মদের পরে এ বার জলে বিষ! তা-ও নেহাতই ‘গুজব’। তা নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগের জেরে রীতিমতো ‘বিষাক্ত’ হয়ে উঠল সরকার ও বিরোধী পক্ষের সম্পর্ক!
বিধানসভার ভিতরে এবং বাইরে বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম মানুষ খুন করার ‘চক্রান্ত’ করে ‘মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি’ করার চেষ্টা করছে। সরকারের অভিযোগ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার নোদাখালিতে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের জল প্রকল্পে বিষ মেশানোর গুজব ছড়িয়েছিল সিপিএম। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী যেমন ওই অভিযোগ তুলেছেন, তেমনই সভাকক্ষের বাইরে বিধানসভা চত্বরেই এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, মদ, জল থেকে শুরু করে আইসিডিএস প্রকল্পের মিড ডে মিল সবেতেই বিষ মেশাতে চাইছে সিপিএম। মমতার সাফ কথা, “এদের রাজনীতি করার অধিকার থাকাই উচিত নয়! এর পরে যে কোনও ঘটনা ঘটলে সিপিএম দায় অস্বীকার করতে পারবে না!”
মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের জবাবে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “বিষের উৎস মুখ্যমন্ত্রীই। নিজেই বিষোদগার করছেন! গোটা পরিস্থিতি বিষাক্ত করার চেষ্টা করছেন। ‘নন-ইস্যু’কে ‘ইস্যু’ করছেন। নানা ঘটনা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে এই সব দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করছেন। দুরাত্মার তো ছলের অভাব হয় না!”
বস্তুত, বিষ মদ-কাণ্ডে বহু মানুষের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে সিপিএমের দিকে আঙুল তুলেছিল সরকার তথা শাসক দল। আমরি-র ঘটনা মোকাবিলায় সরকারের ‘তৎপরতা’র পিঠোপিঠিই বিষ মদের ঘটনায় প্রশাসনিক কিছু গাফিলতির অভিযোগ সামনে আসছিল। সেই সময়ে সরকারের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েও মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা সর্বদল বৈঠকে গিয়েছিল বামেরা। কিন্তু বিষ মদের ঘটনার প্রেক্ষাপট এ দিনের ঘটনায় নেই। অনেকটা ‘আচমকা’ই বিধানসভায় জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় জলে বিষ মেশানোর গুজবের কথা তোলেন। এমনকী, বিরোধীদের হইচইয়ের মাঝেই সুব্রতবাবু বিধানসভায় এমন মন্তব্যও করেন যে, “সিপিএম আগে মদে বিষ মিশিয়েছিল! এ বার জলে মেশাচ্ছে!”
ফলে এ দিনের আক্রমণে অনেক বেশি ‘ক্ষুব্ধ’ বিরোধীরা। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি যখন ‘সৌজন্য’ দেখাচ্ছেন, সিপিএম তখন ‘চক্রান্ত’ করছে। যার রেশ টেনে সূর্যবাবু বলেছেন, “সৌজন্যের সুযোগ মুখ্যমন্ত্রীই নিচ্ছেন! বিরোধী দলে থাকার সময়ে কোন সৌজন্য দেখিয়েছেন? তৎকালীন সরকার কোনও সৌজন্য দেখালে তার প্রত্যুত্তরটুকুও দেননি! তবে আমাদের চরিত্রের পরিবর্তন হবে না।” সরকার পক্ষের মন্তব্য ‘প্রত্যাহার’ করে ‘দুঃখপ্রকাশ’ না-করলে ‘বৃহত্তর আন্দোলনে’ যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়ে রেখেছেন তিনি।
