আর বিবৃতি বা চিঠি নয়, সরকার যে ভাবে চলছে তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করে এ বার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কাছেই মুখ খুললেন দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা। এ দিন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন শিল্প ও বাণিজ্য কাউন্সিলের বৈঠকে রতন টাটা-মুকেশ অম্বানী-রাহুল বজাজরা অভিযোগ করেন, সংস্কার নিয়ে সরকারের দ্বিধা, এক পা এগিয়েও দু’পা পিছিয়ে আসার ফলে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি আরও বেহাল হচ্ছে। জবাবে প্রধানমন্ত্রীও শিল্পপতিদের পাল্টা সমালোচনা করে বলেন, সরকারের কাজকর্ম নিয়ে এই ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য অনিশ্চয়তাই বাড়িয়ে দেয়। তবে একই সঙ্গে তিনি শিল্পমহলকে আশ্বস্ত করে জানান, দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ফেরানোর জন্য সরকার সব রকম ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে।
গত এক বছরে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানতে গিয়ে ধাক্কা লেগেছে দেশের শিল্পোৎপাদনে। শরিকি চাপে হোঁচট খাচ্ছে আর্থিক সংস্কারের কর্মসূচি। ‘মাল্টি ব্র্যান্ডে’র খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ হোক বা পেনশন বিল বারবার এগিয়েও পিছিয়ে এসেছে মনমোহন সিংহের সরকার। শিল্পমহলের বক্তব্য, বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকায় সরকারের প্রতি আস্থা ক্রমশ কমেছে। তা ছাড়া, ২০০৮-এর আর্থিক মন্দার সময় শিল্পমহলের আস্থা ফেরাতে কেন্দ্র যে ভাবে আর্থিক প্যাকেজ-সহ নানা ধরনের পদক্ষেপ করেছিল, এ বারে সে রকম কিছুও অনিশ্চিত। গত মাসেই নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে গিয়ে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন আজিম প্রেমজি, মুকেশ অম্বানী, রতন টাটা। ইউপিএ-সরকারের ‘পক্ষাঘাতগ্রস্ত নীতি’ই যে সমস্যার মূলে, তা-ও তখন জানিয়েছিলেন তাঁরা। তার পরে আজ খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছেই এ ব্যাপারে নিজেদের উদ্বেগ ফের স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রথম সারির ওই শিল্পপতিরা। |
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আনন্দ শর্মা, জয়ন্তী নটরাজন, রতন টাটা, রাহুল বজাজ,
এন আর নারায়ণমূর্তি এবং মুকেশ অম্বানী। ছবি: পি টি আই |
অভিযোগের মুখে দাঁড়িয়ে রতন টাটা-মুকেশ অম্বানী-রাহুল বজাজ-দীপক পারেখ-এন আর নারায়ণমূর্তি-স্বাতী পিরামলদের প্রধানমন্ত্রী বোঝান, জোট-রাজনীতির বাধ্যবাধকতার ফলে তাঁর হাত-পা বাঁধা। সংসদে কংগ্রেসের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তাই শরিক ও বিরোধীদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে। মনমোহন বলেন, শিল্পমহলকেও এটা বুঝতে হবে। এর পরেই শিল্পমহলের কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেন, বাস্তব পরিস্থিতি না বুঝে সরকারের নীতি নিয়ে এই ধরনের নেতিবাচক মন্তব্যে অনিশ্চয়তা বাড়ে এবং তাদেরই লাভ হয়, আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে যাদের কোনও যোগ নেই! দু’ঘণ্টার বৈঠক শেষে শিল্পমহলের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সব সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনেছেন এবং দেশের অর্থনীতিকে ফের আর্থিক বৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু তাতে সরকারের ‘অপারগতা’ আড়াল হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ দিনের এই বৈঠক শুরুর আগেই টাটা-গোষ্ঠীর ভবিষ্যত কর্ণধার সাইরাস মিস্ত্রিকে সঙ্গে নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মার সঙ্গে দেখা করেন রতন টাটা। তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু ক্ষণ কথাও হয়। তবে এই বৈঠক নেহাতই সৌজন্য সাক্ষাৎ বলে জানানো হয়েছে।
