সিঙ্গুরের ছায়াতেই প্রশ্নের মুখে রাজ্যের লগ্নি-ভবিষ্যৎ
রকার জল-জমি-কয়লার বন্দোবস্ত করে না দিলে রাজ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার পথে তারা হাঁটবে না বলে প্রথম দিনেই জানিয়ে দিয়েছে লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো (এলঅ্যান্ডটি)। ফলে সলতে পাকানোর আগেই এই প্রকল্পের প্রদীপ নেভার বন্দোবস্ত হয়ে গেল বলে আশঙ্কা রাজ্য প্রশাসনের একটা বড় অংশের। তাদের বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নতুন জমি নীতির প্রথম বলি যদি হয় কাটোয়ার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, তা হলে দ্বিতীয়টি এলঅ্যান্ডটি-র বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
অর্থাৎ, সিঙ্গুরের ‘ফল’ হাতেনাতে ফলতে শুরু করেছে!
জোর করে জমি অধিগ্রহণ করার অভিযোগ তুলে সিঙ্গুরে ‘ন্যানো’ গাড়ি তৈরির কারখানার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল তৃণমূল। তার জেরে এ রাজ্য থেকে কারখানা তুলে গুজরাতের সানন্দে নিয়ে চলে যায় টাটা মোটরস। সেটা ২০০৮ সালের ঘটনা। তিন বছর পরে ক্ষমতায় এসে বেসরকারি সংস্থার জন্য কোনও রকম জমি অধিগ্রহণ না-করার যে নীতি তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন সরকার গ্রহণ করেছে, তার জেরে নতুন শিল্প প্রকল্প তৈরির পথ তো তৈরি হচ্ছেই না, অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বাম আমলে শুরু হওয়া একাধিক প্রকল্পও।
যেমন কাটোয়ায় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের (এনটিপিসি) তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ১১০০ একর জমির মধ্যে ৫৫০ একরের দাম জমি মালিকদের মিটিয়ে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিল আগের বামফ্রন্ট সরকার। বাকি জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া যখন শেষের মুখে তখনই ভোটের দামামা বেজে যায়। ফলে কাজ বন্ধ থাকে।
নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই জানিয়ে দেয়, কাটোয়ায় আর জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। সাত মাস টানাপোড়েন চলার পরে বুধবার রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী মনীশ গুপ্ত জানান, বাকি জমি এনটিপিসি-কে কিনে নিতে হবে। রাজ্যের ভূমি ও বিদ্যুৎ দফতরের কর্তাদের একাংশের আশঙ্কা, নতুন জমি নীতিতে জমির দাম, ১০০ শতাংশ সোলাসিয়াম, চাকরি-সহ ক্ষতিপূরণের যে ‘প্যাকেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে, জমির মালিকরা সেই দাবি করে বসলে এক ছটাক জমিও কেনা যাবে না। এমনকী, যে জমি ইতিমধ্যেই সরকারের হাতে এসেছে, তার মালিকেরাও এই সুযোগে নতুন ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন। তাই ১৬০০ মেগাওয়াট এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ল বলেই মনে করছেন তাঁরা।
সরকারের হাতে জমি রয়েছে।
কিন্তু লগ্নিকারীরা যদি নিজের পছন্দের
জায়গায় জমি চান, তা হলে তা দেওয়া
সম্ভব না-ও হতে পারে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শিল্পমন্ত্রী
জমি নেওয়াটা বেসরকারি
হাতে দিলে কৃষকের স্বার্থ রক্ষিত
হবে না। শিল্পের সঙ্গেই চাষির স্বার্থে
সরকারের ভূমিকা থাকা উচিত।
নিরুপম সেন, প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী
এই জটিলতার মধ্যে ঢুকতেই চায়নি এলঅ্যান্ডটি। শিল্প দফতরের এক কর্তার কথায়, “প্রথম রাতেই বেড়াল মেরে দিয়েছে ওরা।” কিন্তু তার ফলে ১৬০০ মেগাওয়াটের প্রস্তাবিত এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা যে কার্যত নেই সেটাই মেনে নিচ্ছেন তিনি।
