ব্যাগ গুছিয়ে...
রূপের খনি বান্দাপানি
বীরপাড়া মানেই চা-পাড়া। রেলস্টেশন দলগাঁ। তার পর থেকে বান্দাপানির পথে সিংহানিয়া, বীরপাড়া, দলমোর চা বাগান, পথে পথে চায়ের ঘ্রাণ। টাটে শিরীষের আলো-ছায়ায় হরিৎ মখমলের সেই বাগিচাগুলি দেয় দৃশ্য-সুখ। তার মাঝে জুড়ল ফরেস্ট চ্যানেল মোরাঘাট। এবং গারোবস্তি। অতঃপর সেই হা-হা নদী সুক্তি। এ নদী গাভীন হয় বর্ষাকালীন ধারাপাতে। বাকি সময়টা সে বয়ে চলে জলের জটাজলে। এই এখন যেমন, শীতে সে এক পেট কুয়াশা গিলে খানিক দৃষ্ট, বাকিটা অস্ফুট। উত্তরে একরাশ গিরিশৃঙ্খল ধরা দিয়েছে। নদীর উৎসস্থল ওই ভুটান হিল। বর্ষার তাড়ায় নামার সময় কয়েক গাছের ঝুঁটি ধরে নামিয়ে এনে নদীর বুকে চিরমুক্তি দিয়ে গেছে খুনে সুক্তি। সেই ভারী গাছের অস্থিপঞ্জর পড়ে আছে নদীর মাঝে। পাথর এনে ছড়িয়ে দিয়েছে তার বুকে। সেই নদী পেরিয়ে এসে পড়লেন বান্দাপানি বিট-এ। জঙ্গল শেষে গারোচিরা গ্রামটাও পেরল। ততক্ষণে পাহাড় সরে এসেছে হাতের নাগালে। তার আস্তিনে লুকোনো আছে আরও এক নদীর খেলা-খাখার খোলা।
বান্দাপানি যে রূপের খনি, গাড়ি থেকে নেমেই টের পেয়েছেন। নদী-পাহাড়-জঙ্গল, তার কিনারে বনবাংলো এঁকে রেখে গেছেন কোনও মহাজন। আপনি বাংলোর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পায়ের নীচে পান শীতার্ত নদী খাখার। তার ওপারে টানটান পাহাড়ি ভুটান। ততক্ষণে চৌকিদার বোঝায় এসে, ওই তিনধরিয়া ঝর্নায় এই নদীর রচনা। অন্য দিকে, সুক্তি হিলের ধারায় সুক্তি নদীর জন্মকথা। ফলে দুই নদীর চাপে পড়েছে বান্দাপানি। নদীর পাশে কুর্সি পেতে দেখুন পাহাড়ি শোভা। আপনার পায়ের প্রান্তে ভারত-ভুটান সীমান্ত। পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে লালি, লাটোর, ময়না, গোকুল বৃক্ষরাজি। শীতের ধূসর বিকেলে ঝর্না ধারায় স্পটেড চিতল এসে দাঁড়ায়, জল চাটে নীরবে। পাহাড় থেকে নামে ‘গাইবুড়া’ (ময়াল) খাদ্য লোভে। বাহাদুর জঙ্গলের ফাঁদে বির লরং (বুনো লতা) কাটতে গিয়ে ডুমসিদাঁড়ায় হাতির তাড়ায় পড়ে গাঁয়ে ফেরে ত্রস্ত পায়ে। সে খবর দেয় মসালেভির, খানাভার্তির পাহাড় পিঠে ঢোল (বন্য কুকুর) ঘোরে। চিতাবাঘ, হায়নার ভ্রুকুটি। নৈঃশব্দ্য জখম করে চকিতে ডেকে উঠছে হাংরায় (ধনেশ) গঁ-ক্। তার পর একজোড়া ডানা ছড়িয়ে আকাশের নীল ট্র্যাকে উড়ান দেয়, গোমতু পাহাড়ের দাঁড়ায়। এ দৃশ্য হামেশাই। কোথায় লসুনির পাকা ফলের লোভে বাইসনের হার্ড ঘোরে। বহড়া গাছের নীচে হরিণের ঝাঁক। এলুয়া ঘাসের টানে, ইকড়ি লতা, খরকি তৃণর লোভে, টুটুয়ার খোঁজে ঢোকে কোটরার দল। দেওঘণ্টা (ঝিঁঝি) বেজেই চলে একটানা বনের গভীরে ক্রিক...ক্রিক...ক্রিক। টোটোলা গাছের মাথায় চাকভরা মৌ-ভাণ্ড। প্রাক্ বসন্তে রসস্থ চিউরি ফুলে উড়ে বসে মধুপকুল।
