প্রবন্ধ ১...
আজি হতে শতবর্ষ পূর্বে: বিস্মৃতির আগে
‘শিবে ঠেলে দে’, দাদার সোচ্চার অনুজ্ঞা, লক্ষ্মণভ্রাতা শিবদাস বলটা ফরওয়ার্ড পাস করলেন, বিজয় ভাদুড়ি ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে গিয়ে দুই পোস্টের মধ্যিখানে সেঁধিয়ে দিলেন। মোহনবাগানের শিল্ড বিজয়ের এই কিংবদন্তি উপাখ্যান দশকের পর দশক ধরে উত্তর কলকাতার রকে রকে মুখরিত হত। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকের প্রারম্ভবর্ষে বাঙালির কাছে সম্ভবত সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ ছিল গোরা পল্টনের দলকে পরাস্ত করে বঙ্গসন্তানদের এই গর্বকেতন ওড়ানো। পরাধীন দেশ, গ্লানিমায় ছাওয়া, প্রতি পদে পরদেশি প্রভুদের কাছ থেকে অবমাননা ও লাঞ্ছনার আশঙ্কা তথা অভিজ্ঞতা। অহঙ্কার করার মতো কিছু নেই, কিছু ঘটে না। এরই মধ্যে এই পরমাশ্চর্য ঘটনা। বাঙালি আনন্দে শ্লাঘাবোধে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য।
তবে আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে, সেই উনিশশো এগারো সালে, অন্য একটি সংঘটন সমান অবিস্মরণীয় বলে একটি বাপক অংশের বাঙালিদের মনে হয়ে এসেছে। নতুন সম্রাট সিংহাসনে অভিষিক্ত, দিল্লিতে সুসমারোহ বাহারি দরবার, ছ’বছর পূর্বে শুরু করা স্বদেশী আন্দোলন তা হলে সফল হল। ওই লক্ষ্মীছাড়া বড়লাট কার্জন সাহেব বাংলাকে দু’টুকরো করে দিয়েছিলেন, তার প্রতিবাদে বাঙালির সত্তা, অন্তত চেতনা-সম্পৃক্ত বাঙালি হিন্দুসমাজ-সত্তা, প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিল। এক দিকে পূর্ববঙ্গে অসমে তাঁদের জমিজমা বিষয়-সম্পত্তির কী হাল হবে তা নিয়ে জমিদারকুলের এবং তাঁদের প্রসাদে লালিত আইনজীবীদের দুশ্চিন্তাপ্রসূত চোখা-চোখা অভিমানভরা বক্তৃতার বন্যা, অন্য দিকে কিছু-কিছু নব্যযুবকের কালীমূর্তির পদস্পর্শ করে বোমা বানাবার, বোমা ছুড়বার, কলাবাগান-আমবাগানে গিয়ে চোলাই পিস্তল অভ্যাস করার হিড়িক, আর সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জনে-জনে আবেগমথিত রাখি পরানো, সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রার্থনা: ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ ইত্যাদি। এত উদ্যোগ তো ব্যর্থ হতে পারে না। পাষাণেরও তো মন গলে তেমন তেমন আকুল নিবেদনে, ব্রিটিশ মহাপ্রভু অবশেষে সদয় হয়েছেন, নতুন সম্রাট বঙ্গভঙ্গ খারিজ করে দিয়েছেন, আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে, অন্তত লেখাপড়া-জানা হিন্দুসমাজের বাতাবরণে।
আবেগ, আবেগ... ১৯১১ শিল্ড বিজয়ী দলের আলোকচিত্র।
পুরো একশো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর অন্তত কারও-কারও কাছে ব্যাপারটি একটু অন্য রকম মনে হতে পারে। সত্যিই কি বাঙালিরা সেই উনিশশো এগারো সালে তাঁদের দ্বিখণ্ডিত মাতৃভূমিকে ফের অখণ্ড রূপে পেয়ে ভাগ্যবান হয়েছিলেন? ওই অখণ্ডতা তো সাড়ে তিন দশকের বেশি ধোপে টিকল না। বাংলা তো সেই দু’ভাগ হলই, গোটা দেশটাই দু’টুকরো হয়ে গেল। সবচেয়ে বিষণ্ণ কৌতুকের তথ্য, এই যে দ্বিতীয় বার এবং পাকাপাকি ভাবে বাংলা ভাগ হল, তার প্রধান উদ্যোক্তা কিন্তু বাঙালি হিন্দু সমাজেরই মস্ত বড় একটি অংশ। লক্ষ-লক্ষ ছিন্নমূল শরণার্থী