সরকারি সূত্রে খবর, এই প্রকল্পের জন্য ১২০০ একর জমি চেয়েছিল এলঅ্যান্ডটি। মুখ্যমন্ত্রী ও বিদ্যুৎমন্ত্রীর সঙ্গে দু’দফায় বৈঠক করেন সংস্থার কর্তারা। রাজ্য তাঁদের জানিয়ে দেয়, সরকারের হাতে একলপ্তে ১২০০ একর জমি নেই। এই অবস্থায় দু’টি জায়গায় শিল্পের জন্য চিহ্নিত প্রায় হাজার একর জমি নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় সংস্থাটি। একটি পুরুলিয়ার আদ্রায়। এখানে রেলের জমিতে এনটিপিসির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ার কথা থাকলেও তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই জমি পাওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয় রাজ্য। দ্বিতীয় জমিটি বর্ধমান জেলার রূপনারায়ণপুরে একটি বন্ধ কারখানার। সেই জমি নিতে গেলে আবার ওই কারখানার কয়েকশো কোটি টাকার আর্থিক দায় ঘাড়ে নিতে হবে। যাতে স্বাভাবিক ভাবেই রাজি নয় এলঅ্যান্ডটি।
শুধু কাটোয়া বা এলঅ্যান্ডটি-র ঘটনাই নয়। গেঁওখালিতে জাহাজ তৈরির কারখানা কিংবা জামুরিয়ায় ভূষণ স্টিলের ইস্পাত প্রকল্পের জমি না-মেলায় সেগুলির ভবিষ্যৎও কার্যত অনিশ্চিত। জমি ও অন্যান্য সমস্যায় আটকে রয়েছে পড়েছে রঘুনাথপুরের তিন ইস্পাত প্রকল্প জয় বালাজি, আধুনিক ও শ্যাম স্টিল। শিল্প দফতর সূত্রে খবর, পুরনো-নতুন মিলিয়ে মমতার সরকারের কাছে বিনিয়োগের যে প্রস্তাবগুলি জমা পড়েছে, তাদের অধিকাংশের জমি সংস্থানের ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি শিল্প দফতর। প্রস্তাবগুলির মধ্যে রয়েছে: রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর ৫০০ কোটি টাকার সিমেন্ট প্রকল্প, পানাগড়ে হিন্দুস্থান ন্যাশনাল গ্লাস সংস্থার ৩৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প, টেক্সম্যাকো রেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থার ৩২২ কোটি টাকার ইস্পাত প্রকল্প, জোকায় টেকনো ইন্ডিয়ার হাব তৈরির ১০০০ কোটি টাকার প্রকল্প ইত্যাদি।
শিল্পে লগ্নির সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জমি থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নেওয়ায় সমস্যা ক্রমেই বাড়বে বলে মনে করছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। তাদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের মতো ছোট জোতের মালিকানাধীন রাজ্যে কোনও লগ্নিকারীর পক্ষে বেশি জমি কেনা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই ‘মধ্যস্থতাকারী’-র ভূমিকা নিতে হবে। প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন বলেন, “জমি নেওয়ার পুরো কাজটা বেসরকারি হাতে ছেড়ে দিলে ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে কৃষকের স্বার্থ রক্ষিত হবে না। তাই শিল্পের পাশাপাশি কৃষকের স্বার্থেও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা উচিত।” হাওড়ার ফাউন্ড্রি শিল্প এবং ট্রাক্টর ইন্ডিয়ার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “ওরা শেষ পর্যন্ত জমি কিনতে না পেরে রাজ্যের কাছেই এসেছিল।”
একই আশঙ্কা শিল্প মহলের। তাদের বক্তব্য, জমির সমস্যা গোটা দেশেই রয়েছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম তাতে আরও ইন্ধন জুগিয়েছিল। কিন্তু অন্য রাজ্য যখন নানা ভাবে জমি সমস্যা এড়াতে তৎপর, তখন পশ্চিমবঙ্গ আরও জটে জড়িয়ে যাচ্ছে। এ দিন ভারত চেম্বারের এক অনুষ্ঠানে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সামনে চেম্বারের প্রেসিডেন্ট পবন পোদ্দার বলেন, “শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল জমি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে গোটা দেশেই জমি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও বাস্তবসম্মত নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গই গোটা দেশকে পথ দেখাক।”
শিল্পমন্ত্রী অবশ্য জমির কোনও সমস্যা আছে বলে মনে করেন না। তাঁর কথায়, “সরকারের হাতে জমি রয়েছে। কিন্তু লগ্নিকারীরা যদি নিজের পছন্দের জায়গায় জমি চান, তা হলে তা দেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে।” শিল্পমহল সূত্রে খবর, রাজ্যের কাছে এখন শিল্প প্রস্তাব নিয়ে গেলেই অশান্ত জঙ্গলমহলে যেতে বলা হচ্ছে। শিল্পপতিদের বক্তব্য, সব শিল্পেরই নিজস্ব কিছু পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা দরকার। যেমন বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য চাই জল, কয়লাও যোগাযোগের সুবিধা। জঙ্গলমহলে সেই প্রকল্প কী করে সম্ভব!
