পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যচিত্রটি কেমন, রাজধানী কলিকাতার যে কোনও সরকারি হাসপাতাল সফর করিলেই তাহা বুঝা যায়। রোগীর তুলনায় শয্যার অপ্রতুলতা, চিকিৎসকদের অভাব ইত্যাদি সমস্যা তো আছেই। সমস্যা আছে হাসপাতাল প্রশাসনের সহিত চিকিৎসক, রোগী ও রোগীর আত্মীয়দের সমন্বয়ের, যাহা মাঝেমধ্যেই স্বাস্থ্য পরিষেবায় শৃঙ্খলাহীনতা সৃষ্টি করে। কিন্তু এই সব সমস্যাকে বোধহয় ছাপাইয়া যায় হাসপাতালগুলিতে ন্যূনতম পরিকাঠামোর অনুপস্থিতি। এক্স-রে, ইসিজি, ইইজি, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি রোগনির্ণয়ের জরুরি যন্ত্রপাতি অধিকাংশ হাসপাতালেই অকেজো পড়িয়া থাকে, যাহার ফলে রোগীদের বাহির হইতে এই সব পরীক্ষা করাইয়া আনিতে হয়। কিন্তু সিরিঞ্জ, সুচ, স্পিরিট বা গজ-তুলার মতো সামান্য উপকরণগুলিও প্রায়শ সরকারি হাসপাতালে মজুত থাকে না। অথচ সিরিঞ্জ ছাড়া ইঞ্জেকশন দেওয়া যায় না, সূচ না থাকিলে স্যালাইন, স্পিরিট না থাকিলে ক্ষতস্থান জীবাণুমুক্ত করা যায় না এবং গজ-তুলা না থাকিলে ব্যান্ডেজ বাঁধা যায় না।
বিবরণটি কলিকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের, যেখানে সদ্য উপর্যুপরি দুই-দুই বার মৃত রোগীর আত্মীয়দের হাতে চিকিৎসকরা নিগৃহীত হইয়া প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করিয়াছেন। আত্মীয়দের মারমুখী হওয়ার কারণ, তাঁহারা চিকিৎসকদের ভরসায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়াছিলেন। কিন্তু চিকিৎসকরা কী দিয়া চিকিৎসা করিবেন, যদি তাঁহাদের কাছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-সামগ্রী মজুত না থাকে? এই চরম অব্যবস্থা, এই নৈরাজ্য (যাহাকে নেই-রাজ্যও বলা যায়) যেমন একা ন্যাশনাল মেডিক্যালের নয়, রাজ্যের সব সরকারি হাসপাতালের, তেমনই ইহা কেবল বর্তমান সরকারের আমলের ছবি নয়, ইহাই রাজ্যের বরাবরের স্বাস্থ্যচিত্র। ইহা যদি রাজধানী শহরের সরকারি হাসপাতালগুলির অবস্থা হয়, তবে জেলা, মহকুমা বা ব্লক স্তরের হাসপাতাল এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির অবস্থা কী রূপ, কল্পনা করিলেও শিহরিত হইতে হয়। গণমাধ্যমে প্রায়শ ওই সব মফস্সল শহর ও গ্রামীণ হাসপাতালগুলির অব্যবস্থার রোমহর্ষক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরিত্যক্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্র আগাছায় গ্রাস করার ছবি কত যে দেখা যায়। কুকুর-বিড়ালের সহিত একই মেঝেতে শয্যা ভাগাভাগি করিয়া লওয়ার ছবিও কম দেখা যায় না। তা ছাড়া, মাসের পর মাস ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসকের অনুপস্থিতি, তাঁহার পরিবর্ত হিসাবে কম্পাউন্ডার কিংবা গ্রামীণ হাতুড়েদের ডাক্তার সাজিয়া ‘চিকিৎসা’ করার ঘটনাও ভূরি ভূরি।
প্রশ্ন হইল, এ সব কি চলিতেই থাকিবে? হাসপাতালগুলির ন্যূনতম পরিকাঠামো গড়া কিংবা চিকিৎসাপ্রার্থী রোগীদের ন্যূনতম পরিষেবা দেওয়ার বন্দোবস্তটি পশ্চিমবঙ্গে চালু হইবে কবে? এ জন্য তো প্রচুর অর্থের প্রয়োজন নাই যে তহবিলের অভাবের অজুহাত শুনাইতে হইবে। কেবল রাজ্যের স্বাস্থ্য-প্রশাসনের তরফে একটু দায়বদ্ধতা, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে একটু সদিচ্ছা, চিকিৎসাপ্রার্থী অসহায় রোগীদের প্রতি মানবিকতা ও সহানুভূতির একটু তাগিদ তাহা হইলেই অন্তত গজ-তুলা-সুচ-সিরিঞ্জের মতো প্রাথমিক ও বুনিয়াদি উপকরণগুলি মজুত রাখা যায়। এ জন্য কেবল চাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটু নড়াচড়া এবং তাহার উপর নজরদারি চালাইতে স্বাস্থ্য প্রশাসনের আমলা-অফিসারদের সচিবালয়ের বাহিরে পদার্পণ। মুখ্যমন্ত্রী (যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রকও নিজের হাতে রাখিয়াছেন) এ জন্য কর্মীদের তাড়না করিয়াছেন। তাহাতে যে যথেষ্ট ফল হয় নাই, সেটা স্পষ্ট। |