গত ষাট বছরের অধিক সময় জুড়ে যে ভয়ঙ্কর সর্বনাশের অভিজ্ঞতা পেরিয়ে এসেছেন তার সূচনা কি উনিশশো এগারো সালেই ঘটেনি? বঙ্গভঙ্গ সে-বছর রদ হল, কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে মনের আড়াআড়ি বেড়েই চলল। যেন কোনও নিয়তির নিদান মেনে দুই সম্প্রদায়ের জননেতারা পরস্পরের থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথের গানের কলি যা-ই দাবি করুক, যা হারিয়ে গেল তা আর ফিরে এল না॥
আরও একটি সুন্দর সম্ভাবনার কথাও বলছি, যা হতে পারত, কিন্তু হতে দেওয়া হয়নি। বড়লাট কার্জনের দর্পচূর্ণ করে বঙ্গভঙ্গ তো খারিজ হল, কিন্তু সম্পন্ন বাঙালি হিন্দুদের ওপর প্রভুরা প্রতিশোধ নিলেন কলকাতা থেকে ভারত সরকারের প্রশাসন কেন্দ্র দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফরমান জারি করে। তাঁরা কী হারালেন, বাঙালিরা জানলেন না, তাঁরা বঙ্গভঙ্গ রদ ও শিল্ড জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা। তখন রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরের জন্য যে ওজর দেখানো হয়েছিল কলকাতা দেশের বড়ই এক-প্রান্তে, এখান থেকে পঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ কিংবা সুদূর দক্ষিণাঞ্চলের ওপর নজরদারির চরম অসুবিধে তা কিন্তু খুব একটা মজবুত ছিল না। লন্ডনও ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ-পূর্ব প্রত্যন্ত ঘেঁষে, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন থেকে আলাস্কা, একটু বাড়িয়ে বলা চলে, ধরাধাম থেকে মঙ্গলগ্রহের দূরত্বে। কুচুটে বাঙালি হিন্দুদের ওপর গায়ের ঝাল মেটানোর জন্যই কলকাতা বরবাদ হয়ে গেল, দিল্লির শিকে ছিঁড়ল। এক বার ভেবে দেখুন, ১৯৪৭ সালে দেশ যখন স্বাধীন ঘোষণা করা হল, তখন যদি রাজধানী কলকাতাতেই থাকত, কী মস্ত সুবিধে হত বাঙালির! কলকাতা তা হলে সত্যিই দু’দশ বছরের মধ্যে লন্ডন বা নিউ ইয়র্ক হয়ে যেত। রাজধানীর লাগোয়া হওয়ার জন্য পঞ্জাব-হরিয়ানা-রাজস্থান পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মানুষজন কৃষি ও শিল্পবিস্তারের প্রয়োজনে এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক সুবিধাদি পেয়েছেন, সে সমস্তই বাঙালিদের জন্য বরাদ্দ হতে পারত।
তাই বলি, আজি হতে শতবর্ষ পূর্বে যা ঘটেছিল তাতে বাঙালি আবেগের বিজয় বিঘোষণা আছে, কিন্তু তা হয়তো বাঙালি বিবেচনাহীনতারও সমান স্মারক। সঙ্গে সঙ্গে এটাও মানছি, এ ধরনের আত্মবিলাপ এখন সময় ও বুদ্ধিবৃত্তির অপচয় মাত্র। রোমান্টিক উপন্যাসে ইতিহাসকে নতুন করে লেখা যায়, বাস্তবে যায় না। বরঞ্চ অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে এই মন্তব্যববিহারের উপান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করা যাক। উনিশশো এগারো সাল বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রথম বছর। মুশকিল হল, আমাদের মান্যবর গবেষকমণ্ডলী উনিশ শতকীয় বাঙালি উজ্জীবন নিয়ে বিভোর বিহ্বল, সেই উজ্জ্বল অধ্যায়ের চর্চায় সামান্য যতি দিয়ে বিশ শতকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপের জন্য তাঁদের প্রলুব্ধ করা সহজ নয়। রামমোহন বিদ্যাসাগর মাইকেল বঙ্কিমচন্দ্র অক্ষয়কুমার দত্ত রাজনারায়ণ বসু দীনবন্ধু মিত্র গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং অবশ্যই ডিরোজিয়ো প্রভুদের ভাষায় শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের বাঙালি সমাজের একটি বিশেষ স্তরে এই মহাপুরুষরাই আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছেন, তাঁরা কী ভাবতেন-করতেন-নাচতেন-কুঁদতেন সে সব নিয়ে এখনও অনলস গবেষণা চলছে তো চলছেই।
