিপিন-বাক্সে’ নানা গোত্রের এ সব কেকই দুপুরের চিড়িয়াখানায় লুচি-আলুরদম বা পিকনিকের প্রাতরাশে জয়নগরের মোয়ার প্রতিবেশী। অভিজাত ক্লাবের ব্রাঞ্চশেষে এক খণ্ড উচ্চাঙ্গের কেকে কামড় দিয়ে কারও চোখ আবেশে বুজে আসবে।
রাতভর সিকিউরিটি গার্ডের ডিউটি সেরে লোকাল ট্রেনে বাড়ি ফেরার পথে কোনও ক্লান্ত বাবা হয়তো ছেলেমেয়ের জন্য কেক কিনতেই স্টেশন রোডের দোকানটায় দাঁড়াবেন!

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.