|
|
|
|
কলকাতার ঠান্ডায় লন্ডনের আঁচ |
ঋজু বসু |
মোবাইলে এই বার্তা রটি গেল ক্রমে...
‘ক্রমে’ মানে, শুক্রবার সাতসকাল থেকে। হি-হি ঠান্ডায় চান সেরে
বেরোতে যতই মেজাজ তিরিক্ষে হোক, এসএমএসটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল মোবাইল থেকে মোবাইলে ‘দিদি কথা রাখছেন। কলকাতা তো এখনই লন্ডন হব-হব করছে।’
উত্তর কলকাতার রাজা নবকৃষ্ণ দেব স্ট্রিটে খাস বিলেত থেকেই ফোন এসেছিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। ইন্টারনেটে কলকাতার আবহাওয়ার খবর জেনেই লন্ডন-প্রবাসী কন্যা কৃষ্ণঅর্চনা বসু ফোন করেন মা নন্দিনী দেব-কে। শাল-মোজায় জবুথবু মা ফোন তুলতেই মেয়ে গড়গড়িয়ে বলে চলেন, “মা দেখছ, কাণ্ডটা! কলকাতায় পারদের ওঠা-নামাও এখন লন্ডনের গায়ে-গায়েই চলছে!’’
সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার কিছু দিন আগেই আমেরিকার কলম্বাস শহরের শীত টের পেয়ে ফিরেছেন। তবু কলকাতার শীতকে সমীহ করে তাঁর মন্তব্য, “লন্ডনের ‘ল’-টা অন্তত কলকাতার এ বার হল!” তাঁর ব্যাখ্যা, “এই ‘ল’ মানে আইন-শৃঙ্খলা নয়। ২৫ বছরে এই প্রথম কলকাতায় ‘ল’ মানে লেপের ব্যবস্থা করতে হল। অ্যাদ্দিন কম্বলেই দিব্যি রাত কাবার হত।” |
|
গত পুরভোটের আগেই কলকাতাকে লন্ডন বানানোর কথা বলে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লন্ডন হয়ে ওঠার চেষ্টা কলকাতার জন্য কতটা স্বাস্থ্যকর, তা নিয়ে তর্কও শুরু হয়েছিল। শীতের দৌলতে সেই গপ্পোই যেন ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া!’ ফেসবুকের ‘স্টেটাসে’ চার-পাঁচ দিন আগেই সরকারি হাসপাতালের এক ডাক্তারবাবুর রসিকতা: ‘সকাল ছ’টায় উলুবেড়িয়া, পুরো সাইবেরিয়া!’ শুনে লন্ডন থেকে তাঁর এক পুরনো বন্ধু পাল্টা দিলেন! ‘ওই ৯-১০ ডিগ্রি তাপমাত্রা মানে শীত নয়, বড়জোর বিলেতের অটম বা হেমন্ত’। সাইবার-দেওয়ালের তর্কযুদ্ধে এক কলকাতাবাসী সঙ্গে সঙ্গে শুনিয়ে রাখলেন, ‘মনে করে দ্যাখ, কলকাতায় শেষ কবে গাড়িতে ‘কার-ওয়ার্মার’ চালু
করতে হয়েছিল?’
দুর্লভ শীতের উৎসাহে ফুটতে ফুটতে তুলনামূলক আলোচনায় একটু ‘বাড়াবাড়ি’ ঘটে যাচ্ছে কি? হাওয়া-অফিসের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ তো আর গালগল্পে মজবেন না! আবহবিজ্ঞানীর কাঠ-কাঠ চুলচেরা হিসেব বলছে, “কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা লন্ডনের সর্বোচ্চের কাছাকাছি গিয়েছে, এটুকুই যা।” আলিপুরের আবহাওয়া দফতরের হিসেবে, বৃহস্পতিবার এ মরসুমের শীতলতম দিনে মহানগরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ১০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। লন্ডনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সে-দিন ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুক্রবার কলকাতার তাপমাত্রা সামান্য বেড়ে ১১.৩ ডিগ্রি। লন্ডনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা মোটামুটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। তার মানে কলকাতার ভোর ছুঁয়েছে আসলে লন্ডনের দুপুরকে!
