সিনেমা সমালোচনা ২...
ভাল ভূতের ছবি
‘বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো’অঙ্কে তেরো পাওয়ার ভয়টা বুরুনের মতো বাচ্চার কাছে ভূতের ভয়ের চেয়েও বেশি।
‘হাবু কিন্তু রেগে যাচ্ছে’— দোর্দণ্ডপ্রতাপ হাবু ডাকাত রেগে গেলে বুরুনের যত না ভয় করে তার চেয়েও বেশি ভয় করে অঙ্কে তেরো পেলে।
বুরুন তা হলে কী করবে?
ওই যে কথায় বলে বলে না, আপনের চেয়ে পর ভাল, আর পরের চেয়ে জঙ্গল। বুরুনের কাছে জঙ্গলই তাই ভাল। যেখানে বুরুনকে অঙ্কে তেরো পেয়ে মা-বাবা, মাস্টারমশাইয়ের লাঞ্ছনা ভুলিয়ে দেয় বনের ফুল, গাছে গাছে দোল খাওয়া পাখি। ডালে ডালে ছুটে বেড়ানো কাঠবিড়ালি। হেসে উঠে সেলাম জানায় লতাপাতারা। আর তার পরেই ঝপাং করে কোথা থেকে যেন এসে পড়ে রোগা-ঢ্যাঙা নিধিরাম ভূত। আর বলে, “বুরুন, এত মন খারাপ করে থেকো না। অঙ্কে তেরো পাওয়ার ঝামেলাটা আমি মিটিয়ে দেব।”
স্বপ্নে হোক বা সত্যি, বুরুন একশোয় একশো পেয়েই যায়।
যে কোনও বাচ্চাই এমন দৃশ্য দেখলে তাজ্জব হয়ে যাবে।
অবিশ্বাস্য। কিন্তু এমনটা যদি সত্যি হয়?
গোঁসাইবাগানের ভূত
ভিক্টর, পরান, টিনু, কাঞ্চন, তোজো
শিশুমনের সহজ সরল বিশ্বাসকে ঘিরে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ বাচ্চাদেরই, নয় ছুঁয়ে ফেলেছিল বড়দের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিশু মনকেও। সেই বুরুনের আজব জগৎ নিয়ে নীতীশ রায়ের ছবি ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ শিশু-কিশোরদের সরল স্বপ্নের সেই রূপকথার জগৎকেই পদার্য় বুনেছে। যে স্বপ্নে কোনও জটিলতা নেই, স্বপ্ন আর সত্যির মধ্যে কোনও পাঁচিলও তোলা নেই।
সিনেমা দেখতে গিয়ে ছোটরাই নয়, বড়দেরও মনে হতে পারে, এই টানাপোড়েনের জীবন থেকে পালাতে— এক বার চলো যাই গোঁসাইবাগান....। বুরুনের ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’ গোঁসাইবাগানের গাছপালা, ফুল-পাখি, জীবজন্তুর ছবি নিজে হাতে রঙিন করে এঁকে অ্যানিমেশনে জীবন্ত করে তুলেছেন পরিচালক। বাচ্চারা দেখে ভাবতে পারে, এ যেন তাদেরই ড্রইং খাতা।
সিড়িঙ্গে নিধিরাম ভূত আর বুরুন যখন সুখদুঃখের গল্প করে, মনে হয় এমনটাই তো স্বাভাবিক। নিধিরাম বুরুনের সঙ্গে গল্প করবে না তো কার সঙ্গে গল্প করবে? আবার যখন সেই নিধিরামভূত তার ম্যাজম্যাজে শরীর সারাতে গোঁসাইপুরের রাম কবিরাজের কাছে গিয়ে দাওয়াই চায় তখন মনে হয়, ভূত বলে কি মানুষ নয়? তার কি গা ম্যাজম্যাজ করতে পারে না? আরে বাবা, তাদেরও তো ঘোর জঙ্গলে হাবু ডাকাতের ডেরায় খেটে খেতে হয়।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের যে কোনও গল্পের ভূত-রাজ্যই এমন অসংখ্য ফ্যান্টাসিতে ভরা যে, ছবি করতে গেলে ১০ বার ভাবতে হবে, ছবিটা আদৌ করা যাবে কি না! ‘গোঁসাইবাগান’ তাই অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং একটা চেষ্টা। হ্যারি পটার বা টিনটিনরাই যে সব নয়, বাংলা কিশোর সাহিত্যেও যে লুকিয়ে রয়েছে অজস্র ম্যাজিক, নীতীশের ছবি আজকের শিশুকিশোরদের সেই আঁচটা দেওয়ারই চেষ্টা করেছে।
