|
|
|
|
|
|
জতুগৃহ |
ব্যাগ ভরা আতঙ্ক |
শ্রীজীব মুখোপাধ্যায় |
গভীর রাতের আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী দোকান। প্রচুর দাহ্য বস্তু থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। দমকলের পাঁচটি ইঞ্জিন তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন আয়ত্তে আনে। সম্প্রতি এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সালকিয়ার হরগঞ্জ বাজারে। বস্তুত, শুধু হরগঞ্জ বাজারই নয়, হাওড়ার বিভিন্ন বাজারই এখন কার্যত জতুগৃহ। কোনও ভাবে আগুন লাগলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা
ভেবেই শিউরে উঠছেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা। দমকলের কাছেও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজারগুলি।
বিভিন্ন বাজারের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভাড়া দেওয়া সত্ত্বেও মালিকেরা বাজারগুলির ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করেন না। পুরসভারও কোনও হেলদোল নেই। যদিও মালিক পক্ষের বক্তব্য, ভাড়া এত কম যে বাজারের ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। দুই পক্ষের ‘কাজিয়া’য় হাওড়ার অধিকাংশ বাজারই এখন বিপজ্জনক। যদিও পুর-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, হরগঞ্জ পুর-বাজারে নিয়মিত নজরদারি চালানো হয়। তবে, বিক্রেতাদের একাংশ বিপজ্জনক ভাবে বিদ্যুতের সংযোগ নেন বলে অভিযোগ আছে। |
|
হরগঞ্জ বাজার পুরসভার অধীন। ১৯৮৪-তে পুরসভা বাজারটি অধিগ্রহণ করে। ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৯৪-তে পুরসভা বাজারের জন্য নতুন দু’টি চার তলা ভবন নির্মাণের কাজে হাত দেয়। কিন্তু, তিন তলা হওয়ার পরে কাজ থমকে রয়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দুই ভবনের মাঝের রাস্তায় পুরসভা দৈনিক ভাড়ায় বাজার বসিয়ে দিয়েছে। জায়গাও কম। ভিতরে মাকড়সার জালের মতো বিদ্যুতের তার ঝুলছে। মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ চলে যায়। নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও। হরগঞ্জ বাজার সমিতির সম্পাদক সঞ্জয় দত্ত বলেন, “আমরা স্থায়ী ভাবে দোকান পাইনি। ভাড়াও খুব বেশি। বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা খুব খারাপ। অনেক জায়গায় তার বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে। এ নিয়ে সাত-আট বার আগুন লেগেছে।”
শিবপুর বাজারেও অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। বাজারের অনেক জায়গাতেই বাঁশ, কাঠ, প্লাস্টিকের ছাউনি। ব্যবসায়ী ও এলাকার মানুষের বক্তব্য, বাজারের রাস্তা এত ঘিঞ্জি যে প্রয়োজনে দমকলও ঢুকতে পারবে না। তা ছাড়া, দীর্ঘ দিন বাজারের কোনও সংস্কার হয়নি। শিবপুর বাজার সমিতির সম্পাদক হরিচরণ সাউ বলেন, “বাজারের অবস্থা খুব খারাপ। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। ঘিঞ্জি এলাকা। আগুন লাগলে ভয়াবহ আকার নিতে পারে। আমরা ভাড়া দিই না। চাঁদা সংগ্রহ করে নিজেরাই ছোটখাটো সংস্কারের কাজ করি। তবে পুর-কর দিই।” শিবপুর বাজারটি রায়চৌধুরী পরিবারের। অন্যতম শরিক অরুণ রায়চৌধুরী স্পষ্টই বলেন, “বহু পুরনো বাজার। অনেক শরিক আছে। আমরা কোনও ভাড়া পাই না। তাই আমাদের পক্ষে রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়।” |
|
