প্রয়োজন সুসংহত পরিকল্পনা, আর দুর্নীতি দূর করা। প্রকৃতির দান আর
সরকারি অর্থ সদ্ব্যবহারের শর্ত পূরণ করা যাবে কি? প্রশ্ন তুলেছেন
তুষার কাঞ্জিলাল
|
পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের দু’টি ভাগ: জনবসতিহীন ৪৮টি দ্বীপ নিয়ে বনবিভাগ, এবং ৫৪টি দ্বীপে প্রায় ৪০ লক্ষ লোকের বাসভূমি মনুষ্যবিভাগ, যেখানে বন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এই লেখায় প্রধানত দ্বিতীয় বিভাগটি নিয়ে আলোচনা করছি। জনবসতির মধ্যেও দুটো ভাগ লক্ষ করা যায়। প্রথমটি হল এমন দ্বীপ যেখানে অনুন্নয়নের চেহারায় স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। যেমন সাগর, পাথরপ্রতিমা, কুলতলি, বাসন্তী, গোসাবা, সন্দেশখালির কিছু অংশ, হিঙ্গলগঞ্জ, যোগেশগঞ্জ, রূপমারী, দুলদুলি, যার জনসংখ্যা ২০-২২ লক্ষের মতো। দ্বিতীয় হল এমন কিছু দ্বীপ, যা পুরোপুরি বা অংশত মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। এ সব অঞ্চলের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, উৎপাদনী উদ্যোগ অনেকটাই শহুরে হয়ে গিয়েছে। মূল সুন্দরবনের অনেক মানুষ এখন এই সব জায়গায় এসে বসত গড়ে তুলছেন।
জনবসতির দ্বীপগুলির সমস্যা এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে, যে সুদূর ভবিষ্যতে গোটা সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। এই ধরনের প্রত্যেকটি দ্বীপ চারদিকে নোনা নদী দিয়ে বেষ্টিত। জীবনধারণ দুঃসাধ্য। তার উপর ঘূর্ণিঝড় উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিকে প্রায়ই প্রচণ্ড আঘাত করে এবং দু’-এক ঘণ্টার মধ্যে মানুষের ২০-২৫ বছরের অর্জিত সম্পদকে ধ্বংস করে দেয়। এই ঝড় বন্ধ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষ ঝড়ের ধ্বংসের পরিমাণটা কমাতে পারে। তার প্রধান পথ এখন যতটা বাদাবন আছে, তাকে সুরক্ষিত রাখা এবং নদীর চরে যেখানে সম্ভব সেখানেই নতুন বাদাবন সৃষ্টি করা। নদীবাঁধের পাশে সারি দিয়ে নারকেল, খেজুর গাছ লাগিয়ে রক্ষা করার কথাও ভাবা যায়।
নদীবাঁধকে আরও উন্নতমানের করে গড়ে তোলা দরকার। যে দ্বীপগুলিতে মনুষ্যবসতি গড়ে তোলা হয়েছে, সেগুলি পলি জমে জমে যতটা উঁচু হলে বসতি গড়া উচিত ছিল, তাতে অনেক আগেই সেখানে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। সুন্দরবনে সব ক’টি বড় শাখানদী জলের জোয়ার-ভাটায় প্রভাবিত। জোয়ারে জলের উচ্চতা ২০ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যায় এবং ভরনার সময় জলের উচ্চতা দ্বীপের উচ্চতা থেকে ২-৩ ফুট উপরে থাকে। বলা যায়, সুন্দরবনের মানুষ দিন রাতের বেশ কিছুটা সময় জলের নীচে বাস করে। দেড় শতাব্দী আগে থেকে অনাবাসী জমিদাররা, যাঁরা দ্বীপগুলিকে ইজারা নিয়েছিলেন, তাঁরা মাটির বাঁধ দিয়ে দ্বীপগুলিকে ঘিরে ফেলেছিলেন। মুশকিল হচ্ছে, নদীবাঁধ তৈরির সময় কোনও বিজ্ঞান বা প্রকৌশলের সাহায্য নেওয়া হয়নি এবং প্রায় দীর্ঘ দেড় শতাব্দী কাল এই বাঁধগুলির রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কার, কোনওটাই করা হয়নি। প্রায় ৩৫০০ কিলোমিটার বাঁধের অধিকাংশ জায়গা ঝুঁকিপ্রবণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন বছর আগে আয়লার ঝড়ে সরকারি হিসাবে ৮৩৪ কিলোমিটার নদীবাঁধ পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। |
আজও। খরা থেকে বাঁচতে ইন্দ্রপূজার প্রস্তুতি। ২০১০। ছবি: বিশ্বরূপ দত্ত |
দেখা যায়, সুন্দরবনে বড় ঝড় হলে সাময়িক ভাবে কিছু ত্রাণ বিলির ব্যবস্থা এবং পরে পুনর্বাসনের জন্য সামান্য কিছু অর্থসাহায্য করা হয়। সেচ বিভাগ ভেঙে-যাওয়া বাঁধকে কিছুটা তাপ্পি দিয়ে সাময়িক ভাবে জল আটকাবার ব্যবস্থাই শুধু করতেন। আয়লার ঝড়ের পর রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কিছুটা টনক নড়েছে। তাঁরা সুন্দরবনের বাঁধের সমস্যাকে নানা প্রকৌশলের সাহায্য নিয়ে জানার কথা বলেছেন এবং এই নদীবাঁধ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করে একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। এই কাজটা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ঝড়ের অব্যবহিত পরেই একটা টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিল। সেই টাস্ক ফোর্সের এক জন সদস্য হিসেবে জানি, এই টাস্ক ফোর্স বিশদ আলাপ-আলোচনার পর তিনটি স্তরে নদীবাঁধের উন্নয়নের কাজকে তিনটি ভাগে ভাগ করে নিতে বলেছিল। প্রথম ধাপে যে ৮৭৪ কিলোমিটার নদীবাঁধ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, তার সম্পূর্ণ ভাবে নতুন প্রকৌশল নির্ভর করে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। কংক্রিটের বাঁধ তৈরি করার বিরুদ্ধে তারা মত দিয়েছিল। কংক্রিটের বাঁধ তৈরির ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে যে, প্রচণ্ড বেশি প্রাথমিক ব্যয় এবং তার পর অতিনিয়মিত তা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা। টাস্ক ফোর্স কতকগুলি নির্দিষ্ট উপাদান এবং কারিগরি ব্যবস্থা গড়ে তুলে নতুন ভাবে নির্মাণের জন্য বলেছিলেন।
