|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা ১... |
|
বিদ্যায় স্মিত |
শরীর নিয়ে ছবি। শরীরকেন্দ্রিক যাবতীয় ব্যাকরণ ভেঙে ফেললেন। অবলীলায়।
বলিউডি হিরোইন-এর ইমেজ দুমড়ে মুচড়ে। লিখছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
আমাদের বিগত বাল্যের পাড়ায় এক জন মাইমা ছিল, বেবি মাইমা, আমরা তার নাম দিয়েছিলাম সিল্ক স্মিতা, বেবি মাইমার চওড়া ভরাট শরীর, কষা কষা গায়ের রং, পটল চেরা চোখ, টসটসে ঠোঁট আর থামের মতো ভারী ঊরু নিয়ে যখন শ্যাম্পু করে চুল শুকোতে দাঁড়াত পাড়ার মোড়ে তখন মনে হত বিন্ধ্যপর্বতের ও পার থেকে উঠে আসা দ্রাবিড় সভ্যতার এক ভাস্কর্য নিদর্শন। আমরা ভাবতাম পোস্ট অফিসের কেরানি হাবলু মামা একে সামলায় কী করে? সে সময়টাই ছিল ‘তোফা তোফা তোফা তোফা’র বাপ্পি লাহিড়ীর, ছিল শ্রীদেবী-জিতেন্দ্রর, গানের দৃশ্যের দৃশ্যসজ্জায় হাঁড়ির একটা ভূমিকা থাকত, প্রতিটা ছবিতে একটা রেপ সিন ছিল অবধারিত, নায়িকার সঙ্গে থাকত সামান্য পৃথুলা একজন ভ্যাম্প, পঞ্চাশোর্ধ্ব নায়ক সাদা প্যান্ট-লাল গেঞ্জি পরে কলেজে ক্লাস করতে যেত, নায়িকা বিয়ের আগে পরত গোলাপি প্যান্ট আর বিয়ের পরে পরত শিফন শাড়ি আর মঙ্গলসূত্র, প্রতিটা ছবিতে একটা পুলিশে পেটানোর দৃশ্য থাকত‘দ্য ডার্টি পিকচার’ রিলিজ করার অনেক আগে থেকেই এই ‘তোফা তোফা’, এই শ্রীদেবী এবং বেবি মাইমা সম্মিলিত একটা নস্টালজিক আঘাত হয়ে নেমে এল মনের ওপর কারণ মিডিয়ার ম্যধ্যমে তত ক্ষণে আমরা জেনে গেছি ‘ডার্টি পিকচার’ দক্ষিণের আধা-নায়িকা সিল্ক স্মিতার জীবন আধারিতসেই সিল্ক স্মিতা যাঁর উদ্ভিন্ন যৌবনকে সাঁতার কাটতে দেখেছি আমরা বেশ কয়েকটা হিন্দি ছবিতে। একটা দ্বন্দ্ব ছিল বিদ্যা বালনের বুদ্ধিদীপ্ত সৌন্দর্য, লালিত্যের মধ্যে থেকে এই দাক্ষিণাত্যের স্পাইস সাম্রাজ্যের উগ্র ঝাঁঝ আর তীব্রতা বেরিয়ে আসবে কি না? সত্যি বলতে কী, অভিনেত্রী হিসেবে ‘দ্য ডার্টি পিকচার’-এ বিদ্যা বালনের যে কালমিনেশন ঘটতে দেখলাম, এই মুহূর্তে তাঁর তূল্য প্রতিভাবান আর কোনও নায়িকার অস্তিত্ব বলিউডে আছে কি না মনে করতে পারছি না। যে ছবিতে শরীর একটা কেন্দ্রীয় বিষয় সেই ছবিতে বিদ্যা বালন কী ভাবে শরীরের সমস্ত মেনস্ট্রিম ব্যাকরণকে অবহেলা করে শরীরী অভিনয়কে সেরিব্রাল অভিনয় করে তুললেন তা বলিউডের সারাক্ষণ নিজের শরীর নিয়ে ‘অবসেস্ড’ এবং শরীর নিয়ে বিব্রত নায়িকাদের দেখা উচিত। ছবির শেষের দিকে হতাশাগ্রস্ত এবং মদ্যপানাসক্ত বিদ্যা যে ভাবে একটি দৃশ্যে থলথলে পেট নিয়ে অভিনয় করলেন তাতে এই ‘হট বড’-এর যুগে এক জন মেনস্ট্রিম নায়িকার এই ঝুঁকি নেওয়ার সাহস আমাদের অবাক করে। |
|
দ্য ডার্টি পিকচার
বিদ্যা বালন, নাসিরউদ্দিন শাহ, ইমরান হাশমি |
যদি বলেন ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ দেখতে দেখতে আমার কেন মেরিলিন মনরোকে মনে পড়ল তা হলে বলতে হবে সিলভার স্ক্রিনে যাদের ছায়াপাত ভারী করে তোলে মানুষের নিঃশ্বাস, রক্ষণশীলতার ট্রাউজারের তলায় ‘টিকল’ করে পর্দায় যাদের অঙ্গচালনা, তাদের যতই বলা হোক ব্রেনলেস বিউটি, মননহীন সেক্স সিম্বল, আত্মবীক্ষণহীন সেক্স বম্বআসলে তারা কিছু কম বোঝেনি মানুষের মনস্তত্ত্ব, প্রবণতা এবং পিপাসাকে। যত বার তারা পোশাক খুলেছে দর্শকের সামনে তত বারই কি তারা দর্শকের চটুল প্রবৃত্তিকে নগ্ন করেনি? ‘দ্য ডার্টি পিকচার’-এর সিল্ক পর্দায় যৌনতা ছড়িয়ে বাড়ি ফিরে স্নান সেরে পবিত্র হওয়ার চেষ্টা