রাহুল-লক্ষ্মণের ব্যাটের জাদুকরির সাক্ষী হাজার সাতেক
খাঁ খাঁ ইডেনে টেস্ট ক্রিকেটের মৃত্যুঘণ্টা
টেস্ট ক্রিকেটের মন্দার বাজার চলছে আজকাল, জানা কথা। কিন্তু তা বলে এই? ওয়ান ডে আর টি টোয়েন্টির উচ্ছ্বলতায় পাঁচ দিনের কেতাবি মেজাজ পাত্তা পাচ্ছে না, জানা কথা। কিন্তু তা বলে এই?
সাড়ে আটটা নাগাদ যখন টস করতে দুই ক্যাপ্টেন মাঠে, ইডেনে দর্শক বলতে গোনাগুনতি ৮২। হ্যাঁ, ঠিকই পড়লেন, ৮২! ক্লাব হাউসের দুটো টিয়ার মিলিয়ে জনা পনেরো। আর বাকিরা ফাঁকা পড়ে থাকা ব্লকগুলোয় এমন হাত-পা ছড়িয়ে বসে, এক-দুই-তিন-চার করে গোনা যাচ্ছে অনায়াসে। চিত্রগ্রাহকদের দেখে মনে হচ্ছে মাঠে লোক খুঁজতে ক্যামেরা নয়, বরং দূরবীন থাকলে ভাল হত। টেস্টের প্রথম বলটা যখন মাঠে পড়ল সকাল ন’টায়, তখন গ্যালারিতে বড়জোর শ’দুয়েক। ৬৭ হাজারের গ্যালারিতে যা কি না সিন্ধুতে বিন্দুও নয়। দর্শকের চেয়ে মাঠে পুলিশ বেশি, এমন খাঁ খাঁ ইডেনে টেস্ট ম্যাচ দিব্যি শুরু হয়ে গেল! স্থানীয় লিগে এরিয়ান-মোহনবাগান ম্যাচে যত ছুটকোছাটকা দর্শক হয়, তার চেয়েও কম লোককে সাক্ষী রেখে। ময়দান চত্বরে পুলিশের নির্দিষ্ট করে দেওয়া পার্কিং লটে গাড়ির সংখ্যা সারা দিনে ত্রিশও ছাড়াল না।
সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে শহর থাকল অফিসমুখী। লাঞ্চের পর ঘণ্টাখানেক লোক একটু বেড়ে বড়জোর হাজার আটেক। আর সেটাও যত ক্ষণ সচিন ক্রিজে ছিলেন, তত ক্ষণ। সম্ভাব্য শততম-র চুম্বক টানে। যা নিয়ে গত আট মাস ধরে প্রত্যাশার পারদ ক্রমশ বেড়েছে। বাকি সময় যথাপূর্বম, তথাপরম। রাহুলের দাপুটে সেঞ্চুরি বা লক্ষ্মণের ব্যাটের জাদুকরি আঁচড়, বরফ কোনও কিছুতেই গলল না। ইডেনের নব্বই শতাংশ সেই ফোকলাই থেকে গেল শেষ বিকেলেও। আর ফের উস্কে দিয়ে গেল টেস্ট ক্রিকেটের ক্রমশ অন্ধকার হতে থাকা ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনাকে। পাঁচ দিনের সনাতনী ক্রিকেট কি তা হলে শেষমেশ ‘জুরাসিক পার্ক’ হওয়ার পথে?
