সরকার এবং মধুসূদন দাদা যে এক নহে, এই কথাটি মাঝেমধ্যেই গুলাইয়া যায়। রাজনীতিকরাও গুলাইয়া ফেলেন, সাধারণ মানুষও। ফলে, সরকারের নিকট মানুষের প্রত্যাশা জন্মে, চাহিলেই বুঝি মধুসূদন দাদার ভাঁড় হইতে দই পাওয়া যাইবে। রাজনীতিকরাও যেহেতু জনমোহনকেই ধ্রুব জ্ঞান করিয়া থাকেন, ফলে তাঁহারাও ভাঁড় উপুড় করিয়াই আছেন। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েক বার এই ঘটনা ঘটিল। ঢাকুরিয়ার এ এম আর আই হাসপাতালে আগুন লাগিয়া নব্বইয়ের অধিক মানুষের মৃত্যুর অতি দুঃখজনক ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করিলেন, মৃতদের পরিবারকে পাঁচ লক্ষ টাকা করিয়া ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে। অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতিপূরণের লেশ মিলাইবার পূর্বেই বিষমদে মৃত্যুর ঘটনা ঘটিল। সরকার ঘোষণা করিয়া দিল, মাথাপিছু দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে। কেহ প্রশ্ন করিতেই পারেন, ঢাকুরিয়ার মৃতদের সহিত মগরাহাটের মৃতদের সামাজিক অবস্থানে যে পার্থক্য, ক্ষতিপূরণের অঙ্কের তারতম্য কি সেই পার্থক্যের কারণেই? কিন্তু, এই প্রশ্নটি অবান্তর, কারণ কোনও ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনও যুক্তি নাই।
যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের, কাহারও অপদার্থতার ফলে মৃত্যু হইলে তাহা আরও দুঃখের। যাঁহারা মারা গেলেন, তাঁহাদের অনেকেই হয়তো পরিবারের মুখ্য উপার্জনশীল ব্যক্তি ছিলেন। এই মৃত্যু তাঁহাদের পরিবারকে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করিবে, তাহাও ঠিক। কিন্তু, সেই ক্ষতি পূরণের দায় বা দায়িত্ব সরকারের নহে। যাঁহাদের অপদার্থতায় এতগুলি মানুষের জীবনহানি হইল, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও তাঁহাদেরই করিতে হইবে। মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁহার সরকার মানুষের সমব্যথী হইতে পারেন, কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনও কারণ সরকারের নাই। যে ক্ষতির জন্য সরকার প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী নহে, তেমন মাত্র দুইটি ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষতিপূরণ দেওয়া কর্তব্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে এবং সন্ত্রাসবাদী হামলায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে। যুক্তি সহজ এই দুইটি ক্ষেত্রেই ক্ষতির জন্য যাহা/যাহারা দায়ী, তাহাদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা সম্ভব নহে। অন্য সমস্ত ক্ষেত্রে সম্ভব। ঢাকুরিয়ার হাসাপাতালের ক্ষেত্রেই যেমন মালিকপক্ষকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করিতে বাধ্য করা উচিত। প্রয়োজনে সরকার তাঁহাদের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করিয়া এই অর্থের ব্যবস্থা করিবে। কিন্তু, তাহাতে বোধ হয় যথেষ্ট জনমোহন হয় না। কোনটি কর্তব্য আর কোনটি নহে, তাহা বিচার করিতে শিখিতে হইবে।
কেহ যুক্তি খাড়া করিতে পারেন, এ এম আর আই-তে তবু মালিকপক্ষ আছে, যাহাদের নিকট হইতে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যাইতে পারে চোলাই-কাণ্ডে সরকার ক্ষতিপূরণ না দিলে কে দিবে? যুক্তিটি ভ্রান্ত। এই কথা সত্য যে এই মৃতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ করিবার জন্য কেহ থাকিবে না। কিন্তু, সরকার সেই ঘাটতি পূরণ করিতে পারে না। রাজকোষের টাকা সরকারের সম্পত্তি নহে। তাহা জনগণের টাকা, সরকার অছিমাত্র। রাজকোষের টাকা কোন খাতে, কী ভাবে ব্যয় করা হইবে, তাহার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সরকার উন্নয়ন খাতে অর্থ ব্যয় করিবে, পরিকাঠামো নির্মাণ করিবে। রাজকোষ দাতব্য ভাণ্ডার নহে। জনমোহনে রাজকোষ ব্যবহার যে কোনও পরিস্থিতিতেই উচিত নহে। আর, পশ্চিমবঙ্গের রাজকোষের যে মারাত্মক হাল, তাহাতে একটি পয়সায় ভুল খাতে খরচ করা অন্যায়। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার এই নীতিটি বর্তমান সরকার আবিষ্কার করে নাই, এই ব্যবস্থা বহু কাল চলিতেছে। কিন্তু, নূতন সরকার পরিবর্তন-এর কথা বলে। এই ভ্রান্ত অভ্যাসটিও পরিবর্তিত হউক। |