প্রার্থনার মঞ্চে প্রত্যয়ের পতাকা উড়িয়ে দিয়ে গেলেন দ্রাবিড়
সাদা জার্সিটা তখনও ঘামে ভেজা।
নাকি ভুল দেখলাম? ঘামে ভেজা নয়। ভেজা শততম সেঞ্চুরি ফের মাঠে ফেলে আসার অশ্রুতে!
সচিন তেন্ডুলকর ইডেন থেকে ফিরছেন। টিম বাস এসে হোটেলের সামনে দাঁড়াল। একে একে তাঁর সতীর্থরা নামতে শুরু করেছেন। রাহুল দ্রাবিড় এলেন। লবিতে অপেক্ষারত অটোগ্রাফশিকারিরা সঙ্গে সঙ্গে ঘিরে ধরল আর তৎক্ষণাৎ নিরাপত্তারক্ষীরা ভিড় পরিষ্কার করতে শুরু করে দিলেন। তার মধ্যেই দিনের নায়কের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করেছে অভিনন্দনের স্রোত। ‘ওয়েল প্লেড রাহুল।’ ২০৭ বলে ১১৯ করে ফেরা তিনি ‘থ্যঙ্কস থ্যাঙ্কস’ বলতে বলতে কোনও রকমে এগোতে থাকলেন।
ক্রিজের মতোই সতর্ক, সাবধানী। বরাবরের মতোই বিনয়ী। যিনি মনে করেন, মানুষ এক দিন ক্রিকেটার রাহুল দ্রাবিড়কে ভুলে যাবে। যখন তিনি আর ব্যাট হাতে বাইশ গজে উদয় হবেন না। মনে রাখবে রাহুল দ্রাবিড় মানুষটা কেমন ছিল। সেটাই তাঁর চূড়ান্ত মার্কশিট। এমন জীবনদর্শন যাঁর, তিনি তো খুব স্বাভাবিক ভাবেই খেয়াল রাখবেন, সাফল্যের দিনে অসাবধানতাবশত যেন কাউকে আঘাত না দিয়ে ফেলি। কোথাও যেন অপ্রত্যাশিত ঔদ্ধত্য বেরিয়ে না পড়ে। বাইশ গজের মতোই জীবনের রাস্তাতেও একই রকম ক্ল্যাসিক!
ধোনি এলেন। লবিতে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছেন এক পরিচিত। জিজ্ঞেস করলেন, আজ কী প্ল্যান? ভারত অধিনায়ক বললেন, “রুমেই আছি। কোথাও বেরোচ্ছি না।” ১-০ এগিয়ে থাকা তাঁর দল প্রথম দিনে তুলে ফেলেছে ৩৪৬-৫। প্রায় চার রানের কাছাকাছি রানরেট রেখে। টেস্ট ক্রিকেট আন্দাজে দুর্দান্ত। ইডেনের প্রিয় সন্তান ভিভিএস লক্ষ্মণ ৭৩ ব্যাটিং। লক্ষ্মণ সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি ব্যাট করছেন আর অন্যমনস্ক হয়ে ক্রিকেট দর্শক হয়তো সাময়িক খেলা থেকে চোখ সরিয়েছে। মিনিট পনেরো আড্ডা-টাড্ডা সেরে হঠাৎ স্কোরবোর্ডের দিকে তাকালেন আর আবিষ্কার করলেন, লক্ষ্মণ ৩০ ব্যাটিং। কখন যে রান করে ফেললেন বোঝাই যায় না। এবং দ্রাবিড়ের সঙ্গে তাঁর কেমিস্ট্রি। দশ বছর আগে ইডেনে স্টিভ ওয়ের বিজয়রথ থামিয়ে দিয়েছিলেন সারাদিন ধরে দু’জনে ব্যাটিং করে। এ দিন জুটিতে ১৪০ তুলে তেন্ডুলকর-বিদায়ের অন্ধকার থেকে টেনে বার করে আনলেন।
প্রতিবন্ধী ভক্তের সঙ্গে সচিন। হোটেলে ফিরে এই ভক্তকেই নিজের জার্সি উপহার দিলেন তিনি।