বাকি নদীবাঁধের সমস্যা সমীক্ষা করে এবং জলে ও ডাঙায় নানা পদ্ধতিতে বহু ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে গোটা সুন্দরবনের বাঁধ পুরোপুরি সংস্কার করার পক্ষে তারা মত দিয়েছিল। এর জন্য প্রথম ধাপে ব্যয় নির্ধারিত হয়েছিল ৬০৩০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার বাঁধের জন্য ৫০৩০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে আরও কিছু টাকা মঞ্জুর করে। পরবর্তী ধাপে কাজটা করতে হলে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪,০০০ কোটি টাকা। সেই টাকার সংস্থান কোথা থেকে হবে তা ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে ঠিক করতে হবে।
প্রথম ধাপের ৫০৩০ কোটি টাকার ৭৫ শতাংশ টাকা রাজ্য সরকার কেন্দ্র থেকে পাচ্ছে। বাঁধ তৈরির কাজে দু’টি প্রশ্ন বড় আকারে দেখা দেবে। প্রথমটি জমি অধিগ্রহণ এবং দ্বিতীয়টি, যে কোনও ভাবে হোক সকল স্তরের দুর্নীতিকে বন্ধ করে নির্ধারিত কাজগুলি নিখুঁত ভাবে করা। জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সরকার কতকগুলি ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু আমার সুন্দরবন বাসের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কাজটা খুব সহজে হবার কথা নয়। প্রশাসন, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দলগুলি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলিকে জোট বেঁধে মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে এবং তাদের জমি অধিগ্রহণ কেন অবশ্যম্ভাবী, তা বোঝাতে হবে। এ ছাড়াও নানা ধরনের ব্যক্তিগত স্বার্থ মাথা চাড়া দেবার চেষ্টা করবে। সেখানে তৃণমূল স্তরে ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা অনেক বেশি প্রয়োজন হবে।
বসতি অঞ্চলের আর একটি প্রধান সমস্যা হল, উৎপাদন বাড়িয়ে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করা। কৃষি এ সব অঞ্চলে বলা যায় একমাত্র উৎপাদন সৃষ্টিকারী সম্পদ। কিন্তু চাষযোগ্য জমির ৮০-৮৫ ভাগই এক ফসলি। সেচের জন্য মিষ্টি জলের জোগান অতি সীমিত, যদিও গড়ে এ সব অঞ্চলে ১৭০০-১৯০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টির জলের প্রায় ৮০ ভাগই নদীতে ফিরে যায়।
এই বৃষ্টির জলকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করে দ্বিতীয় ফসল উৎপাদনের কাজে লাগালে উৎপাদন এবং আয়বৃদ্ধি বেশ কিছুটা হতে পারে। কিন্তু পরিকল্পিত ভাবে এ বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করা যায়নি। বেশ কিছু পুকুর এর মধ্যে কাটানো হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, সেই জলটাও দ্বিতীয় ফসল চাষে পুরো ব্যবহার হয় না। সুন্দরবনে প্রচুর সরকারি খাল-বিল-নালা সংস্কারের অভাবে জলধারণের ক্ষমতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। এগুলি সংস্কারের কাজটা বিশেষ জরুরি। আজকাল অনেক ধরনের ফসলের বীজ তৈরি করা গিয়েছে, যেগুলি চাষ করলে সেচের জল কম লাগে এবং তুলনামূলক ভাবে এরা বেশি পরিমাণ লোনা সহ্য করতে পারে।
সুন্দরবনের জমিগুলির মাটি পরীক্ষা করে শস্য পর্যায়ে ঠিক করে কৃষকদের যদি চাষ করানো যায়, তা হলে উৎপাদন ও আয়ের বৃদ্ধি বেশ কিছুটা করা যেতে পারে। আজকের সুন্দরবনের বাজার-ঘাটে ঘুরুন, দেখবেন, মূল ভূখণ্ডের তরিতরকারি ও মাছ মানুষকে অনেক বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে। সে কারণে কৃষির ক্ষেত্রেও বোধহয় তথ্যভিত্তিক একটা কৃষি পরিকল্পনা করা অত্যন্ত জরুরি।
সুন্দরবনের সম্পদ বলতে গেলে মাটি-জল-জঙ্গল। এই তিনটি ক্ষেত্রেই উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ প্রচুর আছে। এত দিনের সুন্দরবনে বাস এবং উন্নয়নের কাজে প্রতিনিয়ত যুক্ত থাকার সুবাদে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে বলতে পারি, সুন্দরবনের সমস্যা কোনও বিচ্ছিন্ন সমাধান চিন্তা করলে হবে না। সম্ভাবনার দিকগুলিও পরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা না করতে হবে। না হলে সুন্দরবনের মৌলিক সমস্যাগুলি মেটার নয়। |