সচিনের শততম সেঞ্চুরির হাতছানিতেও ইডেনমুখো নয় কলকাতা। সোমবার
টেস্টের প্রথম দিনে ফাঁকা গ্যালারির ছবি তুলেছেন শঙ্কর নাগ দাস।
এমনকী সুনীল গাওস্করের মতো ব্যক্তিত্বের ধারাভাষ্যেও সারা দিনে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে হা-হুতাশ। ধৈর্য, সংযম আর মনঃসংযোগ যাঁর ব্যাটিং দর্শনের শেষ কথা, যিনি বরাবর ভরা ইডেনে টেস্টের প্রথম সকালে ওপেন করে এসেছেন, দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি আছে, সেই তাঁকে বলতে হয়েছে, “সহবাগ-গম্ভীররা সাধারণত এই রকম ফাঁকা স্টেডিয়ামে ওপেন করতে অভ্যস্ত নয়।” ভারতীয় ক্রিকেটের আর এক কিংবদন্তী কপিল দেব আঙুল তুলছেন অতিরিক্ত ক্রিকেটের দিকে। “এত বেশি ক্রিকেট হলে লোকে তো উৎসাহ হারাতে বাধ্য,” বক্তব্য তাঁর। আরও তাৎপর্যপূর্ণ টনি গ্রেগের বক্তব্য। ’৭৬-এ ইংল্যান্ড অধিনায়ক হিসেবে এ দেশে আসা গ্রেগ ইডেনে সেঞ্চুরির পর অভিভূত হয়ে দর্শকদের প্রণাম করেছিলেন। শেষ দিন ভারতের দুটো উইকেট পড়ার দরকার ছিল, তা-ও কানায় কানায় ভরা ছিল ইডেন। ইডেনের হতশ্রী দশা সোমবার গ্রেগকে দিয়ে টুইটারে লিখিয়েছে, “ইডেনকে দেখে মর্গ মনে হচ্ছে।”
তা হলে কি শেষের শুরু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল সোমবারের ইডেন?
ময়নাতদন্তে উঠে আসছে একাধিক কারণ। যার মধ্যে শীর্ষ বাছাই সপ্তাহের প্রথম পাঁচটা দিনে টেস্টের আয়োজন। সোম থেকে শুক্রে ভরপুর ব্যস্ততায় কার সময় আছে অফিস-ব্যবসা-কাজকম্মো ফেলে সাত সাতটা ঘণ্টা মাঠে বসে থাকার? “দিন রাতের ওয়ান ডে হলে তবু কথা ছিল। হাফ ডে সিএল নিয়ে নিত অনেক। আর টি টোয়েন্টি হলে হাজার ত্রিশ অন্তত আসত। কাজের দিন হলেও আসত,” বলছিলেন সিএবি-র এক কর্তা। সে না হয় হল। কিন্তু টেস্ট ম্যাচেও তো বড়জোর দুটো ছুটির দিন গুঁজে দেওয়া যায়, যদি শনিবারটাও ছুটি বলে ধরি। সে ক্ষেত্রেও তো বাকি তিন দিন এ দিনের মতোই হাল হত গ্যালারির। কাজের দিনে টেস্ট তো এই প্রথম হচ্ছে না, আগেও বহু বহু বার হয়েছে এবং টইটম্বুর গ্যালারির সামনেই হয়েছে। এ হেন হতশ্রী দশা তো আগে চোখে পড়েনি কখনও। তা হলে?
আর এই ‘তা হলে’-র উত্তর খুঁজতে গিয়েই উঠে আসছে কারণ নম্বর দুই। যাতে শুধু কাজকর্মের চাপ আর সময়াভাবের অজুহাত সে ভাবে ধোপে টিকছে না। বরং প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে পাঁচ দিনের ফর্ম্যাটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই। “আসলে যুগটাই তো পাল্টে গেছে। মনের মতো বিনোদন পেলে লোকে ঠিকই মাঠে আসবে। এটা হাতে নাতে ফল পাওয়ার যুগ,” বলছিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার দিব্যেন্দু বড়ুয়া। আবার প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার দীপ দাশগুপ্তের ব্যাখ্যা, “টেস্ট ক্রিকেটের একটা স্থিতিশীল ব্যাপার আছে। এই প্রজন্ম হয়তো সেটা নিতে আগ্রহী নয়।” হয়তো তাই। টেস্ট ম্যাচে সময়ের সঙ্গে ধৈর্যও বিনিয়োগ করতে হয় সমপরিমাণে। আই প্যাড, গুগল প্লাস, ব্ল্যাকবেরি মেসেঞ্জারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়া রোজকার রুটিনে টেস্ট ক্রিকেটের স্থিতিশীল কাঠামোর ক্রমশ ব্রাত্য হয়ে পড়ারই কথা। না হলে আইপিএলে কোনও অখ্যাত অনামীর কুড়ি বলে ধুমধাড়াক্কা ৪২ দেখতে যে ইডেন প্রায় ভরে যায়, সেখানে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানকারী রাহুল দ্রাবিড়ের খানদানি টেস্ট সেঞ্চুরির সাক্ষী মাত্র হাজার সাতেক!

