|
|
|
|
ঘিঞ্জি এলাকায় বাড়ছে বহুতল, অগ্নিকাণ্ডে চিন্তা |
বরুণ দে • মেদিনীপুর |
বহুতলে আগুন লাগলে কী ভাবে তা নেভানো হবে? কী ভাবেই বা ‘জতুগৃহে’ আটকে পড়া মানুষকে দ্রুত উদ্ধার করা যাবে? শুক্রবার ভোরে কলকাতার ঢাকুরিয়ায় বেসরকারি হাসপাতালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর প্রশ্নটা তাড়া করতে শুরু করেছে মেদিনীপুর-খড়্গপুরের বাসিন্দাদেরও। এমনকী দমকলের কর্মীদেরও।
দুই শহরে দমকলের যা পরিকাঠামো, তাতে শহর ও শহরতলিতে কখনও বড় কোনও অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেলে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা যে বেশ ‘শক্ত’, তা স্বীকার করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও। দমকলের এক আধিকারিকের কথায়, “আমাদের হাতে যে মই বা ল্যাডার রয়েছে তাতে দো-তলা, খুব বেশি হলে তিন তলা পর্যন্ত আগুন নেভানো সম্ভব। কিন্তু, তার বেশি নয়।”
অথচ শহর ও শহরতলিতে এখন অনেক বহুতলই গড়ে উঠেছে। ফ্ল্যাটবাড়ির পাশাপাশি রয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোম। কিন্তু, অধিকাংশ জায়গাতেই সঠিক অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ। ফলে, কলকাতার মতো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কী হবে, তা ভাবতেই শিউরে উঠছেন অনেকে। মেদিনীপুর-খড়্গপুর শহরের এমন অনেক জায়গায় ফ্ল্যাটবাড়ি, বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোম তৈরি হয়েছে---যেখানে এমনকী দমকলের গাড়িও সহজে ঢুকতে পারে না। এতই ঘিঞ্জি এলাকা। রাস্তার ধারে দোকান। যত্রতত্র পড়ে থাকে বালি-ইট-পাথরকুচির মতো নির্মাণ-সামগ্রী। রয়েছে অবৈধ পার্কিংয়ের সমস্যাও। এমন রাস্তা যে এক দিক থেকে ছোট গাড়ি ঢুকলেও অন্য দিক থেকে আসা গাড়ি আটকে পড়ে। এমন ঘিঞ্জি এলাকাতেও অনেক বহুতল গড়ে উঠেছে। নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার দায়িত্ব যাদের, দুই শহরের সেই পুর-কর্তৃপক্ষ বা মেদিনীপুর-খড়্গপুর উন্নয়ন পর্ষদও দায় এড়াতে পারেন না। |
|
সমস্যার কথা মেনে দমকলের এক আধিকারিক বলেন, “ঘিঞ্জি এলাকার কোনও বাড়িতে আগুন লাগলে আমাদের প্রায়ই অসুবিধায় পড়তে হয়। মেদিনীপুরের বড়বাজার, স্কুলবাজার, খড়্গপুরের খরিদাবাজার, গোলবাজারের মতো এলাকার সর্বত্র সহজে গাড়ি ঢোকে না। ফলে দমকলের গাড়ি পৌঁছনোর আগেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে।” এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত বড় রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে পাইপের সাহায্যে দুর্ঘটনাস্থলে জল নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু, অনেক বহুতলের আশপাশের এলাকায় আবার জল পেতেও সমস্যা হয়। পুকুর বা কুয়ো পর্যন্ত নেই!
