এক ‘অত্যাধুনিক’ হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডে সত্তরাধিক রোগীর মৃত্যু এই শহরকে গোটা বিশ্বের সম্মুখে অপরাধীর আসনে দাঁড় করাইয়া দিল। এমন ঘটনা ভারতে তো বটেই, বিশ্বেও সম্ভবত ঘটে নাই। অসুস্থ মানুষগুলির অসহায় মৃত্যু, শ্বেতবস্ত্রে ঢাকা মৃতদেহের স্তূপ, আতঙ্কে দিশাহারা স্বজন, দৃশ্যগুলি সকলের মধ্যে এক প্রচণ্ড স্নায়বিক ত্রাস সৃষ্টি করিয়াছে। ইহা নিছক দুর্ঘটনা নহে, সন্ত্রাসবাদীর দুরভিসন্ধির ফল নহে, প্রযুক্তির গোলযোগও নহে। এ কথা মনে করিবার বিলক্ষণ হেতু আছে যে, ইহার উৎস অতি সামান্য নিয়ম মানিবার অনিচ্ছা। প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ, ভূগর্ভস্থিত ঘরটিতে দাহ্য পদার্থ মজুত রাখিয়া অগ্নি-নিরাপত্তার প্রথম শর্তটিই ভঙ্গ করিয়াছে বেসরকারি হাসপাতালটি। ইহা প্রমাণিত হইলে কর্তৃপক্ষ দোষী তো বটেই (হাসপাতালের লাইসেন্স তৎক্ষণাৎ বাতিল করা হইয়াছে), তৎসহ দমকল দফতর এবং স্বাস্থ্য দফতরও দায়ী। হাসপাতালগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থা কাজ করিতেছে কি না, এ বিষয়ে তাহাদের সজাগ থাকিবার কথা।
তাঁহারা সজাগ ছিলেন, এমন অনুমানের কোনও অবকাশ নাই। নন্দরাম বাজার পুড়িবার পরেও অপর বাজারগুলি পূর্বের মতোই অরক্ষিত রহিয়াছে, স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ড হইতে শিক্ষা লইয়া অপরাপর বহুতলগুলির নিরাপত্তা জোরদার করা হয় নাই। তেমন ভাবেই হাসপাতালের অগ্নি-নিরাপত্তার মতো জরুরি ক্ষেত্রেও নিয়মের স্থান হইয়াছে কেবল খাতায়। এই ব্যাধি শুধু সরকারের নহে, সমাজের। যে কোনও বিধিনিষেধকে আমরা কাকতাড়ুয়া বানাইয়াছি। লাইসেন্স কিংবা সার্টিফিকেট-এর প্রয়োজন কেবল অপরকে দেখাইবার জন্য, জরিমানা ঠেকাইবার জন্য। আইন কিংবা সরকারি নির্দেশ যত যুক্তিযুক্তই হউক, তাহাকে আমরা অন্তরে মানিয়া লই না, অন্দরে স্থান দিই না। না-মানিবার আস্ফালনেই আমাদের অহংবোধের প্রকাশ। ইহা মূর্খামি, এই দুর্ঘটনা তাহারই অনিবার্য ফল। আজ আমাদের লজ্জা রাখিবার জায়গা নাই।
মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী এই শহর, এই রাজ্যের সকল নাগরিক আজ স্বজনবিয়োগের তীব্র ব্যথা অনুভব করিতেছে। আপন আপন বৃদ্ধ পিতা-মাতা, স্বামী, স্ত্রী কিংবা সন্তানকে ওই স্থলে চিন্তা করিয়া, তাঁহাদের ভয়ার্ত, আতুরের ন্যায় জীবননাশের কল্পনা করিয়া শিহরিয়া উঠিতেছে। জীবনের পরিণতি মৃত্যু, তাহা সকলেই জানে। কিন্তু যাঁহারা আমাদের জীবন দিয়াছেন, যাঁহারা জীবনকে অর্থবহ, মধুময় করিয়া তুলিয়াছেন, তাঁহাদের মৃত্যুকে সুন্দর, সহনীয় করিয়া তোলাই তো আমাদের কতর্ব্য। তাহাই তো সান্ত্বনা। শ্বাসরুদ্ধ হইয়া, অগ্নিদগ্ধ হইয়া অপঘাত-মৃত্যু ঘটিলে স্বজন ও বন্ধুদের জীবনে যে আক্ষেপ, যে অপরাধবোধ জন্মায়, তাহা কিছুতেই মুছিতে চাহে না। নিজের পরমাত্মীয়ের আরোগ্য কামনায় সাধ্যাতিরিক্ত খরচ করিবার অভিজ্ঞতা অনেকেরই হইয়াছে। ভারতে অল্প মানুষেরই স্বাস্থ্য বিমার সুরক্ষা রহিয়াছে। চিকিৎসা করাইতে গিয়া পরিবারের ঋণগ্রস্ত হইবার হার ভারতে খুবই বেশি। অথচ এই অর্থব্যয় নানা কারণে নিরর্থক হইয়া যায়। কখনও চিকিৎসক রোগীর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেন না, কখনও পরিষেবায় ত্রুটির ফলে সংক্রমণ ঘটিয়া যায়, কখনও অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার ফলে ব্যাধির চাইতে ব্যয়ভার গুরুতর হইয়া উঠে-- এমন সব অভিযোগ কান পাতিলেই শোনা যায়। এ বার কলিকাতার বেসরকারি হাসপাতাল প্রমাণ করিল, রোগে না মরিলেও প্রাণ লইয়া বাড়ি ফিরিবার নিশ্চয়তা নাই। অগ্নি প্রতিরোধের ব্যবস্থা, কিংবা অগ্নিকাণ্ডে দ্রুত রোগী বাঁচাইবার ব্যবস্থা, কোনওটি নিশ্চিত না করিয়াও হাসপাতাল চালানো যাইতে পারে। হাসপাতালের অন্তত দুইটি ওয়ার্ডের সমস্ত রোগী অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারাইয়াছেন, এ কথা জানিবার পর কাহার না প্রাণ কাঁপিবে? কোনও আদালতে এই অপরাধের সুবিচার সম্ভব নহে, কোনও সরকার এই ক্ষতি পূরণ করিতে পারিবে না। এই শোকের সান্ত্বনা নাই। |