ব্যাগ গুছিয়ে...
লাজুক শীতে পারমাদন
লকাতার শীতের মিঠে রোদ পিঠে নিয়ে দুপুরের পরে যাত্রা শুরু করে বনগাঁ পৌঁছতেই বিকেল প্রায় শেষ। সেখান থেকে বাগদা যেতে না যেতেই, বাড়িঘর আর গাছপালার আড়ালে ঝুপ করে ডুবে গেল সূর্য। আর কলকাতার ঘনবসতিতে কুঁকড়ে থাকা লাজুক শীতও এখানে খোলামেলা জায়গা পেয়ে প্রতাপ জাহির করতে শুরু করল।
পারমাদনের গেটে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে বেশ গাঢ় হয়েছে অন্ধকার, গায়ে তার ঘোলাটে কুয়াশার চাদর। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে এই পারমাদনের পোশাকি নাম এখন ‘বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্য’। আয়তন ৯২ হেক্টর।
ভিতরের ট্যুরিস্ট লজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। অভয়ারণ্যের অন্দরে থাকা, অথচ ভোর হওয়ার আগে জঙ্গল দেখার সুযোগ নেই। ছোটদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশ্ন করল, “এখানে আবার বাঘ ঢুকে পড়বে না তো?” একটি ছোট বন্ধু তাদের নিশ্চিন্ত করল, “এখানে বাঘ নেই। তবে চিতল হরিণ আছে প্রচুর। হনুমান আছে, ময়ূর আছে, নানা রকম পাখি আছে, সকালে দেখতে পাবে।” ফলে পারমাদনের জংলি ঠান্ডায় চা-পকোড়া সহযোগে জমজমাট আড্ডা ও তার পরে গরমগরম মাংস-ভাতের ডিনার শেষে জম্পেশ ঘুম।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল ময়ূরের ডাকাডাকিতে। লেপ থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গেলাম বারান্দায়। কিন্তু কোনও ময়ূর নজরে এল না। বরং সামনের গাছে দেখতে পেলাম ছোটবেলায় চেনা একটি হলুদ রংয়ের ‘ইস্টিকুটুম’ পাখি।
নীচের বাগানে ফুলগাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত এক জন বললেন, ট্যুরিস্ট লজের পিছনেই রয়েছে ছোট্ট একটি চিড়িয়াখানা। সেখানেই খাঁচাবন্দি ময়ূরটি ডেকে ওঠে মাঝেমাঝে।
চোখমুখ ধুয়েই বেরিয়ে পড়লাম পারমাদনের চিতল হরিণের জন্য সংরক্ষিত এলাকা ঘুরে দেখতে। পথ ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে জঙ্গলের গভীরতা বাড়ছে। কিছু দূর যেতেই এক অদ্ভুত বৈপরীত্য চোখে পড়ল। পথের বাঁ দিকে একটানা পর্ণমোচী গাছের সমাহার। অথচ ডান দিকের জঙ্গলে সবুজের সমারোহ, যার আড়ালে-আবডালে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে চিতল-হরিণের দল। কখনও বা আমাদের চলার শব্দে কান খাড়া করে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াচ্ছে। অত্যন্ত সতর্কতায় আমাদের এক বার জরিপ করে নিয়েই চকিতে সরে পড়ছে ঝোপের আড়ালে।
আরও এগোতেই বাঁ দিকে দেখা মিলল ইছামতী নদীর। বেশ শান্ত, নিস্তরঙ্গ। তার ও পারে কোথাও মন ভোলানো সবুজ ধানের খেত, কোথাও বা সর্ষে ফুলের চোখ-ধাঁধানো হলুদ বাগিচা। ডান দিকের ঘন জঙ্গলে হরিণ পরিবারের ইতিউতি পদচারণা। ভারী মনকাড়া নিসর্গ। তার উপর এই সকালেও একটানা ঝিঁঝি-র ডাক।
ঘণ্টা দেড়েক লেগে গেল হরিণদের অভয়ারণ্য প্রদক্ষিণ করে আসতে। লজে ফিরে ব্রেকফাস্ট সেরেই আবার বেরিয়ে পড়লাম ইছামতীর বুকে নৌকাবিহারে।
টলটলে জলে ঝাঁকে ঝাঁকে চারা মাছ। নদীর এক পারে পারমাদনের জঙ্গল, অন্য পারে শস্যশ্যামল মাঠঘাটের অপরূপ শোভা। কোথাও বা মাঠভরা সোনালি ধান। অসীম নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু জলের বুকে বইঠার ছলাৎ-ছল শব্দ। মাছ ধরার জালপোঁতা বাঁশের মাথায় বসে থাকা গাঢ় নীল মাছরাঙার ইছামতীর জলে অপলক চেয়ে থাকা, আবার কোথাও বা পারে অপেক্ষমান এক ঝাঁক বকের হঠাৎই দল বেঁধে উড়ে যাওয়ার নয়নাভিরাম দৃশ্য।
নৌকাবিহার সেরে ঢুকে পড়ি অভয়ারণ্যের অপর প্রান্তে, যেখানে কাজ শুধু একটাইবড় বড় গাছের ছায়ায় নিজের মতো পথ চলা, আর কান পেতে নির্বাক প্রকৃতির বাঙ্ময় ছবি হৃদয়ঙ্গম করা। কখনও বা হনুমানের লম্ফঝম্প দেখে ছোটদের আমোদিত হওয়া। আর ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখির সভয়ে গাছের কোটর ছেড়ে উড়ে যাওয়ার দৃশ্যও নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেতে সাহায্য করে।
মধ্যাহ্নভোজের পরে বিদায় জানালাম পারমাদনকে।
কী ভাবে যাবেন
শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে বনগা। সেখান থেকে বাসে নলডুগারি। অথবা
ধর্মতলা থেকে বাসে সরাসরি নলডুগারি। সেখান থেকে ভ্যানে পারমাদন।
নয়তো কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে সরাসরি পারমাদন।
কোথায় থাকবেন
বনবিভাগের ট্যুরিস্ট লজে বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন
বারাসতের বিভাগীয় বনাধিকারিকের অফিসে। ফোন: ২৫৫২-০৯৬৮।
বুকিং শুরু হয় দু’মাস আগে থেকে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.