আতঙ্কের দিনলিপি |
ডাক্তারের কথা |
তরুণ ডাক্তারটি আইটিইউ-তে ছিলেন। “ভোর চারটে নাগাদ উপরে এসি-র ভেন্ট থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। সিকিউরিটিকে ফোন করলাম, সাড়া নেই। ৩০ সেকেন্ডে ধোঁয়া প্রচণ্ড বেড়ে গেল। টানাটানি করে দুটো বেড করিডোরে বার করলাম, কিন্তু জায়গা নেই। রড দিয়ে জানলা ভাঙতে লাগলাম। একটু ধোঁয়া বেরোল, কিন্তু লাভ হল না। অনেকে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল, বমি করছিল। সিনিয়ররা বললেন, মেয়েদের নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে যাও। সিঁড়ির জানলার কাচ ভাঙতে ভাঙতে যাও। ভেবেছিলাম, নীচ থেকে লোক এনে রোগীদের বার করব। কিন্তু নামতে নামতেই ধোঁয়া সব ঢেকে ফেলল। আমরা আর ঢুকতে পারলাম না।”
|
অসহায় মন্ত্রীও |
বন্ধুর শ্বশুরকে বাঁচাতে পারলেন না মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। বন্ধু প্রতাপ চট্টোপাধ্যায়ের শ্বশুর মহারাজ বিশ্বাস হাসপাতালের তিন তলায় ৫৩ নম্বর শয্যায় ভর্তি ছিলেন। অর্থোপেডিকে চিকিৎসা চলছিল। শুক্রবার ভোরে মহারাজবাবুই জামাইকে ফোন করে জানান, আগুন লেগেছে। প্রতাপবাবুর সঙ্গে ববি হাসপাতালে পৌঁছন ভোর ৫টায়। তিন তলায় ওঠার চেষ্টাও করেন। ধোঁয়ার দাপটে পিছিয়ে আসেন। প্রতাপবাবু ফোনে শ্বশুরমশাইকে ববির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। মহারাজ বলেন, ‘‘ববি আমাকে বাঁচাও।’’ বাঁচানো যায়নি তাঁকে। পরে দেহ উদ্ধার হয়েছে।
|
প্রাক্তন বিধায়ক |
মারা গেলেন হাওড়ার শ্যামপুরের প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক শিশির সেন (৭৬)। পেসমেকার বসেছিল এক মাস আগে। সপ্তাহখানেক আগে ভাইপোর মৃত্যুতে ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন শিশিরবাবু। ভর্তি হন আমরি-তে। শুক্রবারই বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ভাইপোর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান থাকায় ঠিক হয়, শনিবার তাঁকে বাড়ি আনা হবে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কংগ্রেস নেতা অজয় ঘোষালও (৮২) মারা গিয়েছেন। আড়িয়াদহের বাসিন্দা অজয়বাবু জেলা কংগ্রেস সভাপতি দেবী ঘোষালের দাদা। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় মঙ্গলবার ভর্তি হন। শুক্রবার ছাড়ার কথা ছিল তাঁকেও। দুই সহকর্মীর মৃত্যুসংবাদ শুনে এ দিন দিল্লি থেকে দ্রুত ফেরেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স পুনর্নবীকরণের রূপরেখা বেঁধে দেওয়া দরকার।”
|
বাঁচার চেষ্টায় |
অলোক চৌধুরীর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহটা মিলেছিল তিন তলার সিঁড়ির মুখে। ছাদ থেকে পড়ে কোমর ভেঙে সপ্তাহ দুয়েক আগে ভর্তি হন। বৃহস্পতিবার ছাড়া পাওয়ার কথা ছিল। অন্য জটিলতা ধরা পড়ায় ‘ডিসচার্জ’ পিছিয়ে যায় এক দিন। এ দিন সকালে হাসপাতালে অনেকক্ষণ হদিশই মিলছিল না। দুপুরে এসএসকেএমে বাবা
কে শনাক্ত করে ফুঁপিয়ে উঠলেন মেয়ে অঙ্গনা, “বাবা হাঁটতেই পারছিল না। ভাবুন, বাঁচার জন্য ওই অবস্থাতেই নেমে আসার চেষ্টা করেছিল!” |
ডিসচার্জ |
ঋতা বসুর ছাড়া পাওয়ার কথা ছিল শুক্রবার সকালেই। হাসপাতালের সামনে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন মেয়ে নীনা। এক ফোঁটা জলও তাঁকে কেউ খাওয়াতে পারেননি। মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ভোরে এল অগ্নিকাণ্ডের খবর। বোবা চোখে নীনা ক্রমাগত বলে চলেন, “এত দিন পরে মা বাড়ি ফিরবে বলে বাবা ঘর গুছিয়েছে। নিজে ‘শেভ’ করে বসে আছে সকাল থেকে। বাবাকে কী বলব?”