সোমবার ইডেনে যা পরে নেমেছিলেন শততমের সন্ধানে। ছবি: উৎপল সরকার
দ্বিতীয় দিন সকালে তিন বল পুরনো দ্বিতীয় নতুন বলের সামনে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে না পড়লে টেস্টে চালকের আসন দখল করা নিশ্চিত। ইডেন পিচ নিয়েও আর কোনও চাঞ্চল্যকর বিবৃতি অধিনায়কের মুখ থেকে বেরোবে বলে মনে হয় না। লবিতে টস জেতার জন্য অভিনন্দন জানালেন কেউ কেউ। ধোনি হেসে ফেললেন। তাঁর যা টসের ভয়াবহ মন্দা যায় মাঝেমধ্যে! “এই ভাগ্যটা যেন সঙ্গে থাকে,” তাই প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলে গেলেন তিনি।
এ বার তিনি সচিন তেন্ডুলকর। ঠিক যেমন ইডেন অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল সকালে। কলকাতা অপেক্ষা করছিল। গৌতম গম্ভীর এখন কার্যত কলকাতার ঘরের ছেলে। কলকাতা নাইট রাইডার্সের ক্যাপ্টেন। গম্ভীরের সেঞ্চুরির একটা আবহও তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু ১০৩ বলে ৬৫ করে তাঁর পতনেও সংখ্যালঘু ইডেনের কোনও হাহাকার নেই। বরং উচ্ছ্বাস আছে। ড্রেসিংরুমের বারান্দা দিয়ে যে বেরিয়ে পড়েছেন সচিন তেন্ডুলকর!
কিছুটা এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়তে হল। হুইলচেয়ারে বন্দি বছর কুড়ির এক তরুণ তখন সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে। প্রতিবন্ধী সেই তরুণ ছবি তুলতে চায়। সচিন সঙ্গে সঙ্গে রাজি। ছবি তুললেন। এর পর তরুণকে কিছু বলতে হল না। নিজেই ব্যাগ থেকে জার্সিটা বার করলেন। যেটা পরে খানিক্ষণ আগে ইডেনে ব্যাটিং করে এসেছেন। “এটা তুমি রেখে দাও। আজ এটা পরেই খেলেছি আমি,” হার্শল গোয়েঙ্কা নামের সেই তরুণকে বললেন নিরানব্বই সেঞ্চুরিতে আটকে থাকা সচিন। বললেন, “আই লাভ ইউ।”
জার্সির নতুন মালিকের পরিবারের লোকজন তখন গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তাঁদের। উচ্ছ্বসিত ভাবে তাঁরা বলছেন, “দেখুন দেখুন। আজকেরই জার্সি। এটা পরেই খেলেছে। এখনও ঘামে ভেজা।” হার্শলকে তাঁর বাড়ির লোকজন ডাকে ‘বস্’ বলে। এ দিকে, তিনি সচিন তেন্ডুলকর ক্রিকেটের ‘বস্’। ইডেনের বর্ম দিয়ে গেলেন ভক্ত ‘বস্’-কে।
দেখে মনে হচ্ছিল, এটাই তো সোমবারের ইডেন, সোমবারের কলকাতার সবচেয়ে গভীর ছবিশততম সেঞ্চুরি হারিয়ে আসা মহাতারকা মাঠ থেকে ফিরেই আবিষ্কার করছেন, এই জগৎ সংসারে আমার চেয়েও অনেক দুঃখী লোক আছে। আমি তো তবু নিরানব্বই সেঞ্চুরির গিরিশৃঙ্গে বাস করছি। আজ না হোক কাল, শতকের শতকও হয়ে যাবে। কিন্তু এঁরা জীবনযুদ্ধের এমন গভীর সংঘর্ষে লিপ্ত যে, সুস্থ মতো চলাফেরার আশীর্বাদটুকুও সঙ্গে নেই।