উপরন্তু রয়েছে দমকলের নিজস্ব পরিকাঠামোগত সমস্যা। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কোথাও বড় অগ্নিকাণ্ড হলে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় দমকলের গাড়ি পাঠাতে হয়। কারণ, ঝাড়গ্রাম, ঘাটাল, মেদিনীপুর কিংবা খড়্গপুর--কোথাওই পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই। যেমন, মেদিনীপুরে গাড়ি রয়েছে মাত্র ৫টি। এর মধ্যে ৩টি বড় গাড়ি, ২টি ছোট। আগে ছোট গাড়ি ছিলই না। কিন্তু, শহর ও শহরতলির সর্বত্র বড় গাড়ি ঢুকতে পারে না বলেই ছোট গাড়ি আনা হয়। কিন্তু এক-একটি ছোট গাড়িতে জল নিয়ে যাওয়া যায় বড়জোর ৫০০ গ্যালন। যেখানে বড় গাড়িতে জল নেওয়া যায় এক হাজার গ্যালন। অনেক সময়েই আগুন আয়ত্তে আনতে বেশি পরিমাণ জল লাগে। কিন্তু বড় গাড়ি নিয়ে যে সর্বত্র যাওয়াও যায় না। দমকল দফতরের মেদিনীপুর বিভাগের ওসি দিলীপ ভৌমিক বলেন, “শহরের বড়বাজারের মতো এলাকাতেই তো সহজে ঢোকা যায় না। অনেক জায়গায় জল পেতেও সমস্যা হয়।” |
|
কর্মী-সংখ্যাও অপ্রতুল। মেদিনীপুরের জন্য ফায়ার অপারেটরের অনুমোদিত পদ ৫৪টি। অথচ, আছেন মোটে ২৪ জন। লিডার ও ড্রাইভার রয়েছেন যথাক্রমে ৮ জন ও ৯ জন। অথচ, দু’টি ক্ষেত্রেই ১৩ জন করে কর্মী থাকার কথা। খড়্গপুরের মতো শহরেও দমকলের গাড়ি মোটে ৫টি। ৩টি বড়, ২টি ছোট। দমকল দফতরের খড়্গপুর বিভাগের ওসি রবীন্দ্রনাথ সর্দারও বলেন, “শহরে এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে গাড়ি ঢুকতে পারে না। সময়মতো গাড়ি না-পৌঁছলে ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে যায়।”
মেদিনীপুর শহরের রবীন্দ্রনগর এলাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। পাঁচ-তলা। ১০১ জন রোগী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। কিন্তু, হাসপাতালের উপরতলায় আগুন লাগলে কী ভাবে তা দ্রুত আয়ত্তে আসবে--তার সদুত্তর নেই কারও কাছে। হাসপাতালের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মনোরঞ্জন সামন্ত অবশ্য বলেন, “এখানে ৫টি ফায়ার-এক্সটিংগুইশার সিলিন্ডার রয়েছে। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামও সময়মতো খতিয়ে দেখা হয়। কোথাও সামান্য ত্রুটি থাকলেই মেরামত করা হয়।” পাশাপাশি, তাঁর বক্তব্য, “শহর ও শহরতলিতে নতুন নতুন এলাকায় বসতি গড়ে উঠছে। বহুতল তৈরি হচ্ছে। এখানে দমকলের পরিকাঠামোও ঢেলে সাজা জরুরি।” |
|
পরিকাঠামোর অভাবে ধুঁকছে দমকল |
শহর ও শহরতলিতে বাড়ি তৈরি করতে হলে এখন মেদিনীপুর-খড়্গপুর উন্নয়ন পর্ষদের অনুমতি নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাড়ি তৈরির অনুমতি দেওয়ার আগে কর্তৃপক্ষেরই উচিত যে জায়গায় বাড়ি তৈরি হবে সেখানে অ্যাম্বুল্যান্স, দমকলের গাড়ি ঢুকতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখা। কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয় না বলে অভিযোগ। স্রেফ, জমির কাগজপত্র দেখেই বাড়ি তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়। শহরের বেশ কয়েকটি ঘিঞ্জি এলাকায় বসতি, হাসপাতাল, বহুতল গড়ে উঠেছে মেনেই পর্ষদের চেয়ারম্যান মৃগেন মাইতির দাবি, “এখন সব দিক খতিয়ে দেখেই অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। অ্যাম্বুল্যান্স, দমকলের গাড়ি ঢোকার জায়গা না-থাকলে বাড়ি তৈরির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।” |
ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
|
|
|
|
|