মাঠের জমকালো প্রতিদ্বন্দ্বী ফিডেল এডওয়ার্ডস লিফটে ওঠার আগে তাঁকে জিজ্ঞেস করে গেলেন, কত নম্বর হল? লাজুক সুরে উত্তর এল, থার্টি সিক্স। সোমবার সন্ধেবেলা হোটেলে ফিরে ফিজিওর ঘরে যাওয়ার প্রাণপণ তাড়া। এত লম্বা ইনিংসের পর প্রেস কনফারেন্স করেছেন। শরীর আর দিচ্ছে না। তাজ বেঙ্গলের লিফটের মুখে দাঁড়িয়েই তাই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিলেন রাহুল দ্রাবিড়। আশেপাশে পাঁচ-ছ’জন মুগ্ধ শ্রোতা। কড়া নিরাপত্তা বলয়ে জনতার সেখানে থাকার প্রশ্নই নেই। এঁরা কেউ এস বি-র লোক। কেউ কলকাতা পুলিশের সিনিয়র অফিসার। ইডেনের দর্শকরা দ্রাবিড়ের সেঞ্চুরি দেখেছেন। সেটা তো টিভিতেও দেখিয়েছে। কিন্তু এত লম্বা সাক্ষাৎকারে এক বারও এঁদের বাধা সৃষ্টি না করা থেকে বোঝা গেল, নিরাপত্তা কর্মীরাও মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন দ্রাবিড়ের জীবনদর্শন।
২ এপ্রিল ওয়াংখেড়ের অবিস্মরণীয় সেই রাতে যখন আতসবাজিগুলো পুড়ছিল, তখন রাহুল শরদ দ্রাবিড় নামের এক জন মানুষ ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। কেউ ভাবেওনি যে, অভাবিত ভাবে এর পর তাঁর জীবনে ক্রমাগত আতসবাজি আসবে। বাকিদের জন্য অপেক্ষা করবে অন্ধকার।
দ্রাবিড়: আমি ঠিক আলো, আতসবাজি এ ভাবে ভাবি না।
আপনি ভাবেন না। আমরা ভাবি। আজকের দিনে জানতে খুব ইচ্ছে করছে, মুম্বইয়ের আকাশ যখন আলোময় ছিল তখন আপনি কোথায় বসে অন্ধকার কাটাচ্ছিলেন?
দ্রাবিড়: আমি জয়পুরে ছিলাম। আইপিএলের প্রস্তুতি চলছিল। টিভি-তে বিশ্বকাপ ফাইনালটা দেখতে দেখতে মোটেও আমার নিজেকে অন্ধকারে মনে হয়নি। বরঞ্চ মনে হচ্ছিল, আমিও তো এই আলোর এক শরিক। এই টিম তৈরিতে তো আমারও সামান্য ভূমিকা রয়েছে। এই টিমকে যারা জেতাচ্ছে, তারা তো আমারই সতীর্থ। আমি তো তাদের জানি, চিনি। কী দারুণ গর্বের ব্যাপার যে, এরা এত ভাল খেলে দেশকে জেতাল। এদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করেছি। এক বারও মনে হয়নি আমার ভূমিকা তুচ্ছ হয়ে গেছে। আমি অন্ধকারে চলে গেছি। |
এটাও জানতে ইচ্ছে করছে, এই যে আপনার দুর্দান্ত সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে চলছে, ক্রিকেটমহলে ব্যক্তিগত বন্ধুবান্ধবদের প্রতিক্রিয়া কেমন? যেমন লারা বা পন্টিং। এঁরা কি এসএমএস-টেসএমএস করেন যে, রাহুল তুমি তো ফাটিয়ে দিচ্ছ!
দ্রাবিড়: অনেকেই টেক্সট করে। মেল করে। তবে এই আনন্দের সময় যাদের কথা প্রথম মনে পড়ছে তারা হল আমার পরিবার। সাফল্যটা কত দিন স্থায়ী হবে আমি জানি না। কিন্তু এই ‘ফেজ’-টার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি কী জানেন? আমার জীবনে যে একটা পে ব্যাক টাইম আবির্ভূত হল। ওদের কাছে ঋণ যে শোধ করতে পারছি সেটা ভেবেই দারুণ উচ্ছ্বসিত লাগছে।
কীসের ঋণ?
