দুইটি শব্দ ইংরাজি ‘জাস্টিস’-এর প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে বাংলা ভাষায়। নীতি এবং ন্যায়। অমর্ত্য সেন তাঁহার ‘দি আইডিয়া অব জাস্টিস’ গ্রন্থে নীতি এবং ন্যায়ের পার্থক্য সম্পর্কে বিশদ বিচার-বিশ্লেষণ করিয়াছেন। মূল কথাটি ইহাই যে, নীতি বলিতে নির্ধারিত বিধি এবং ব্যবস্থা মানিয়া চলিবার নির্দেশ বোঝানো হয়, সেই ভাবে চলিবার কী পরিণাম হইতেছে তাহা বিচার করা হয় না। বিধিব্যবস্থা অনুসরণ করিয়া কী ফল পাওয়া গেল, কোন পরিণামে উপনীত হওয়া গেল, ‘ন্যায়’ বলিতে সেই সকল বিষয়ের সন্ধানও প্রাসঙ্গিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিতে পারেন, তিনি কেবল মাত্র নীতির অনুশাসন না মানিয়া ন্যায়ের দাবি পূরণ করিতে চাহেন, সেই কারণেই শেষ অবধি ২৮ ফেব্রুয়ারির মাধ্যমিক পরীক্ষাটি পিছাইয়া পরের দিন গ্রহণ করিবার নির্দেশ দিয়াছেন। ওই দিন শ্রমিক সংগঠনগুলির ধর্মঘট, ধমর্ঘটের দিন পরীক্ষার্থীরা সমস্যায় পড়িতে পারে, বস্তুত সেই দিন প্রকৃত সমস্যা যেমনই হউক বা না হউক, তাহার দুশ্চিন্তা পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের পক্ষে দুর্বহ হইতে পারে। তিনি চেষ্টা করিয়াছিলেন, যাহাতে ধর্মঘটের দিন বদলানো হয়, উদ্যোক্তারা সেই অনুরোধ রাখেন নাই, সুতরাং পরীক্ষার্থীদের মুখ চাহিয়া তিনি পরীক্ষার নির্ঘণ্ট বদলাইয়াছেন। নীতি, অর্থাৎ বিধি এবং ব্যবস্থা অক্ষরে অক্ষরে মান্য করিলে মুখ্যমন্ত্রী পরীক্ষা পিছাইতেন না, বলিতেন, হাকিম নড়িতে পারে, হুকুম নড়ে না, পরীক্ষা যে দিন হইবার কথা সেই দিন হইবে, উহাই ‘নীতি’। কিন্তু সেই নীতির পরিণামে বহু মানুষের অসুবিধা হইত, সুতরাং তাঁহার সিদ্ধান্ত ‘ন্যায়’সঙ্গত হইত না। এই যুক্তি প্রণিধানযোগ্য।
কিন্তু ইহার পরেও একটি কথা বলিবার আছে। এক বার কঠোর ভাবে ‘নীতি’নিষ্ঠ হইলে হয়তো তিনি ধর্মঘটের উদ্যোক্তাদের একটি শিক্ষা দিতে পারিতেন। ওই দিন পরীক্ষার্থীরা সমস্যায় পড়িলে সেই সংকটের পরিস্থিতি হয়তো ভবিষ্যতে ধর্মঘটের আয়োজকদের সংযত করিতে পারিত, তাঁহারা অনুরূপ পরিস্থিতিতে পিছাইয়া আসিতেন, ধর্মঘটের দিন বদলাইতেন। অন্তত তাহার একটি সম্ভাবনা রচিত হইত। এ ক্ষেত্রে তাহার কোনও সম্ভাবনা নাই, ধর্মঘটীরা বুঝিয়া গেলেন, তাঁহারাই জয়ী। আপাতত ‘ন্যায়’ রক্ষিত হইল হয়তো, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি বিচারে মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে ন্যায় রক্ষিত হইল, এমন সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। ‘পরিণাম’ কেবল এই একটি দিনের একটি পরীক্ষার প্রশ্ন নয়, ভবিষ্যৎ পরিণামও বিচার্য বইকী। সুতরাং ন্যায়ের যুক্তিতেই রাজ্য প্রশাসন কঠোর হইতে পারিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সুযোগ হারাইলেন।
এবং গুরুদাস দাশগুপ্তদের প্রবল আত্মশ্লাঘার সহিত এই কথা বলিবার সুযোগ করিয়া দিলেন যে, ‘সবার উপরে ধর্মঘট সত্য’। এই বামপন্থী ধর্মঘটের আয়োজকরা শত উপরোধেও ধর্মঘটের দিন বদলাইতে রাজি হন নাই। হইবেনই বা কেন? তাঁহারা তো সত্যই মনে করেন, যাহার যত সমস্যা হয় হউক, তাঁহারা যখন পবিত্র ধর্মঘট ডাকিয়াছেন তখন তাহাই শেষ কথা। মূল্যবৃদ্ধি আদি যে সব দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য তাঁহারা এই ধর্মঘটের ডাক দিয়াছেন, তাহা এক দিনের ‘প্রতীক’ ধর্মঘট করিয়া কী ভাবে সমাধান করা সম্ভব, সেই রহস্য সম্ভবত তাঁহাদের কেতাবেই গুপ্তভাষায় লিখিত আছে, থাকিবেও। কিন্তু প্রশ্নটি এ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যের নয়, বিধেয়ের। নামে ধর্মঘট হইলেও কার্যত এই ধরনের উদ্যোগ বন্ধেই পর্যবসিত হইয়া থাকে, যাঁহারা কাজ করিতে ইচ্ছুক তাঁহারাও অনেকেই অগত্যা কর্মহীন থাকিতে বাধ্য হন। কিন্তু তাহা লইয়া উদ্যোক্তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা দেখা যায় না। এই মানসিকতাই পরীক্ষার দিন বন্ধ পড়িলেও ‘দিন বদলাইব না’ বলিয়া পণ করিবার প্ররোচনা দেয়। দুর্ভাগ্য দেশের তথা রাজ্যের, এই মানসিকতাই শেষ অবধি জয়ী হইল। সবার উপরে ধর্মঘটই সত্য হইল। |