কলকাতাকে লন্ডন বানিয়ে তোলার বিতর্কে এক সময় জড়িয়ে পড়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবে তাপমাত্রার নিরিখে লন্ডন ও কলকাতার তুলনায় যে তাঁর একটুও ‘রুচি’ নেই, তা এদিন স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান তথা সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। যাঁর কথায়, “লন্ডন আবার কী? তিন মাস বাদে যখন কলকাতা গরমে হাঁসফাঁস করবে, তখন কি সেটা ফন্ডন হবে?” এ শহরে বড়দিনের ছুটি কাটাতে আসা লেস্টার-প্রবাসী তরুণ ডাক্তার পার্থজিৎ দাসও শীত নিয়ে কলকাতার এই ‘আদিখ্যেতা’য় হেসে খুন। তিনি বলছেন, “বাঙালিদের সবটাতেই বাড়াবাড়ি। এটা বড়জোর লন্ডনের সামার। কলকাতা সত্যি লন্ডন হলে ঠান্ডা কাকে বলে মালুম হত!” |
|
উষ্ণ পরশ: শীত থেকে বাঁচতে কম্বলই ভরসা ফুটপাথবাসী
দম্পতির।
কলকাতায় দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি। |
রসিক বাঙালি অবশ্য এত হিসেবনিকেশের ধার ধারেন না! লন্ডনের সঙ্গে নিজের শহরের তুলনাটা ভালই উপভোগ করছেন তাঁরা। মমতার দলের সহযোগী ও রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় হেসে বলছেন, “আ-হা লন্ডন না হোক, লন্ডনের আমেজ তো বলাই যায়!” যৌবনে অনেকটা সময় লন্ডনে কাটিয়ে আসা প্রবীণ লেখক হিমানীশ গোস্বামী বলছেন, “যা ঠান্ডা, তাতে লন্ডন না-বলে লণ্ডভণ্ডই বলা যায়। উপমহাদেশের লোকের ভিড়ে আজকের লন্ডনটাই তো প্রায় কলকাতা হয়ে গিয়েছে। তা কলকাতা একটু-একটু লন্ডন হলে ক্ষতি কী?” সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মনে পড়ছে বিশ্বযুদ্ধের কলকাতায় খুব শীত পড়েছিল। তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রিতে নেমেছিল। তাঁর কথায়, “সে-কালের শীতের টাটকা সব্জি, জাপানি আপেল-আঙুর, দার্জিলিঙের কমলালেবু--- কিছুই তো আগের মতো নেই। তা ঠান্ডাটা আগের মতো হলে মন্দ কী? অল্প বয়সে গাঁধীজির লেখা পড়ে লন্ডনের সকালেও তেড়েফুঁড়ে ঠান্ডা জলে চান করেছি। কিন্তু এখন বোধহয় নিজের তাপ মাপবার যন্ত্রটাই বুড়ো হয়েছে। কলকাতার শীতেই আমি কাবু এ বার!” সদ্য বিলেতে মেয়ের কাছে বেড়িয়ে ফেরা নন্দিনীদেবীর মতো কেউ কেউ মনে করাচ্ছেন, “যে যাই বলুক, লন্ডনে হিটারের ব্যবস্থায় বাড়ি বা অফিসে কষ্ট ঢের কম। এখানে জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে যা হাওয়া ঢুকছে!”
আসলে শীতের ‘ওপেনিং স্পেল’-এ এই ধাক্কাটা কলকাতার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। অন্য বছরে শীত বাড়ে ধাপে ধাপে। আবহবিদদের মতে, সবই আসলে উত্তর ভারতে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার খেলা! তবে বাকি শীতটা কলকাতার কপালে কী আছে, তা নিয়ে এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা মুশকিল। আপাতত সাত সকালে বাইরে বেরোনোর হাড়-কাঁপুনিটা কেউ কেউ রোজই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। রেডিও-টিভি সঞ্চালক মিরের কথায়, “হপ্তায় ছ’দিন এফএম-এর ‘ব্রেকফাস্ট শো’ করতে বেরোতে কান্না পেয়ে যায়। রাস্তার কুকুরগুলোও তখন ঘুমিয়ে। দারোয়ানেরাও কম্বল মুড়ি দিয়ে আয়েস করেন।”
কলকাতা কলকাতায় থাক বা লন্ডন হোক, একটাই ভয় শুধু এর মধ্যে কাজ করছে। মিরের কথায়, “এত ঠান্ডায় কলকাতাকে লন্ডন বানানোর প্রোগ্রামটা আবার ঠান্ডা মেরে যাবে না তো!” |
|
|
|
|
|