বস্তুত গত কয়েক মাস ধরে শিল্পোৎপাদনের হার ক্রমশ নামতে থাকায় উদ্বিগ্ন সরকার এবং শিল্পমহল। তার সঙ্গে পাল্টা দিয়ে নামছে টাকার দর। এই অবস্থায় দু’দিন আগে শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মার কাছেও তাঁদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন শিল্পপতিরা। তাঁরা চাইছেন, জমি অধিগ্রহণ, পণ্য-পরিষেবা কর, খুচরো ব্যবসা, পেনশন বা বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে সরকার ধীরে ধীরে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা করুক। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে সুদের হার কমানোর মতো কিছু ইতিবাচক বার্তা পাঠাক বিনিয়োগকারীদের প্রতি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আজকের আলোচনায় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই ছিল চড়া সুদের হার ও কয়লার জোগানের সমস্যা। শিল্পমহলের বক্তব্য, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়িয়ে যাওয়ায় শিল্পের জন্য ঋণের ব্যয় বেড়ে গিয়েছে। আর তার ধাক্কাতেই শিল্পোৎপাদন ৫.১ শতাংশ কমে গিয়েছে বলে মনে করছেন শিল্পপতিরা। বণিক সংগঠনগুলি চাইছে, চলতি আর্থিক বছরের মধ্যে সুদের হার অন্তত ২ শতাংশ কমানো হোক। এই ধরনের দাবি যে উঠবে, তা আগেভাগেই আঁচ করে প্রধানমন্ত্রী বৈঠকের শুরুতে বলেন, “গত কয়েক সপ্তাহে মূল্যবৃদ্ধিতে কিছুটা লাগাম দেওয়া গিয়েছে। তা নিয়ন্ত্রণে থাকলে আশা করছি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আর্থিক নীতির ফাঁস কিছুটা শিথিল করবে।” এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান দীপক পারেখ বলেন, “চড়া সুদের হারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আশা করছি, এ বার সুদের হার কমিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নীতির পরিবর্তন হবে।”
শিল্পমহলের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল কড়া পরিবেশ নীতির ফলে কয়লার জোগানের সমস্যা। প্রধানমন্ত্রীও জানান, কয়লা ও গ্যাস সরবরাহের সমস্যাটিকে আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে শিল্পমহলের উদ্বেগ দূর করতে পরিবেশমন্ত্রী জয়ন্তী নটরাজনকেও বৈঠকে ডাকা হয়েছিল। সরকারের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়, বিদ্যুৎ প্রকল্প-সহ বেশ কিছু বড় পরিকাঠামো প্রকল্পে খুব শীঘ্রই পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র দেওয়া হবে। আলোচনায় ওঠে টাকার দাম পড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গও। প্রধানমন্ত্রী জানান, সরকার পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে। প্রয়োজনে সব রকম পদক্ষেপ করা হবে। কিন্তু রফতানিকারীদেরও এর থেকে ফায়দা তোলার চেষ্টা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আজ শিল্পমহলের সহযোগিতা চেয়ে বলেন, “জমি অধিগ্রহণ ও পরিবেশের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এগোতে হবে। কিন্তু এ সব বিষয়ে শিল্পমহল ও সরকারকে এক সঙ্গেই কাজ করতে হবে।”
লোকপাল থেকে শুরু করে সংসদের ভিতরে-বাইরে নানাবিধ সমস্যায় জেরবার মনমোহন-সরকার এখন শিল্পমহলের আস্থা ফেরাতে মরিয়া। প্রধানমন্ত্রী, আনন্দ শর্মা, যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ারা আজ তাই শিল্পপতিদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, উত্তরপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা ভোটের জন্য রাজনৈতিক দলগুলি খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির মতো বিষয়ে অনড় মনোভাব নিচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা থেকে সরছে না। ভোটের পরে ফের এই বিষয়ে আলোচনা হবে বলে বৈঠকে জানান তাঁরা। আনন্দ শর্মা আজও এ নিয়ে ভারতীয় কৃষক সংগঠনের নেতা পি চেঙ্গাল রেড্ডির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রেড্ডি সরকারের অবস্থানকেই সমর্থন করেছেন। অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গেও কথা বলে মতামত গড়তে চাইছে সরকার। সরকারি সূত্রের খবর, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিষয়ে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রীদের সঙ্গেও বৈঠক ডাকতে চলেছেন আনন্দ। সেখানে নতুন উৎপাদন নীতি ও শিল্পোৎপাদন কমে যাওয়া নিয়েও আলোচনা হবে। পেনশন বিল ও বিমা সংস্কার নিয়েও ধাপে ধাপে ঐকমত্য গড়ে তোলার চেষ্টা করবে কেন্দ্র। |