দু’টো ছবি পাশাপাশি রেখে মাপার চেষ্টা করছি। প্রথমটা দুপুরের ইডেন। যখন ইন্দ্রপতন ঘটল। ৭১ বলে ৩৮ করে ফের সেই আচমকা পুল শট মারতে গিয়ে ফিরে গেলেন সচিন। ঘাতক সেই লেগস্পিনার দেবেন্দ্র বিশু। ফাঁকা ইডেনে যা কিছু লোকজন জড়ো হয়েছিল সবই শততম সেঞ্চুরির সঙ্গে নিজেদের নাম জড়িয়ে রাখার জন্য। এতক্ষণ সচিন বাউন্ডারি মারছিলেন আর সংখ্যালঘু হয়েও জনতা আপ্রাণ জয়ধ্বনি দিচ্ছিল। এ বার নিস্তব্ধ, নির্বাক হয়ে গেল। মাথা নিচু করে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন সচিন। তার পর অধরা শততম সেঞ্চুরির দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আরও এক বার যাত্রা শুরু করলেন প্যাভিলিয়নের দিকে।
এর পর সন্ধেবেলায় হোটেলের লবি। হার্শল গোয়েঙ্কার সঙ্গে তিনি। যতই দু’টো ছবি পাশাপাশি রাখছি ততই মনে হচ্ছে, দ্বিতীয়টা আরও জীবন্ত। আরও মর্মস্পর্শী। ব্যাটসম্যান সচিন তেন্ডুলকরের চেয়েও অনেক বেশি কাতর দেখাচ্ছে মানুষ সচিন তেন্ডুলকরকে! ভাবতে কেমন অবাক লাগে। যিনি লক্ষ লক্ষ লোকের অনন্ত দুঃখ, যন্ত্রণা ভোলার আলো নিয়ে তাদের সামনে উদয় হন, তাঁকেও হোটেলে ফিরে কোথাও একটা নিজের যন্ত্রণা ভোলার জন্য একাকী বালিশে মুখ গুঁজতে হয়। আবার ফিরে যাও সেই ফাইভ স্টার হোটেলের রুমে। পরিবার সঙ্গে নেই। বন্ধুবান্ধব নেই। বাইশ গজে লড়াইয়ের মতোই তুমি একা। রুম সার্ভিস অর্ডার দাও। সেই আবার শূন্য থেকে শুরু করো। ফিরে যাও নিজের ক্রিকেট ল্যাবরেটরিতে।
শিউরে ওঠার মতো একটা হিসেব এ দিন পরিসংখ্যান ঘেঁটে বার করা গেল। মাইলস্টোনের সামনে হোঁচট খেতে থাকা সচিন তেন্ডুলকর। এই নিয়ে শততম সেঞ্চুরির গর্তে তিনি আটকে পড়ে রইলেন পনেরো ইনিংস ধরে। প্রায় আট মাস হয়ে গেল নিরানব্বইতম সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। কিন্তু এর চেয়েও সাংঘাতিক গিয়েছিল গাওস্করের চৌত্রিশ সেঞ্চুরি পেরনোর অধ্যায়। চৌত্রিশ পেরিয়ে পঁয়ত্রিশতম সেঞ্চুরি করতে লেগে গিয়েছিল প্রায় এক বছর। আর সেঞ্চুরির অপেক্ষার হিসেবে সবথেকে দীর্ঘ তাঁর পঁয়ত্রিশ থেকে ছত্রিশ নম্বর টেস্ট সেঞ্চুরিতে পৌঁছনো। সতেরো মাস, সতেরো ইনিংস আর দশ টেস্ট লেগেছিল!