করেনি, সে তার জীবন যাপনের মধ্যে দিয়েও ‘ঘাটিয়া অউরত’-এর তকমাটাকে উদযাপন করেছে। বাথটাবে বসে স্নান করতে করতে ইন্টারভিউ দিয়েছে, বিশ্বাস করেছে যে হেরে যাওয়া রেসের ঘোড়ার কানে যৌনতার মন্ত্র দিলে সে বাজি জিতে যাবে, বিশ্বাস করেছে ‘হিরো হো ইয়া ভিলেন, হর কহানি কা ভ্যাম্প ম্যায় হুঁ’, আবার ‘তুম হম মে সে নহি হো, ইউ আর আওয়ার ডার্টি সিক্রেট’ এই সত্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে শুধু দেখেছে ম্যাগাজিনের পাতায় তাঁর ছবি আরও উত্তেজক, আরও চটুল দেখাচ্ছে কি না, আর এই সরলতার মুহূর্তেই তাকে সব চেয়ে প্রতিবাদী লেগেছে আমাদের।
প্রতিবাদী লেগেছে যখন ‘রাঙ্গা কাওবয়’ হেভিওয়েট স্টার সূর্যকান্ত (নাসিরউদ্দিন)-কে পাঁচশো বার টিউনিং (পড়ুন শোয়া) করার প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছে থেকে তার স্ক্রিন স্পেস শেয়ার করার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে ছবির সিল্ক। (‘তুমনে পাঁচশো লড়কিও কে সাথ টিউনিং কি হ্যায় তো ক্যায়া, তুমনে কভি এক লড়কি কে সাথ পাঁচশো বার টিউনিং কি হ্যায়?’)। সত্যি, ছবির সংলাপ লেখক রজত অরোরাকে সেলাম জানাতে হয়।
আসলে তথাকথিত প্রগতিবাদী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলোতেও অবলীলায় চলতে থাকে পুরুষতন্ত্র আর তার শিকার অবশ্যই মেয়েরা। যখন স্টার নায়িকা ইন্টারভিউ দিতে এসে বলে, “কাস্টিং কাউচ বলে একটা জিনিস আছে শুনেছি, এর বেশি কিছু জানি না,” তখন বোঝা যায় মেয়েদের স্টারডম বলে আসলে কিছু হয় না, অনেক বড় নক্ষত্র হয়েও সত্য স্বীকার করার মতো উঁচুতে সে উঠতে পারেনি। পুরুষতন্ত্র, পাওয়ার স্ট্রাগ্ল, কাস্টিং কাউচ এবং হিপোক্রেসি এই সব মিলিয়েমিশিয়েই যে এন্টারটেনমেন্টের মহাজগৎ তা আরও এক বার মনে করিয়ে দেয় ‘দ্য ডার্টি পিকচার’। এই ব্যাখ্যায়, বিবরণে পরিচালক মিলন লুথারিয়া অন্তত কোনও হিপোক্রেসি করেননি।
ছবির সিল্ক জানত তার ইহজগৎকে দেওয়ার মতো একটাই সম্পদ আছেশরীর। সেই শরীর দিতে দিতে দেউলিয়া হয়ে একটা অকর্ষিত জমির মতো হৃদয় নিয়ে সে আত্মহত্যাকে বেছে নিল। যে ভয় থেকে সে পৃথিবী থেকে সরে গেল সেই ভয় আমাদেরও প্রত্যেকের আছে কারণ শরীর, মনন, মেধা যাই আমরা বিক্রি করি না কেন, আমাদের খদ্দেরদের কাছে একদিন তার সব ম্যাজিক ফুরিয়ে আসে, ক্লান্ত হয়, চটক হারায়, রসগোল্লা খাওয়ার পর তার বিরক্তিকর চ্যাটচ্যাটে রসের মতো এক সময় আমাদের শরীর, আমাদের শিল্প, আমাদের মনন মনে হয় একই জিনিসের একঘেয়ে রিপিটেশন। তখনই আমাদের বাতিল হওয়ার সময়।
ছবির প্রায় শেষাশেষি একটা অসাধারণ বক্তৃতা আছে সিল্কের “না আপ বদলোগে, না ম্যায়” দিয়ে শুরু হওয়া এই বক্তৃতাটা বেশ শোনার মতো। একটা কালো স্পেস দিয়ে ছবি শুরু হয়েছিল। সেই ছবিই শেষ হওয়ার পর মনে হল চাঁদের উল্টো পিঠের মতো এ হল ফেমিনিজ্মের উল্টো পিঠ। সিল্কের জীবনদর্শন যেন একটা ‘র’ নারীবাদ। সব ভেস্তে দেওয়ার নারীবাদ। এক জায়গায় সিল্ক বলছে, “হর আদমি কে লিয়ে এক আউরত বনি হ্যায়, উসসে বাঁচ গয়ে তো লাইফ বাঁচ গয়ি।” ‘পরিণীতা’, ‘পা’, ‘নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা’র পর ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ক্রমশ আরও বড় ঝুঁকি নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যাচ্ছেন বিদ্যা বালন।
আসলে ‘দ্য ডার্টি পিকচার’-এ ঝুঁকি নেওয়টাকেই বেদম সেলিব্রেট করেছেন তিনি। |
|
|
|
|
|