দীর্ঘ টালবাহানার পর অবশেষে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে টনক নড়ল জেলা প্রশাসনের। বৃহস্পতিবার দিনভর বেআইনি বালি তোলার বিরুদ্ধে কাঁসাই নদীর অ্যানিকেতে অভিযান চালাল পশ্চিম মেদিনীপুর প্রশাসন। আর প্রথম দিনেই এল সাফল্য। ধরা পড়ল ৪৩টি লরি। উদ্ধার হল ৬টি বালি তোলার যন্ত্রও। সব মিলিয়ে এক দিনেই জরিমানা বাবদ সরকারি রাজস্ব মিলতে চলেছে প্রায় ৮ থেকে ৯ লক্ষ টাকা।
অথচ, প্রশাসনিক উদাসীনতায় বছরের পর বছর ধরে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এ ভাবেই লুঠ হয়ে যাচ্ছিল অ্যানিকেতের কাছে কাঁসাই নদী-গর্ভের বালি। প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে বালি-বোঝাই গাড়ি চলে গেলেও কিছু বলা হত না। অভিযোগ, ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক শ্রেণির অফিসার ও কর্মীদের সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীদের যোগসাজশ থাকায় তল্লাশি হত নাম-কা-ওয়াস্তে। এমনকী বেআইনি বালি-কারবারে জড়িয়ে গিয়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার নামও। ফলে কাঁসাই নদীর চরে বেআইনটাই যেন আইন হয়ে উঠেছিল। এই তথ্য রাজ্য সরকারেরও অজানা নয়। |
সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভূমি দফতরকে রাজস্ব-আয় বৃদ্ধির নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেন, বেআইনি পাথর ও বালি খাদান বন্ধ করতে হবে। কী ভাবে তা বন্ধ করা হবে, সেই নিয়ে বুধবার জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্ত ও জেলা পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠির বৈঠক হয়। পূর্ব পরিকল্পনা মতো অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) শুভাঞ্জন দাস ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় দলবল নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালেই হাজির হন অ্যানিকেত-চত্বরে। গিয়েই দেখেন একাধিক গাড়ি রয়েছে। অতিরিক্ত জেলাশাসক শুভাঞ্জন দাস বলেন, “৪৩টি লরি আটক হয়েছে। এত দিন বেআইনি ভাবে যন্ত্র দিয়ে বালি তোলা হচ্ছিল। তেমন ৬টি যন্ত্রও আটক করা হয়েছে। জরিমানা বাবদ সরকারের প্রায় ৮ থেকে ৯ লক্ষ টাকা রাজস্ব আসবে এই তল্লাশি থেকেই।” শুভাঞ্জনবাবুই এখন জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিকেরও দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি আরও জানান, “কাঁসাইয়ের মতোই জেলার সব বেআইনি পাথর ও বালি খাদানেই এ বার তল্লাশি চালানো হবে। কোনও বেআইনি খাদান থাকবে না।”
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিনের তল্লাশির পরিকল্পনা করা হয়েছিল গোপনে। যাতে অবৈধ কারবারিদের কাছে কোনও ভাবেই খবর না পৌঁছয়। তল্লাশি করতে গেলে মূলত চারটি পথে এত দিন পালিয়ে যেত অবৈধ কারবারিরা। মহেশপুর, জিনশহর, মোহনপুর-সহ প্রতিটি এলাকায় আগে থেকেই পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। যাতে কেউ পালাতে না পারে। তার পর বিশাল বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন অতিরিক্ত জেলাশাসক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। সঙ্গে মিস্ত্রি, গ্যাস কাটার ও ক্রেন। যাতে বেআইনি বালি বোঝাই গাড়ি ও বালি তোলার যন্ত্র তুলে আনা যায়। সকাল থেকে দুপুর সাড়ে তিনটে পর্যন্ত তল্লাশি চালিয়ে সমস্ত গাড়ি ও যন্ত্র নিয়ে আসা হয় কালেক্টরেট এবং ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে।
বছরের পর বছর নদী-বিজ্ঞান না মেনে অবৈধ ভাবে বালি তোলায় ক্ষতি হয়েছে কাঁসাই নদীর অ্যানিকেত বাঁধের। অ্যানিকেত ভেঙে পড়েছে বেশ কয়েক বার। যা সংস্কার করতে আরও কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এই অ্যানিকেতের কারণেই গ্রীষ্মকালেও নদীতে জল থাকে। যে জলে মেদিনীপুর সদর, কেশপুর, পিংলা, ডেবরা ও খড়্গপুর গ্রামীণ এলাকার বহু জমিতে সেচের কাজ হয়। এ ছাড়াও খড়্গপুর ও মেদিনীপুর শহরও পানীয় জলের জন্য এই নদীর উপরেই নির্ভরশীল। বেআইনি ভাবে বালি তোলার জন্য নদীর জলস্তর নেমে যাওয়া ও অ্যানিকেত ভেঙে পড়ায় জল না থাকা--দুইয়ের কারণে দুই শহরেই পানীয় জলের সঙ্কটও দেখা দিচ্ছিল। দ্রুত ওই সমস্যার সমাধান না হলে ভবিষ্যতে দুই শহরই পানীয় জল পাবেএমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। বেআইনি ভাবে বালি তোলার ফলে নদীগর্ভে গর্ত হয়ে স্নানের সময়ে তলিয়েও গেছে অনেকে। এ নিয়ে অনেক আন্দোলনও হয়েছে, কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। এ বার মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই প্রথম জোর তল্লাশি হল। সাফল্য মিলেছে। যদি এই তল্লাশি নিয়মিত চালানো যায়, তা হলে নদী ও শহরবাসীর অশেষ উপকার হবে। কিন্তু কত দিন এই নজরদারি চলবে, সে নিয়ে সংশয় থাকছেই। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতা ভাল নয়। |