সচিনের সঙ্গী যদি হয় সেঞ্চুরির মাহেন্দ্রক্ষণের সামনে তাঁর মন্দভাগ্যের হিসেব, তা হলে দ্রাবিড়ের আকাশে শুধুই এখন রোদ্দুর। এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে তৃতীয় বার হাজার রান করার দিকে এগোচ্ছেন। ২০১১-তে তিনি দশ টেস্টে করেছেন ৯৫২ রান। পাঁচটা সেঞ্চুরি। গড় প্রায় ৬০। টেস্টে তেরো হাজার রানের কাছাকাছি এসে পড়েছেন। ইডেনে এই নিয়ে হয়ে গেল চারটে সেঞ্চুরি। নয় ম্যাচে মোট সংগ্রহ ৯৬২। গড় প্রায় ৬৯। দ্বিতীয় ইনিংসে যদি আর ব্যাট করার সুযোগ না-ও থাকে, যদি অদৃষ্টে লেখা হয়ে গিয়ে থাকে ১৪ নভেম্বর ২০১১-র পড়ন্ত বিকেলেই ইডেনে শেষ বার ব্যাট হাতে দেখা গিয়েছিল রাহুল শরদ দ্রাবিড়কে, তা হলেও এ মাঠের সর্বকালের সফলতম ব্যাটসম্যানদের তালিকায় তিনি ঢুকে পড়েছেন।
খুব অ-দ্রাবিড় ভঙ্গিতে এ দিন সেঞ্চুরি করলেন তিনি। মার্লন স্যামুয়েলসকে ছক্কা মারলেন। বিশুকে স্কোয়ার কাটে চার মারলেন। কিন্তু তিন অঙ্কে পৌঁছে দু’হাত আকাশে তোলাটা খুব রুটিন প্রতিক্রিয়া লাগল। জীবনের রং নেই তাতে। যেটা ছিল আউট হওয়ার পর আক্ষেপ করার ভঙ্গিতে। বার বার ব্যাট মাটিতে আছড়াচ্ছিলেন। মাথা নাড়ছিলেন। মাঠ থেকে বেরনোর সময় বিজ্ঞাপন বোর্ডে ব্যাট দিয়ে আলতো আঘাত করলেন। আউট হয়ে তাঁর আক্ষেপের ছবি আগেও তো কত দেখা গিয়েছে। কিন্তু বিরক্তিতে ব্যাট দিয়ে বিজ্ঞাপন বোর্ডে আঘাত করছেন দেখা যায়নি।
যত সময় যাচ্ছে তাই মনে হচ্ছে, সন্ধ্যায় হোটেলের লবি নয়। এ দিনের সবথেকে গভীর ছবিটা ইডেনেই আঁকা হয়েছে। দু’জনের পতনের ছবি। ক্রিকেটের দুই ‘বস্’। সচিন তেন্ডুলকর এবং রাহুল দ্রাবিড়। এক জনের সেঞ্চুরির মঞ্চ ছিল। প্রার্থনার মঞ্চ। তিনি সেঞ্চুরি পাননি। অন্য জন সেই মঞ্চে এসে প্রত্যয়ের পতাকা উড়িয়ে দিয়ে গেলেন। কিন্তু কে বলবে এক জন ৩৮ করেছেন আর অন্য জনের পাশে লেখা থাকল ১১৯! আউট হওয়ার পর অভিব্যক্তিতে এক। আফসোসের অশ্রুভেজা সরণিতে কোথাও যেন দেখা হয়ে গেল দু’জনে!

ভারত
প্রথম ইনিংস

গম্ভীর ক বারাথ বো এডওয়ার্ডস ৬৫
সহবাগ ক বারাথ বো স্যামি ৩৮
দ্রাবিড় বো ব্রাথওয়েট ১১৯
সচিন ক স্যামুয়েলস বো বিশু ৩৮
লক্ষ্মণ ব্যাটিং ৭৩
ইশান্ত ক বাও বো রোচ ০
অতিরিক্ত ১৩, মোট ৩৪৬-৫।
পতন: ৬৬, ১৪৯, ২০৫, ৩৪৫, ৩৪৬।
বোলিং: এডওয়ার্ডস ১৩-০-৪৫-১, স্যামি ১৪-০-৭৮-১,
রোচ ১৫.৩-১-৫৭-১ স্যামুয়েলস ১৬-০-৬৫-০, বিশু ২৭-১-৮৭-১।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.