গ্যালারি-কথা
শুধু কলকাতা নয়, গোটা
বিশ্বেরই এক হাল। লোককে
মাঠে আনাই সমস্যা।
রাহুল দ্রাবিড়
এত ঘন ঘন খেলা হলে লোকে উৎসাহই হারিয়ে ফেলে। সেটা বোর্ডের বোঝা উচিত।
কপিল দেব

ইডেনে অন্তত এত ফাঁকা গ্যালারি দেখাটা খুব দুঃখের। আমরা খেলতাম ঠাসা গ্যালারির সামনে।
সুনীল গাওস্কর
ইডেনকে আজ মনে
হচ্ছিল একটা মর্গ।
টনি গ্রেগ


মোদ্দা কথা কি তা হলে এই দাঁড়াচ্ছে, চটজলদি ফল পাওয়ার উপযুক্ত মোড়কে বিনোদন দিতে পারলে দাও, ধমনীতে গতি আনতে পারে এমন উত্তেজক ক্রীড়ামঞ্চ দাও, না হলে টেস্ট ক্রিকেটের কৌলীন্য রক্ষার দায়িত্ব আমজনতা কেন নেবে? সচিন কত করল, কী ভাবে করল, সেঞ্চুরিটা হল কি হল না, এ সব টিভি-মোবাইল-ইন্টারনেটের কল্যাণে এক সেকেন্ডে জেনে যাওয়া যাচ্ছে। জীবনের রোজকার টানাপোড়েনে হাঁসফাঁস মানুষের কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই, যে সব ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকবে কখন একটা উচ্চাঙ্গের কভার ড্রাইভ ঘাস কেটে ছুটবে বাউন্ডারির দিকে? কিংবা কখন একটা দেরিতে ভাঙা আউটসুইং ব্যাটের কানা ছুঁয়ে আলগোছে জমা পড়বে কিপারের হাতে?
আগ্রহের অপমৃত্যুর তিন নম্বর কারণ লাগাতার ক্রিকেট। যেন ‘টোয়েন্টি ফোর x সেভেন’, চলছে তো চলছেই। স্রেফ হিসেব বলছে গত কুড়ি দিনে তিন বার আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখেছে ইডেন। ২৫ অক্টোবর ওয়ান ডে তে লোক হয়েছিল ২৭ হাজারের মতো আর ২৯ অক্টোবরের টি-টোয়েন্টিতে ৩৫ হাজার। আর টেস্টের প্রথম দিন সেটা কমে মাত্র সাত হাজার! অথচ কলকাতার মৃতপ্রায় স্থানীয় ফুটবল লিগেও গত রবিবার মোহনবাগান-টালিগঞ্জ ম্যাচেও ছিলেন দশ হাজারের বেশি লোক। রুপোলি পর্দার নায়ক দেবেরও ইডেন না যাওয়ার ব্যাখ্যা অতিরিক্ত ক্রিকেট। “ক্রিকেটের জন্য এককালে পাগল ছিলাম। এখন ব্যস্ততা না থাকলেও ক্রিকেট মাঠে যাই না। কারণ অতিরিক্ত ক্রিকেট।”
“বেশি ক্রিকেট তো একটা বড় সমস্যা বটেই,” একমত শহরের নামী কলেজের গণিতের এক অধ্যাপক। “শীতকাল হলেই শুধু ব্যাট বলের আওয়াজ শোনা যাবে, সে দিন তো আর নেই। