জনসাধারণকে প্রশাসনমুখী করিয়া তোলা অপেক্ষা প্রশাসনকে গণমুখী করিয়া তোলা নিঃসন্দেহে শ্রেয়। তাই রাজনীতিকরা প্রায়শ ‘গণমুখী প্রশাসন’-এর কথা বলেন, ক্ষমতায় আসিলে তেমন প্রশাসন উপহার দিবার প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু সচরাচর সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের কোনও প্রচেষ্টা ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের তরফে দেখা যায় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরেই নিজে যেমন জেলা-সফর করিয়া চলিয়াছেন, তেমনই তাঁহার বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রী এবং অফিসারদেরও সেই সব সফরে লইয়া যাইতেছেন। এই সফরগুলি প্রশাসনকে জনতার নাগালে লইয়া যাওয়ার উদ্যোগ। ইহার লক্ষ্য, জনসাধারণকে যেন তাঁহাদের অভাব-অভিযোগ বা দাবি-দাওয়া লইয়া প্রশাসনের দরজায়-দরজায় ঘুরিয়া মরিতে না হয়, যেন প্রশাসনিক আধিকারিকরাই জনসাধারণের কাছে গিয়া তাঁহাদের চাহিদা ও দাবিগুলি জানিয়া তদনুযায়ী কর্মসূচি প্রণয়ন ও রূপায়ণ করিতে পারেন।
উত্তরবঙ্গে এবং তাহারও আগে জঙ্গলমহলে প্রথম মমতা এই ভাবে তাঁহার মন্ত্রিসভার বহু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে লইয়া গিয়াছিলেন। তখনই তাঁহার স্লোগান ছিল মহাকরণকে জেলায় জেলায় লইয়া যাওয়া হইবে। উত্তরবঙ্গের জন্য মহাকরণের ধাঁচে একটি সমান্তরাল সচিবালয় গঠনের প্রক্রিয়াও তিনি শুরু করেন, যাহাতে উত্তরবঙ্গের মানুষকে উন্নয়নের জন্য কলিকাতার দিকে চাহিয়া থাকিতে না হয়। এই প্রক্রিয়ার গুণ হইল, ইহা চালু থাকিলে উন্নয়নের প্রকল্প ফাইলবন্দি রাখিবার সুযোগ মেলে না, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে, এ ক্ষেত্রে সরাসরি বিভাগীয় মন্ত্রীর কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজে প্রতিটি বিষয় তদারকি করিতেছেন। উন্নয়নের যে দায় এত কাল ছিল ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের, তাহার ভার জেলা, মহকুমা ও ব্লক স্তরের প্রশাসনিক আধিকারিক অর্থাৎ জেলাশাসক, এস ডি ও এবং বি ডি ও’দের হস্তে অন্তরিত করিয়া তিনি ফাঁকি, গাফিলতি, দুর্নীতি ও দলবাজির সুযোগও বিপুল ভাবে সঙ্কুচিত করিতে চাহিয়াছেন। তাহার ফলও ফলিতেছে। জেলাশাসক, এস ডি ও ও বি ডি ওরা দলীয় রাজনীতির হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ হইতে অব্যাহতি পাইয়া উন্নয়নের জন্য প্রকল্প রচনা করিতেছেন, বিভাগীয় মন্ত্রীদের, সর্বোপরি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর উৎসাহ পাইয়া জনতার দরবারে হাজির হইতেছেন, ফিরিয়া আসিয়া কর্মসূচি প্রণয়ন করিতেছেন, মন্ত্রী সকাশে তাহা দাখিল করিতেছেন এবং সবুজ-সঙ্কেত পাইয়া কাজে ঝাঁপাইয়া পড়িতেছেন। পশ্চিমবঙ্গের কর্মসংস্কৃতি দীর্ঘ কাল পরে আমূল পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হইতেছে।
ইতিপূর্বে এই পরিবর্তনের মৌখিক সদিচ্ছা ব্যক্ত হইতে দেখা গিয়াছে প্রয়াত জ্যোতি বসু এবং গদিচ্যুত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কণ্ঠেও। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তো ‘ডু ইট নাও’ নামে একটি স্লোগানও সূত্রবদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই তাঁহাদের দলের নেতারা প্রশাসনকে গতিশীল ও গণমুখী করার এই প্রয়াস বানচাল করিয়া দেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুবিধা হইল, দল তাঁহাকে অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীকে পরিচালনা করে না, বরং তিনি অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীই দলকে পরিচালনা করেন। তাই জেলা, মহকুমা বা ব্লক স্তরে প্রশাসনের উপর রাজনীতির ছড়ি ঘুরাইবার শঙ্কাও কমিয়াছে। এই সদর্থক উদ্যোগ ইতিমধ্যেই রাজ্যবাসীর প্রশংসা কুড়াইয়াছে। রাজ্যের প্রতিটি জেলায় মন্ত্রী, বিভাগীয় সচিবদের লইয়া জেলা হইতে ব্লক স্তর অবধি প্রশাসনের মুখোমুখি বসাইয়া দেওয়ায় রাজ্যের সমস্যা লইয়া প্রাণবন্ত মতবিনিময়, হাতে-হাতে কর্মসূচি প্রণয়ন এবং তাহা রূপায়ণের অগ্রগতি লইয়া আলোচনাও মুখ্যমন্ত্রীর সামনে হইতে পারায় অসুবিধা, সমস্যা ও জটিলতাগুলি দূর করিতে সমন্বয় সাধনের কাজটিও সুষ্ঠু ভাবে হইতে পারিবে। সব মিলাইয়া এক বিপুল সম্ভাবনার দরজা উন্মুক্ত। |