|
সংসদে শোক |
শুক্রবার লোকসভা অধিবেশনের শুরুতেই আমরি-র অগ্নিকাণ্ড নিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। স্পিকার মীরা কুমার মৃতদের পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এ দিন সারা দিনই দেশ জুড়ে সব আলোচনার কেন্দ্রেই ছিল আমরির দুর্ঘটনা। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো ভরে ছিল নানা শোক-বার্তায়।
|
সমব্যথী অমিতাভ |
আমরি হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সমবেদনা জানালেন অমিতাভ বচ্চন। ট্যুইটারে তিনি লিখেছেন, “হাসপাতালের ওই ভয়াবহ দৃশ্য যন্ত্রণাদায়ক। স্বজনদের হারিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের সমবেদনা জানাই।”
|
নেমে না গেলে |
দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে হু হু কেঁদে ওঠেন ইন্দিরা চক্রবর্তী। হাড়ে ক্যানসার নিয়ে ভর্তি ছিলেন দাদা অজয় ঘোষাল। সারা রাত এমনিতেই দাদার শয্যার পাশে জেগে বসেছিলেন ইন্দিরা। উদ্ধারকারীরা চার তলায় পৌঁছতে দাদা বোনকে বললেন, “তুই আগে নেমে যা।” হুড়মুড়িয়ে নেমে এসেছিলেন ইন্দিরা। দাদাকেও নামিয়ে আনা হয়েছিল, তবে ঘণ্টাখানেক পরে। ততক্ষণে বার ছয়েক কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে গিয়েছে তাঁর। খানিক পরেই নিথর হয়ে যান অজয়বাবু। ইন্দিরা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমি উদ্ধারকারীদের সঙ্গে নেমে না গেলে দাদা নিশ্চয় বেঁচে যেত!”
|
বাবার জন্য খিচুড়ি |
বেলা একটা নাগাদ হাওড়ার ওয়াটকিন্স লেনের এসে পৌঁছল ৮৩ বছরের নেমিচাঁদ জৈনের দেহ। হাসপাতালের দোতলায় নিউরো-ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। বাবার দেহের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলে রণজিৎ বলেন, “শনিবারই বাবাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। তার আগে বাবা খিচুড়ি খেতে চান। বাড়িতে রান্না হচ্ছিল। টিভিতে খবর দেখে ছুটলাম। দেখি কাপড়ে মোড়া বাবার দেহ।”
|
একা একা |
বছর চোদ্দোর প্রাকৃতা পাল মাথায় চোট নিয়ে দু’দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। বাবা ধনঞ্জয় পাল স্বাস্থ্য দফতরে কাজ করেন। দিন দুয়েকের মধ্যেই মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। রাতে একতলার প্রতীক্ষালয়ে ছিলেন ধনঞ্জয়বাবু। বলেন, “ধোঁয়া দেখে রক্ষীরা বাইরে বেরনোর দরজাগুলো বন্ধ করে দিচ্ছিল। খোলার জন্য চেঁচামেচি করলাম। কেউ শুনল না। মেয়েটা থেকেই গেল। চারতলায়। একা একা মরে গেল জানেন!”