দ্রাবিড়: কঠিন সময় পাশে দাঁড়ানোর ঋণ। এটা মোটেই সহজ নয় যে, বাড়ির এক জন পারফর্মার যখন খেলতে পারছে না, যখন চারদিকের হতাশা তাকে গ্রাস করছে, যখন সে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে, সেই সময় পাশে দাঁড়িয়ে সাপোর্ট সিস্টেমের মতো থাকা। কী দুঃসহ হতে পারে এই সময়টা যখন এক জন স্পোর্টসম্যানকে হ্যান্ডল করা মোটেই সহজ হয় না। ওরা সেই কাজটা নীরবে করে গিয়েছে।
অনেকের মনে হচ্ছে, আপনার সাম্প্রতিক উথালপাতাল করে দেওয়া এ হেন সাফল্যের মূল ভিত্তি ফিটনেস। ইংল্যান্ডে কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি, রাহুল জীবনে এত ফিট ছিল না।
দ্রাবিড়: সত্যি কথা নয়। আমি বরাবর একই রকম ফিট ছিলাম। আর একটা কথা মনে রাখবেন। বরাবর ফিট থাকার পিছনে কিন্তু প্রচুর কাজকর্মও করতে হয়। একেবারেই ম্যাজিক নয়।
তবু ৩৯ ছুঁই ছুঁই বয়সে একটা লোক এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে পাঁচটা সেঞ্চুরি করছে এ তো রূপকথা! আর তার চেয়েও আশ্চর্যের, আজ দেখা আর একটা জিনিস।
রাহুল দ্রাবিড়কে নিয়ে কমিক স্ট্রিপ তৈরি হলেও তাতে সেঞ্চুরির আগে নায়ককে টেস্ট ছক্কা মারতে দেখাবে না।
দ্রাবিড়: (হাসি) আইপিএলের জন্য প্র্যাক্টিস করছিলাম।
এটা তো শুনলাম আপনি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন। সত্যি কারণটা কী?
দ্রাবিড়: কারণ বলটা ব্যাটে এসে গিয়েছিল। ছক্কা মারার ডেলিভারি ছিল।
১১৯ করে আউট হওয়ার পর আপনার প্রতিক্রিয়া দেখে একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে না।
দ্রাবিড়: সেটা কী?
কোনটা সত্যি? সেঞ্চুরি করতে পারা না ডাবল সেঞ্চুরি হারানো?
দ্রাবিড়: ডাবল সেঞ্চুরি হারানো নয়। অত দূর ভাবিইনি। ডাবল সেঞ্চুরি অনেক দূরঅস্ত্ ছিল। আমার শুধু খারাপ লাগছে, নতুন বলটা আমি লক্ষ্মণের সঙ্গে খেলে দিলে টিমের বাকিরা অনেক সুবিধেয় থাকত। টিমটার ভাল হত।
একটা কথা আপনাকে বলি। এই এত বলছেন তো আমার সোনার ফর্ম-টর্ম। টিম খারাপ খেললে কোনও কিছুরই কোনও মানে থাকে না। আমি অনেক বেশি খুশি হতাম ইংল্যান্ডে আমার সেঞ্চুরির পাশাপাশি সবাই যদি বড় রান করত। আমি যা করেছি সেখান থেকে রান কেটে গেলেও মন্দ ছিল না। শুধু যদি টিমটা জিতত। টিম ভাল না খেললে ব্যক্তিগত কৃতিত্ব যাই হোক না কেন, সব নিষ্ফল হয়ে যায়। কোনও আনন্দ তখন আর থাকে না।
তবু জিজ্ঞেস করছি, রাহুল দ্রাবিড়ের নবতম সাফল্যের কাহিনি কী প্রমাণ করছে? যে, কখনও হাল ছেড়ো না বন্ধু?
দ্রাবিড়: ইয়েস। নেভার লুজ হোপ।
এটা তো শুধু উঠতি ক্রিকেটার নয়, জীবনের যে কোনও পেশার মানুষের মন্ত্র হতে পারে।
দ্রাবিড়: কখনও আশা ছাড়তে নেই। আপনি ঠিক যে জিনিসে ভাল সেই জিনিসটায় আঁকড়ে পড়ে থাকতে হয়। পাশে অন্যের সাফল্য দেখে চোখ টাটাতে নেই। সে তার কাজ করছে। আপনি নিজের কাজ করুন। আপনি যেটা ভাল পারেন সেটা মনপ্রাণ দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে করুন। দেখবেন হয়তো কোথাও একটা ন্যায়বিচার অপেক্ষা করে আছে। আসবেই কোনও গ্যারান্টি নেই। কিন্তু আপনাকে পড়ে থাকতে হবে নিজের নিষ্ঠা নিয়ে।
বুঝলাম। কিন্তু এই যে আপনার অবিশ্বাস্য স্পেলটা সাবাইনা পার্ক থেকে শুরু হয়েছে, তার ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা কী?
দ্রাবিড়: প্রচুর খেটেছি কিন্তু। এটা যত সহজ মনে হচ্ছে, তত সহজে আসেনি। মন-প্রাণ দিয়ে নিজেকে নিংড়ে পরিশ্রম করতে হয়েছে।
আজ সকালে খালি ইডেন দেখে কেমন লাগছিল?