বিতর্কের সূত্রপাত বিধানসভার দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই। নোদাখালির কাছে ডোঙারিয়ায় জনস্বাস্থ্য কারিগরির জল পরিশোধন কেন্দ্রে বিষ মেশানোর গুজব ছড়ানো হয়েছে, এই তথ্য বিধানসভায় জানান মন্ত্রী সুব্রতবাবু। সভায় উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের তীব্র আক্রমণ করেন। প্রবল প্রতিবাদ করে বিরোধীরা দাবি তোলেন, সুব্রতবাবুর বক্তব্যের কয়েকটি কথা সভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিতে হবে। পরে একটি বিল নিয়ে আলোচনার মাঝে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, মন্ত্রীর রেকর্ড-করা বক্তব্য শুনে তিনি বাদ দেওয়ার মতো কোনও শব্দ খুঁজে পাননি। স্পিকারের এই ‘রুলিং’-এর প্রতিবাদ জানিয়ে বিরোধীরা কক্ষত্যাগ করেন।
তার আগে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে মমতা সুব্রতবাবুর কাছ থেকে বিষ ছড়ানোর গুজবটি শোনেন। মুখ্যমন্ত্রী দ্রুত সুব্রতবাবুকে নির্দেশ দেন, বিষয়টি বিধানসভায় জানাতে হবে। সভা বসার সঙ্গে সঙ্গে সুব্রতবাবু বলতে থাকেন, বুধবার রাত থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, ডোঙারিয়ার জল পরিশোধন কেন্দ্রে বিষ মেশানো হয়েছে। তিনি জানান, স্পিকারও (বারুইপুর পশ্চিম কেন্দ্রের বিধায়ক) তাঁকে ওই গুজবের কথা জানান। সুব্রতবাবুর কথায়, “আমার দফতরের উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনিয়ারদের পরিশোধন কেন্দ্রের জল পরীক্ষা করতে পাঠাই। সেই রিপোর্ট এসেছে। কোনও বিষের চিহ্ন নেই। পরে আরও এক বার একই পরীক্ষা করাই। একই ফল মেলে। আমাদের বিভাগের লোকেরাও গুজবের কথা বলেন।” মন্ত্রী বলেন, “ওই কেন্দ্র থেকে পাইপলাইনে করে ৯ টা ব্লকের প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের বাড়ি বাড়ি জল পৌঁছনো হয়। গুজবের পর সকাল থেকে এলাকায় জল ব্যবহার নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। স্থানীয় থানায় এফআইআর করা হয়েছে।”
তারপরেই সুব্রতবাবু অভিযোগ করেন, “দুঃখের কথা, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পেরেছি, বুধবার রাতে সিপিএমের বিভিন্ন কার্যালয় থেকে দলে দলে ছেলে বেরিয়ে বিষ মেশানোর গুজব ছড়াতে শুরু করে!” সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী বেঞ্চ থেকে প্রবল চিৎকার শুরু হয়। সরকার পক্ষও পাল্টা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। চেঁচামেচির মধ্যেই মন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, “কী ভয়ঙ্কর কান্ড! সিপিএম যে এমন কাজ করে ১৫ লক্ষ মানুষকে চরম আতঙ্কে ফেলতে পারে, ধারণা ছিল না। সিপিএম কি এ ভাবেই রাজনীতি করতে চায়?”
বিরোধীরা তখন ওয়েলে নেমে স্পিকারের সামনে হইচই করতে থাকেন। বিরোধী দলনেতা বিধানসভার কার্যবিধির বই তুলে ধরে স্পিকারকে কিছু বলতে থাকেন। স্পিকার ঘোষণা করেন, মন্ত্রীর রেকর্ড-করা বক্তব্য শুনে বাদ দেওয়ার মতো কিছু মনে হলে তিনি তা করবেন। তার পর বিরোধীরা কিছুটা শান্ত হন। পরে স্পিকারের বক্তব্য (বাদ দেওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায়নি) জেনে সূর্যবাবু বলেন, “স্পিকারের জন্য দুঃখ হয়! মুখ্যমন্ত্রী চান না, এমন কিছু করার মতো বুকের পাটা ওঁর নেই!”