ঊনবিংশ শতকের বাঙালি উজ্জীবনকে অশ্রদ্ধা করার প্রশ্ন নেই। যাঁরা সে যুগের প্রাতঃস্মরণীয় তাঁদের অবশ্যই স্মরণ করব। কিন্তু ইতিহাস তো দাঁড়িয়ে থাকে না। বাংলা ইতিহাস তো রবীন্দ্রনাথের সেতু অবলম্বন করে একদা বিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেছিল। এই নতুন শতাব্দীর মধ্য দশকগুলিতে প্রধানত বামপন্থী আদর্শে অনুপ্রাণিত (অবশ্য অন্য প্রেরণারও অভাব ছিল না) যে সার্বিক উজ্জীবন ঘটেছিল রাজনীতিতে সমাজজীবনে সাহিত্যে নাট্যচর্চায় বিভিন্ন শিল্পকলায়, তার দিকে মনোনিবেশ করার সময় কি আসেনি?
আমার কাছে ১৯১১ সালটির অন্য একটি সংজ্ঞা, এ বছর বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরু, দ্বিতীয় বাঙালি উজ্জীবনের যাঁরা হোতা তাঁদের মধ্যে অনেকেরই জন্ম এই দশকটিতে। সর্বজনপ্রিয় গণনেতা বিনয় চৌধুরী ১৯১১ সালেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যেমন করেছিলেন বিশ শতকের মধ্যলগ্নে বাংলার সাংস্কৃতিক আকাশ রাঙিয়ে দেওয়া পাবনা জেলার শীতলাই অঞ্চলের ভূস্বামী-সন্তান, শ্রীরামপুরের পরম অভিজাত পরম শৌখিন দুর্ধর্ষ ব্যারিস্টার তুলসীচন্দ্র গোস্বামীর সাক্ষাৎ ভাগিনেয়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র; কিশোরগঞ্জের রাজভক্ত ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান, সম্রাটের অভিষেকের বছরে জন্ম বলে যাঁর আদরের ডাকনাম জর্জ, সেই দেবব্রত বিশ্বাস; থিয়েটারওলা মনমোহন পান্ডের সম্পর্কে দৌহিত্র সুধী প্রধান; আর হবিগঞ্জের মাঝারি জমিদারের দুলাল হেমাঙ্গ বিশ্বাস। পিছন পানে ফিরে তাকাননি অতীত যে কথাই বলুক, বাংলার ইতিহাস এখন থেকে লিখবে সাধারণ মানুষ, নিঃস্ব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ: এই প্রত্যয়ে অবগাহন করে মাঠে-ময়দানে জনতার মুখরিত ঐক্যে নিজেদের মিলিয়ে দিলেন এই চতুষ্টয় তবে শুধু তাঁদের কথাই উল্লেখ করি কেন? তাঁদের জন্মের গা ঘেঁষেই, কিংবা অতটা সান্নিধ্যে না হলেও, বিশ শতকের সেই দ্বিতীয় দশকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন সমর সেন, বিনয় ঘোষ, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়রা। যা যোগ না করা অন্যায় হবে, স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতিতে যাঁদের মুখ্য নিয়ামকের ভূমিকা থেকে গিয়েছিল যাঁদের মধ্যে আছেন প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু, ভূপেশ গুপ্ত, স্নেহাংশু আচার্য, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সবাইই তাঁরাও কিন্তু গত শতকের সেই দ্বিতীয় দশকে পৃথিবীর প্রথম আলো দেখেছিলেন।
ইতিহাসবিদ বন্ধুদের তাই ফের বলি, অনেক তো উনিশের জাবর কাটা হল, এ বার একটু না-হয় বিশে ফিরুন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.