দ্রাবিড়: প্রথম দিকটা খুব আশ্চর্য লাগছিল। তার পর দেখলাম ভিড় কিছুটা বাড়ল।
আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম সচিন আউট হওয়ার পর ভিড়টা ফাঁকা হয়ে যাবে। আশ্চর্যজনক ভাবে তারা থেকে গিয়ে আপনাকে উৎসাহ দিয়ে গেল। নিজের আশ্চর্য লাগেনি আপনার?
দ্রাবিড়: বলতে পারেন কিছুটা লেগেছে। কিন্তু আমি খুব কৃতজ্ঞ ইডেনের দর্শকদের কাছে যে, ওঁরা এতক্ষণ থেকে আমাকে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। আই অ্যাম ভেরি ভেরি থ্যাঙ্কফুল।
|
একটা কথা বলুন। এই যে ম্যাচের আগের দিন পিটার রোবাক মারা গেলেন। আপনার খুব প্রিয় লেখক। ম্যাচের আগে এ রকম অপ্রত্যাশিত দুঃখজনক কিছু ঘটলে আজ এত বছর পরেও কি মানসিক প্রস্তুতিতে নড়চড় হয়?
দ্রাবিড়: আমি অস্বীকার করব না যে, রোবাকের মৃত্যুটা কাল আমায় খুব নাড়া দিয়ে গেছে। আমি রোবাককে চিরকাল মনে রাখব! মনে রাখব ওঁর অসাধারণ নিরপেক্ষতার জন্য। কখনও ওঁর লেখা পড়ে বুঝিনি লোকটা ইংরেজ, ভারতীয়, দক্ষিণ আফ্রিকান না অস্ট্রেলিয়ান। তার উপর সম্পূর্ণ ভয়ডরহীন। যা ঠিক মনে করছে তাই লিখছে। শুধু তো যা লিখছে সেটা নয়, আমার কাছে আরও আকর্ষণীয় ছিল, কী করে পারে? কী করে এমন ভাবে? হঠাৎ এমন সেনটেন্স লিখল, হঠাৎ এমন একটা শব্দ ব্যবহার করল যে, ধাম করে মাথায় একটা ঘা দিত। কী করে পারছে! বা কী লিখল দেখেছ!
চিরকাল এটাই দস্তুর ছিল যে, রাহুল দ্রাবিড় দুর্ধর্ষ খেলবেন। কিন্তু মঞ্চটা ঠিক ছিনিয়ে নিয়ে যাবে অন্য কেউ না কেউ। সে যে কেউ হতে পারে। কিন্তু তার নাম রাহুল হবে না। আজ ছবিটা পুরো বদলে গেছে। আজও যেমন অন্যের জন্য সাজানো মঞ্চ নিয়ে গেলেন আপনি। চিরদিনের এই বিচারটা গত কয়েক মাস বদলে যাওয়াটা অদ্ভুতুড়ে নয়?
দ্রাবিড়: এটা আমি কী বলব! আমি এ ভাবে দেখি না।
আপনি দেখেন না জানি। কিন্তু আমরা দেখি। আপনাকে নাগাড়ে মঞ্চের পুরোভাগে দেখাটা বেশ বিস্ময়কর।
দ্রাবিড়: আমি সবিনয়ে আবার বলছি, সেন্টারস্টেজ আমার দরকার নেই। সবার আগে মঞ্চের আলো আমার মুখে পড়ুক, এ সব আমি চাই না। আমি শুধু চাই সবাই ভাল খেলুক। আমরা জিতি।
এমন সোনার ফর্মে থেকেও গুজবটা থেকেই যাচ্ছে যে, অ্যাডিলেড ওভালেই শেষ। ক্রিকেটভক্তরা অবাক হয়ে বলছে, কীসের রিটায়ারমেন্ট? কেন রিটায়ারমেন্ট?
দ্রাবিড়: (কিছুটা বিব্রত এবং চিন্তামগ্ন) রিটায়ারমেন্ট শুধু ফর্মের ওপর নির্ভর করে না। তার সঙ্গে জড়িত থাকে আরও অনেক কিছু। দেরি আছে। দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়।
|
এ বছরে দ্রাবিড়ের সেঞ্চুরি |
রান |
বিপক্ষ |
স্থান |
১১২ |
ওয়েস্ট ইন্ডিজ |
কিংস্টন |
১০৩ |
ইংল্যান্ড |
লর্ডস |
১১৭ |
ইংল্যান্ড |
নটিংহ্যাম |
১৪৬ |
ইংল্যান্ড |
ওভাল |
১১৯ |
ওয়েস্ট ইন্ডিজ |
ইডেন |
|