সুব্রতবাবুর বক্তব্য শেষে স্পিকার বিরোধী দলনেতাকে বলার অনুমতি দিয়েছিলেন। সূর্যবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে সুব্রতবাবু যে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করলেন, তা সভার রেকর্ড থেকে বাদ দেওয়া হোক।” এ বার শাসক শিবির হইচই শুরু করে। তারই মধ্যে সুব্রতবাবু জলে সিপিএমের বিষ মেশানো সংক্রান্ত মন্তব্যটি করেন। কিছু পরে স্পিকারের বারংবার অনুরোধে সভা কিছুটা শান্ত হলে মুখ্যমন্ত্রী বলতে ওঠেন। সহকর্মীর বক্তব্য সম্পূর্ণ সমর্থন করে তিনি বলেন, “সুব্রত’দা অনেক দিন রাজনীতি করছেন। তিনি যথেষ্ট দায়িত্বশীল। তিনি যা রিপোর্ট পেয়েছেন, তার ভিত্তিতেই বলেছেন। একটাও খারাপ কিছু বলেননি!”
মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের উদ্দেশে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীকে গালাগাল দিন। কিন্তু মনে রাখবেন, প্রত্যেকটা মানুষের জীবন গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, বিষ মদ খেয়ে অনেকে মারা গিয়েছেন। আর আগুন নিয়ে খেলবেন না! গুজব রটাবেন না। গুজব যারা রটিয়েছে, তাদের খোঁজা হচ্ছে। সকলকে ধরা হবে।” মুখ্যমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “যারা গুজব ছড়িয়ে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তাদের আমি ঘৃণা করি! মানুষ জল খেতে পাচ্ছে না, এটা ভাবা যায়! গুজব ছড়ানোও একটা অপরাধ। আমরা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিলাম না। এই ভাবে মানুষের জীবন নিয়ে তো খেলিনি! কোনও একটা দল ক্ষমতায় নেই বলে মানুষের জীবন নিয়ে যা তা করবে?”
সভার বাইরে সুব্রতবাবু বলেন, “ওখানে সত্যিই কিছু হয়ে গেলে একটা আমরি বা একটা সংগ্রামপুর নয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হবে। ক্ষমতায় নেই বলে সিপিএম এতটা নীচে নামতে পারে, ভাবতে পারছি না!” সুব্রতবাবুর সাংবাদিক সম্মেলনের মধ্যেই চলে আসেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “একটা দল ক্ষমতায় নেই বলে চক্রান্ত করছে! মানুষ খুন করছে! এটা কি রাজনীতি? চক্রান্ত করে এসএমএস করছে। মদে, জলে, মিড ডে মিলে বিষ মেশাচ্ছে।” বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, কেরলের মতো রাজ্যে এমন হয় না বলে জানিয়েই তাঁর আরও অভিযোগ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা একটি ‘ভাল মুসলিম মেয়ে’ (শামিমা শেখ) জেলা সভাধিপতির কাজ করছেন। তাই সিপিএম ওই জেলায় একের পর এক চক্রান্ত করছে। যে মন্তব্যের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিষ’ ছড়ানোর অভিযোগ এনেছেন বিরোধী দলনেতা।
বিরোধীদের ভূমিকার সমালোচনা করে পরিদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ব্যাখ্যা দেন, ‘সঙ্গত’ কারণেই স্পিকার মুখ্যমন্ত্রী বা সুব্রতবাবুর কোনও মন্তব্য কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেননি। সূর্যবাবু অবশ্য বিধানসভার কার্যবিধি দেখিয়ে দাবি করেছেন, সভায় অভিযোগ জানানোর নির্দিষ্ট নিয়ম আছে।
‘মানহানি’র মতো বিষয় থাকলে স্পিকার তা বিবরণী থেকে বাদ দিতে পারেন। যা এ দিন সুব্রতবাবুর মন্তব্যে ছিল বলেই সূর্যবাবুর দাবি। বিধানসভার ভিতরের মন্তব্য নিয়ে আদালতে মামলা করা যায় না। সভার বাইরে মমতা বা সুব্রতবাবুর মন্তব্য নিয়ে মানহানির মামলা করা হবে কি? সূর্যবাবু জানান, সিপিএম বা বামফ্রন্ট সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। পরিষদীয় দল একক ভাবে কিছু করবে না। |