নেতাজি সুভাষ রোডের কালীবাবুর বাজারও ঘিঞ্জি। বাজার সমিতির সম্পাদক প্রভাস সামন্ত বলেন, “অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। বাজারের ভিতরে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে বিদ্যুতের তার। পুরসভাকে কর দিই। মালিককেও ভাড়া দিতে হয়। মালিককে বার বার বলা সত্ত্বেও বাজারের কোনও উন্নতি করছেন না। নতুন বাজার তৈরির কথা বললেও কিছু হচ্ছে না।” যদিও মালিক পক্ষের প্রতিনিধি ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “সব্জি বাজারের দোকানদারেরা দৈনিক ৫০ পয়সা ও মাছ বাজারের দোকানদারেরা দৈনিক এক টাকা করে দেন। এই টাকায় রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীরাই নিজেদের মতো করে সংস্কার করে নেন। আমরা টাকা বাড়াতে বললেও ব্যবসায়ীরা রাজি হননি।”
প্রায় একই অবস্থা রামরাজাতলা বাজারেরও। রামমন্দিরের সামনে প্রায় এক বিঘা জমির উপরে এই বাজারটি দেবত্র সম্পত্তি। বেশির ভাগ দোকানেই পলিথিনের আচ্ছাদন। ব্যবসায়ী মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ডু বলেন, “বাজারে প্রায় ৩০টি মিটার আছে। সিইএসসি-কে বার বার তার পাল্টাতে বলা হয়েছে। কিছুই হয়নি। ২০-২৫ বছর আগে এক বার আগুন লেগে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। নতুন বাড়ি তৈরির কথা ছিল। রামরাজা পরিষদের গাফিলতিতে তা হয়নি।” এই অবস্থার কথা স্বীকার করে রামরাজা পরিষদের সভাপতি দেবেশ সান্যাল বলেন, “বাজারে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ দোকানই বাঁশ, কাঠ, প্লাস্টিকের। আগুন লাগলে ভয়াবহ আকার নিতে পারে। অলোকদূত দাস মেয়র থাকাকালীন বাজারটি পুরসভার নিয়ে নেওয়ার কথা হয়েছিল। বাজারের জন্য পিপিপি মডেলে একটি নতুন বাড়ি করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কোনওটাই কার্যকর হয়নি।” |
|
পাশাপাশি, শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কদমতলা বাজারের অধিকাংশ দোকানই এইচআইটি রোডে উঠে এসেছে। এখন কদমতলা মোড় থেকে লক্ষ্মীনারায়ণ চক্রবর্তী লেনের মোড় পর্যন্ত বাজার বসে যায়। ডিভাইডারও বিক্রেতাদের দখলে চলে গিয়েছে। অধিকাংশ দোকানই প্লাস্টিকের ছাউনির তলায়। কদমতলা বাজার সমিতির সম্পাদক প্রশান্ত দে বলেন, “কদমতলা বাজারের পরিকাঠামো ভাল নয়। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বলতে কিছুই নেই।”
সিইএসসি-র জেনারেল ম্যানেজার সুজিত পোদ্দার বলেন, “কলকাতার মতো হাওড়াতে পুলিশ-কর্তৃপক্ষ, দমকল, পুরসভা ও সিইএসসি-র মিলিত কোনও কমিটি নেই। তাই বাজারগুলি নিয়মিত পরিদর্শন করা যায় না। থাকলে সুবিধা হত। তবে স্বাভাবিক ভাবে যে সমস্যাগুলি নজরে আসে, সেগুলির ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
দমকলের ডেপুটি ডিরেক্টর (পশ্চিমাঞ্চল) বিভাস গুহ বলেন, “হাওড়ার কোনও বাজারেরই পরিকাঠামো ভাল নয়। সব বাজারেই প্লাস্টিকের ছাউনি আছে। আমরা শীঘ্রই বাজার কমিটিকে ডেকে আলোচনা করব। তাতে পুরসভা, দমকল ও পুলিশ থাকবে। নিয়ম মেনে চলার জন্য বাজার কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হবে। বাজারগুলিতে নিয়মিত নজরদারিও চালানো হবে।” হাওড়া পুরসভার মেয়র মমতা জয়সোয়াল বলেন, “পুরসভার অধীনে যে সব বাজার আছে, সেখানে পুরসভার আধিকারিকদের নিয়মিত পরিদর্শনে পাঠানো হয়। আধিকারিকরা পুর বাজারগুলি নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট দেন। তবে, বিক্রেতাদের একাংশ বিপজ্জনক ভাবে সংযোগ নেন। হরগঞ্জ বাজারে পিপিপি মডেলে কাজ হয়েছে। বিক্রেতারা নকশা অনুযায়ীই স্টল পেয়েছেন। ব্যক্তিগত মালিকানার বাজারগুলির ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই।”
|
ছবি: রণজিৎ নন্দী। |
|
|
|
|
|