আবার সরকারের হাতে থাকা জমি শিল্পের জন্য কতটা উপযোগী, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। রাজ্যে ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ তৈরির কাজ চলছে। এ জন্য বিভিন্ন দফতর ও সরকারি সংস্থার হাতে থাকা জমির তথ্য চাওয়া হয়েছে। যদিও এই কাজ কবে শেষ হবে কেউ জানে না। ভূমি দফতরের এক মুখপাত্র জানান, ল্যান্ড ব্যাঙ্ক তৈরি হলে হয়তো দেখা যাবে সরকারের হাতে খালি জমির পরিমাণ এক লক্ষ একরেরও বেশি। কিন্তু সেই জমির কত অংশে শিল্প হওয়া সম্ভব? বিশেষ করে বড় শিল্প? তাঁর মতে, সেচ, পূর্ত, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, পশুপালনের মতো যে সব দফতরের হাতে খালি জমির পরিমাণ বেশি, সেখানে শিল্পের পরিকাঠামো নেই। আবার, ইস্পাত, বিদ্যুৎ, বিমানবন্দর, গাড়ি কারখানার মতো মেগা প্রকল্পের জন্য একলপ্তে বেশি জমিও পাওয়া যাবে না। ল্যান্ড ব্যাঙ্কের জমিতে বড়জোর ছোট ও মাঝারি প্রকল্প হতে পারে। পার্থবাবুর অবশ্য মন্তব্য, “বড় বিনিয়োগ মানেই বেশি জমি নাকি!”
কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে যে একলপ্তে অনেকটা জমি লাগবে, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। আর বিদ্যুৎই যে এই মুহূর্তে রাজ্যের অন্যতম বড় চাহিদা, সেটাও হাড়ে হাড়ে বুঝছেন মহাকরণের কর্তারা। এখন শীতের মরসুমে বিদ্যুতের চাহিদা অনেকটাই কম। তা সত্ত্বেও লোডশেডিং হচ্ছে নিয়ম করে। গ্রীষ্মের দিনে পরিস্থিতি কোথায় গড়াবে তা ভেবে কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে বিদ্যুৎ কর্তাদের।
আগামী পাঁচ-ছ’বছরের মধ্যে ৭৬৯৬ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে বলে বিধানসভায় আশ্বাস দিয়েছেন বিদ্যুৎমন্ত্রী মনীশ গুপ্ত। কিন্তু প্রথমে কাটোয়া আর তার পর এলঅ্যান্ডটি কিন্তু সেই আশ্বাস ঘিরে সংশয় তৈরি করছে।

তথ্য সহায়তা: দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত

জমির জটে
কোথায় কার প্রকল্প কী প্রকল্প বিনিয়োগ* জমি**
রঘুনাথপুর জয়বালাজি ইস্পাত ১৬,০০০ ২৩০০
আধুনিক সংস্থা ইস্পাত ৬৪০০ ১৫০০
শ্যাম গোষ্ঠী ইস্পাত ৩৫০০ ১১০০
গেঁওখালি বেঙ্গল শিপইয়ার্ড জাহাজ ২০০০ ৫৯০
বর্ধমান ভূষণ স্টিল ইস্পাত ৯৬০০ ২০০০
* (কোটিতে) **(একরে)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.