কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি হইতে মহিলাদের সুরক্ষা সংক্রান্ত আইনে গৃহ-পরিচারিকাদেরও অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আনিয়াছে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। প্রস্তাবটি তাৎপর্যপূর্ণ। সারা দেশে নথিভুক্ত পরিচারিকার সংখ্যা ৪৭ লক্ষ ৫০ হাজার। এই সংখ্যাটি অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মহিলাদের ৩০ শতাংশ। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পরিচারিকাদের নিজস্ব সংগঠন এখনও দেশের অধিকাংশ শহরে অস্তিত্বহীন। যেখানে এমন সংগঠন রহিয়াছে, সেখানেও সকল পরিচারিকা নিজেদের নাম নথিভুক্ত করান না। তাই গোটা দেশে গৃহ-পরিচারিকাদের সংখ্যা নিশ্চিত রূপেই কয়েক কোটির কম হইবে না। বস্তুত, অধিকাংশ মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারে মহিলা পরিচারিকা এক অতিপ্রয়োজনীয় সদস্য। রান্নাবান্না ও গৃহস্থালির রকমারি কাজ হইতে শুরু করিয়া বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছাইয়া দেওয়া ও বাড়িতে ফেরত আনার মতো নিত্যকর্মও তাঁহাদের উপর সঁপিয়াই গৃহিণীরা নিশ্চিন্ত থাকেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই চাকুরিরত যেখানে, সেই সব পরিবারে তো পরিচারিকা ছাড়া এক দণ্ডও চলিবে না। এবং এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা ক্রমেই বর্ধমান।
পরিচারিকারা তাই মহিলা শ্রমিকদের এক অতিবৃহৎ অংশ। কিন্তু নথিভুক্ত না হওয়ায় এবং নিজস্ব সংগঠন না-থাকায় তাঁহাদের একটা বড় অংশই যৌন হয়রানি সহ নানাবিধ লাঞ্ছনা ও নিগ্রহের শিকার হইয়া থাকেন, যাহার প্রতিকারের কোনও ব্যবস্থাই দেশের আইনি বন্দোবস্তে নাই। প্রায়শ বাঁধা কাজের নিরাপত্তা হারাইবার ভয়ে পরিচারিকারা মুখ বুজিয়া যৌন হয়রানি সহ্য করিতে বাধ্য হন। প্রতিবিধানের উপায় থাকিলে এই অন্যায় তাঁহাদের সহিত অত সহজে ঘটিতে পারিত না। অন্যায়কারীরাও শাস্তির ভয়ে (এবং অবশ্যই জানাজানি-জনিত লোকলজ্জার ভয়ে) সতর্ক থাকিতেন। আইন অনেক ক্ষেত্রেই অন্যায় প্রতিবিধানের একমাত্র এবং সর্বক্ষমতাশালী অস্ত্র নহে, কিন্তু আইন বহু ক্ষেত্রেই অস্ত্রসম্ভারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ।
সরকার প্রস্তাবিত সংশোধনী বিষয়ে আপত্তি করিয়াছিল এই যুক্তিতে যে, পারিবারিক জীবনের চার দেওয়ালের অভ্যন্তরে সংঘটিত যৌন হয়রানির ঘটনা প্রমাণ করা সহজ নয়। প্রশ্নটি কিন্তু অভিযোগ প্রমাণ করিবার সুবিধা-অসুবিধা সংক্রান্ত নয়, হয়রানির শিকার মহিলার ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সংক্রান্ত। আইন হইলেই দলে-দলে নির্যাতিত পরিচারিকারা তাঁহাদের ‘অন্নদাতা’ নিয়োগকর্তাদের আচরিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাইতে থানায় ছুটিবেন, এমনটা না-ও হইতে পারে। কিন্তু ন্যূনতম আইনগত রক্ষাকবচও যদি তাঁহাদের না থাকে, তবে হয়রানির প্রতিবাদ করার সাহসও তো তাঁহারা পাইবেন না। পারিবারিক হিংসা নিরোধে যে আইন রহিয়াছে, তাহাও তো পরিবারের ‘চার দেওয়ালের মধ্যে’ ঘটমান হিংসার বিরুদ্ধে প্রযোজ্য। পরিচারিকাদের যৌন হয়রানির বেলায় সেই বিবেচনা প্রযোজ্য নয় কেন? সুখের কথা, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সরকারের আপত্তি খারিজ করিয়া আপন প্রস্তাবে অবিচল থাকিয়াছে। যে-পুরুষতন্ত্র স্ত্রীকেও সম্পত্তির অংশ মনে করে, দরিদ্র, সহায়সম্বলহীন পরিচারিকাকে তো সে সর্বপ্রকারে হয়রান ও লাঞ্ছনা করার বিশেষাধিকার ভোগ করিতে চাহিবেই। নূতন আইনে অন্তত তাহার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইবার একটা আইনগত সমর্থন ও সহমর্মিতা মিলিবে। কম নয়। |