|
জখম শোভনদেব |
আমরি-তে গিয়ে জখম হলেন তৃণমূল বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর স্ত্রী সুপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায় কিছু দিন যাবৎ আমরি-র মেন বিল্ডিংয়ে ভর্তি। শুক্রবার সকালে তাঁকে ওই হাসপাতালের অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ে স্থানান্তরিত করার কথা ছিল। এ দিন সকালে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান সরকার পক্ষের মুখ্য সচেতক। হাসপাতালের কাচ ভেঙে মাথায় পড়ে। তবে শোভনদেববাবুর স্ত্রীর ক্ষতি হয়নি।
|
বিদ্যুৎকর্মী |
আমরি-র আগুনে মৃত্যু হয়েছে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার আট জন কর্মীর। শুক্রবার তাঁদের দেহ শনাক্ত করার পর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বণ্টন সংস্থা সূত্রে খবর, তাদের আরও এক জন কর্মীও হাসপাতালের অগ্নিদগ্ধ ওই বাড়িটিতে ভর্তি হন। তাঁর খোঁজ মেলেনি।
|
ফেরা হল না |
বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা করাতে এসে নিথর হয়ে ফিরছেন মুন্সিগঞ্জের খারফুল গ্রামের গৌরাঙ্গ মণ্ডল। ৬৫ বছরের গৌরাঙ্গবাবুকে বুধবার ভর্তি করানো হয়েছিল আমরিতে। আগুনের খবর পেয়ে সকাল ৬টার মধ্যেই ছেলে সাগর হাজির হন হাসপাতালে। চার তলায় বাবার বেডের কাছে পৌঁছতে বাজল সাড়ে ১০টা। বাংলাদেশ হাই কমিশন সূত্রে জানা যায়, শনিবার সকালেই দেহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোকবার্তা এসে পৌঁছেছে ইতিমধ্যেই। এ দিন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল, স্থগিত হয়ে যায় তা-ও।
|
ভিন্ রাজ্যে |
আমরির অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের মধ্যে ত্রিপুরা, ধানবাদ, রাঁচির বাসিন্দারাও আছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তাঁদের দেহ বিমানে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। এক জন করে সঙ্গে যেতে পারবেন। টিকিটের ব্যবস্থা সরকার করবে। আমরিতে ভর্তি ছিলেন ত্রিপুরার ১৮ জন। মারা গিয়েছেন ৬ জন আগরতলা ধলেশ্বরের শম্পা দাসচৌধুরী, বনমালীপুরের অসিত চক্রবর্তী, বিলোনিয়ার নরেশচন্দ্র মগ, রামনগরের অঞ্জলি দাস, খিলপাড়ার প্রবাল শুক্লদাস, ত্রিপুরা ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির ছাত্র সুধন মগ। তপন সাহা নামে এক রোগীকে চারতলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সুধনের দাদা রাতে হাসপাতালেই ছিলেন। বলছেন, “আগুন দেখে ভোর সাড়ে চারটেয় বাইরে বেরিয়ে আসি। মাথা কাজ করছিল না। আর ভিতরে যেতে পারিনি।”
|
ফিরে পাওয়া |
দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া মৃতের তালিকায় সকাল থেকেই নামটা ছিল, অপর্ণা চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু বছর পঁয়ষট্টির সেই বৃদ্ধার দেহ কোথায়? নাকতলা থেকে সাতসকালে এসে হাসপাতাল চষে ফেলেও মাকে খুঁজে পাননি মেয়ে বনানী। “কখনও এসএসকেএম, কখনও আমরি সল্টলেক, নাগাড়ে ছুটে চলেছি।” ফোনটা এল শেষ দুপুরে। ‘‘আমরির অ্যানেক্স বিল্ডিং-এ এক বার আসুন তো! এক বৃদ্ধা রয়েছেন, নাম বলছেন অপর্ণা!’ হাঁফাতে হাঁফাতে বনানী চার তলায় উঠে দেখেন, ৪৩৪ নম্বর বেডে শুয়ে রয়েছেন মা। বলছেন, “তোরা ঠিক আছিস তো?” অপর্ণাদেবী পরে বলেন, “ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ওঠার ক্ষমতা ছিল না। সেই সময় কেউ আমায় পাঁজকোলা করে তুলে নিয়ে গেল!”
|
তাড়াতাড়ি এসো |
শ্বাসকষ্টের মধ্যেই স্বামীকে মোবাইলে ফোন করেছিলেন মুনমুন চক্রবর্তী। বলেছিলেন, “হাসপাতালে আগুন লেগেছে। ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে পারছি না। তাড়াতাড়ি এসো।” স্বামী এসেছেন বটে, কিন্তু হাতে পেয়েছেন স্ত্রীর নিথর দেহ। মুনমুনদেবীর বোন অর্পিতা দাস হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, “দুর্ঘটনায় দিদির পা ভেঙে গিয়েছিল। শনিবারই ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। তার আগে ও-ই আমাদের ছেড়ে চলে গেল।” |
|