ডুমসিদাঁড়া দিয়ে পাগলিভুটান ১০ কিমি। পাহাড়ের টং-এ ছোট ছোট ভুটানিপাড়া। তাদের পলকা জীবন শ্বাপদে সরীসৃপের সর্বনাশে ঘেরা। ওই সব মঙ্গোলীয় জীবন কী ভাবে বাঁচে দেখুন দক্ষ গাইড যোগে। রাইতি বস্তি, পানবাড়ি, কালাপানি হয়ে মসালেভির-ডুমসি খোলার ধারে দেখুন ‘খার’ (লবণ) চাটতে আসে শ্বাপদকুল। পাহাড়ি ট্রেকে ঢোলে গাঁ, আঁধেরি ছেড়ে আলোদাঁড়া গ্রাম ছুঁয়ে নেমে আসুন গারোচিরা নেপালিপাড়ায়। খাখার নদীর পিঠের উপর ভুটান পাহাড়ের ঢালে সুতো ঝর্নার কিনারে জমিয়ে ফেলুন শীতের বনভোজ। আমরাও মেতেছিলাম এক বার পরদেশি পিকনিকে। শীত-রোদ পিঠে নিয়ে সে এক সর্বনেশে খেলা। মাথার উপরে হাতির বৈঠক, ঝর্নার ধারে অজগরের ঠেক, সব তুচ্ছ করে ফুসরো কাঠের আগুনে ইটের চুল্লিতে ফুটছে রেওয়াজি খাসির রাং। ও দিকে পাহাড়ি ধুন বাজে নেপালি টেপ-এ। কাদাখোঁচা পুচ্ছ তুলে দোল খায় গুয়েলু লতায়। পাচক বলে, গাড়িকে চালু রাখুন। যে কোনও সময় বনভোজ ভেস্তে যাবে গণেশজির তাড়ায়। এ দিকে বুকে উচাটন, অপর দিকে হাতিপাওলে পাতায় ঢালা গরম মাটন, নুনিয়া চালের ভাত, এই তিনে সেবারে শীত ভোজের কিস্তি মাত।
চিররুগ্ণ বান্দাপানি বাগানখানি নিকটেই। মাঝে মাঝে তার আরোগ্য হলে হুটার বাজিয়ে হাট খোলে। তখন এ দেশ ও দেশ জুড়ে ক্রেতা নামে। অন্যথায় গোমতু পাহাড়ের কোলে হাটখানি সারা পাহাড়কে তাড়িয়ে আনে ফি রবিবার। বান্দাপানিকে ঘিরে আছে মৃত-জাগ্রত বেশ কতক চা বাগিচা। মাকড়াপাড়া, ঢোকলাপাড়া, লংকাপাড়া, নাংডোলা, কাঁঠালগুড়ি। সুস্থ বাগানে কর্ম কোলাহল, রুগ্ণ বাগান নীরব-শীতল। অভাবের শিকড়-বাকড় ছড়িয়ে বসে থাকে স্তব্ধ কুলি লাইন। অস্থিসার মানুষগুলি কাঠ কুড়োতে জঙ্গলে যায়। যেটুকু পায় হাটে বিকিয়ে ঢ্যাপা ভাতের দানা খায়। অন্যথায় বনজ খাদ্য কাঠমুটিয়া শাকের সঙ্গে বান্দ্রা পাতা (টক) ঘুঁটে খাওয়া। কাশিয়া আলু, গেঠি, কুলহু কন্দর বিষ নিংড়ে ‘লটং ভটং’ আহার। বামন বৃক্ষ দোহন করে কেউ টাকার পাহাড় গড়ে, কেউ কুলি ব্যারাকে ক্ষুধায় মরে। আপনার ভ্রমণ ছক সেই জীবন পরিক্রমা ছুঁয়ে থাকে।
খাখার নদীর রুট ধরে যাবেন ভুটানের পেনডেন। ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ। অনাবিল শহর, পাতলা বসতি। পাহাড়ের পিঠে ঝুলে থাকা তক্তা-বাড়ি। জীবনের প্রতি পদে মানুষের চড়াই উতোর। তার কোলে স্কুল চলে, বাজার বসে, অফিস খোলে। ট্রাফিক পুলিশ পেনডেলের পথ পাহারায়। সেই পথে স্বল্পবাক অল্প পথচারী, ক্রেতাহীন দোকান। যেন এক নিঝুম দেশে এসে পড়েছেন। শুধু প্রকৃতি এখানে প্রগলভ। সে রূপের ডালি মেলে বলে,
‘মোর দানে নেই দীনতার লেশ,
যত নেবে তুমি না পাবে শেষ।’

কী ভাবে যাবেন
শিয়ালদহ থেকে রাতের কাঞ্চনকন্যায় পর দিন সকালে
দলগাঁ স্টেশনে নেমে গাড়িতে ১৩ কিমি বান্দাপানি।
কোথায় থাকবেন
বন বিভাগের দু’কামরা বাংলো আছে। ফোন নম্বর ০৩৫৬১-২৩২০১৬।
অন্যথায় গারোচিরা গ্রাম পর্যটনের সুদৃশ্য কটেজ।
সঙ্গে থাকবে
মিনারাল ওয়াটার, মশার মলম, বীরপাড়া থেকে পর্যাপ্ত রেশন, বাজার।

ছবি: রঞ্জন মুখোপাধ্যায়




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.