“এক যে ছিল বুরুন, এক যে ছিল অঙ্ক, এক যে ছিল অঙ্কের নম্বর গাড্ডা, এক যে ছিল ছিল ছমছম, সেই ছমছম বাগান জুড়ে ভূতের আড্ডা”— ‘চন্দ্রবিন্দু’র লেখা এই টাইটেল সং ছবির প্রথমেই মনের সেই জায়গাকে ছুঁয়ে ফেলে, যেখানে রূপকথারা জন্ম নেয় যখনতখন। ছোট বড় বা বয়সের হিসেব মানে না। ভূতের রাজ্যের অর্ধেকটা জায়গা জুড়ে আছে প্রতুল মুখোপাধ্যায়, শিলাজিৎ, খরাজ মুখোপাধ্যায়, অনিন্দ্য-উপল প্রমুখ শিল্পীদের জমজমাট গান, ছবির অন্যতম চরিত্র হয়ে।
দু’শো বছর ধরে গোঁসাইবাগানের বাসিন্দা সিড়িঙ্গে নিধিরাম ভূতের সঙ্গে বুরুনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার মুুহূর্তগুলো জমিয়ে দিয়েছেন কাঞ্চন মল্লিক ও বুরুনের চরিত্রে তোজো। কখনও আয়তনে ছোট, কখনও অসম্ভব ঢ্যাঙা নিধিরামের কল্পনাটি খাঁটি দেশজ বলা যায় না। বিদেশি অ্যানিমেশনে এমনটা হামেশাই হয়। তবে হালের বাংলা সিনেমায় এ হল নতুন চমক। গোঁসাইবাগানের ভুতুড়ে রাজ্য ঘিরে উপন্যাসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত চিত্রনাট্যে রাখা হয়নি কেন, তা নিয়েও প্রশ্ন থাকে। চিত্রনাট্যের মাঝে মাঝে কিছু ঢিলেমি আছে। যেটা গান আর অ্যানিমেশনের নাটকীয়তায় সব সময় ঢাকা পড়েনি।
ছবির মেজাজ তৈরিতে দারুণ বুরুনের দাদু রাম কবিরাজের চরিত্রে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, অঙ্কের মাস্টারমশাই করালী স্যারের চরিত্রে পরান বন্দ্যোপাধ্যায়। রাম কবিরাজ আর বুরুনের মধ্যে বন্ধুত্বের ভাবটি খুব প্রাণবন্ত। দাদু-নাতিদের ভাবসাব তো এই রকমই। কে ছোট, কে বড় বোঝা যায় না। হাবু ডাকাতের চরিত্রে আশিস বিদ্যার্থী যথাসম্ভব চেষ্টা করলেও তাঁর মেক-আপ, অভিনয়ের ধরনধারণ বা ডাকাতদলের নাচের কোরিওগ্রাফি নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তার ছোঁয়া থাকলে ভাল হত। অন্যান্য চরিত্রে খরাজ মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর চক্রবর্তী, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন দাপটে। বুরুনের মা হিসেবে লকেট চট্টোপাধ্যায়কে মানিয়েছে ভাল। তবে তাঁকে আরেকটু জায়গা দেওয়া যেত।
অনেক দিন পর ফেলুদা সিরিজের বাইরে একটি সাহিত্যভিত্তিক বাংলা কিশোর কাহিনি নিয়ে সিনেমা।
যে সব বুরুন অঙ্কে তেরো পায়, আর যে সব বুরুন হামেশাই অঙ্কে একশোয় একশো পায় সকলের জন্য এইটাই সব থেকে বড় সুখবর।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.