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ওয়ান ডে সিরিজেও দেখলেন না, মাঠে লোকই হচ্ছে না? তুলনায় টি টোয়েন্টি অনেক বেশি লোক আনছে। সেখানে পাঁচ দিনের ম্যাচে গ্যালারি মাছি তাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক।” কিন্তু তা বলে সচিনের একশো একশোর মতো সন্ধিক্ষণও লোক টানতে পারবে না? তা সে হলই বা টেস্ট ম্যাচ? চাঁছাছোলা বিশ্লেষণ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের, “পারবে না। লোকে সারা বছর টিভিতে এত সচিন দেখছে, টিভিতে, ইন্টারনেটে জেনে যাচ্ছে তার সব কিছু। মাঠে এসে আর নতুন করে কিছু দেখার বা জানার নেই। তারকাকে ঘিরে একটা রহস্য বা চমক থাকলে তবেই তো তাকে রক্তমাংসে চাক্ষুস করার উৎসাহ আসবে। সেই উৎসাহটাই তো মরে গিয়েছে।”
উৎসাহের মৃত্যুর আরও একটা উপাদান দেশজ ক্রীড়া মানচিত্রে নতুন নতুন হাই প্রোফাইল খেলার বিনোদনী অনুপ্রবেশ। এই তো গত মাসে ভারতে পা রেখেছে ফর্মুলা ওয়ান, যেখানে গতির দুনিয়ায় পা রেখেছে দেশ। ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছে ইন্ডিয়ান রেসিং লিগের। যেখানে আইপিএলের ধাঁচে বিক্রি করা হবে রেসিংকে। আর যত দিন যাচ্ছে, তত জনপ্রিয় হচ্ছে গল্ফ। সোমবারই শহরে টলি ক্লাবে গল্ফ ক্লিনিকে ছিল একশো জন তরুণ শিক্ষার্থী। যাদের এক বারও মনে হয়নি সচিনের একশোতম দেখতে ইডেনে ছোটার দরকার আছে।
আসলে নির্যাসটা খুব পরিষ্কার। ভয়ঙ্কর হলেও সত্যি, নতুন প্রজন্ম মেসি-ম্যানিয়া দেখতে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করতে আগ্রহী, কিন্তু বহুচর্চিত সচিন তেন্ডুলকরকে দেখতে শ’খানেক পকেট থেকে বের করতে অনীহা। সাত ঘণ্টা মাঠে বসে থাকার বদলে মাল্টিপ্লেক্সের হলে বান্ধবীর সঙ্গে তিনটে ঘণ্টা তার জীবনে অনেক বেশি জরুরি।
ইডেন টেস্টে কে জিতবে, কে হারবে সেটা শুধু রেকর্ড বইয়ের জন্যই প্রাসঙ্গিক। এই ম্যাচ বরং দিকচিহ্ন হয়ে থাকতে চলছে জেতা-হারার শুকনো হিসেবের বাইরে গভীরতর ক্রিকেটীয় তাৎপর্য নিয়ে। যা প্রশ্ন তুলছে টেস্টের কাল-পরশু-তরশু নিয়ে। বেআব্রু করে দিচ্ছে পাঁচ দিনের ক্রিকেটের চেহারাটা। রোগী আইসিসিইউতে গভীর সঙ্কটে, জীবনদায়ী ওষুধ দ্রুত আবিষ্কার না হলে ক্রমশ অবধারিত ঢলে পড়বে কোমায়। আর তার পর? শেষের সে দিন আগত ওই? সময় আসছে টেস্ট ক্রিকেটের ‘অবিচুয়ারি’ লেখার?




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.