ঘুরে দাঁড়াতে এখনও সম্ভবত ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ নীতিই ভরসা সিপিএমের! তাই ফের কলকাতা যাচ্ছেন প্রকাশ কারাট।
জানুয়ারি মাসে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। আগামী বছরের পার্টি কংগ্রেসে দল যে রাজনৈতিক ‘লাইন’ গ্রহণ করবে, তা নিয়ে ওই বৈঠক থেকেই আলোচনা শুরু হওয়ার কথা। মতাদর্শগত দলিলও চূড়ান্ত রূপ নেওয়ার কথা সেখানেই। যার জন্য ১৭ থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত চার দিনের বৈঠকের দিন স্থির হয়েছে। এই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিতর্কে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যাতে যোগ দিতে পারেন, তার জন্য কলকাতাতেই কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হবে বলে ঠিক হয়েছে। দিল্লি বা অন্য কোথাও বৈঠক হলে ‘শারীরিক অসুস্থতা’র জন্য বুদ্ধবাবু যোগ দিতে পারবেন না ধরে নিয়েই এই সিদ্ধান্ত। ঠিক যে ভাবে গত অগস্ট মাসেও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক নিয়ে আসা হয়েছিল কলকাতায়।
সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, দলের মধ্যে ‘ঐক্য’ বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে ভাবে প্রয়াসী হয়েছেন, এই সিদ্ধান্ত তারই অংশ। মতাদর্শগত দলিল তৈরির ক্ষেত্রে বুদ্ধবাবুর মতামতকে যথেষ্ট ‘গুরুত্ব’ দিচ্ছে দল। গত অক্টোবরে পলিটব্যুরোয় ও সদ্যসমাপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনার মূল বিষয় ছিল, চিন প্রকৃতপক্ষে সমাজতান্ত্রিক পথে চলছে কি না। তাতে সশরীরে অংশ না-নিলেও বুদ্ধবাবুই আগে ‘নোট’ পাঠান সীতারাম ইয়েচুরির কাছে। বুদ্ধবাবুর অনেক যুক্তিই মেনে নিয়েছে পলিটব্যুরো তথা কেন্দ্রীয় কমিটি। পাশাপাশি, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি অটুট রেখেও দলের মধ্যে কী ভাবে আরও গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা যায়, তা নিয়েও বুদ্ধবাবুর মতামত অনেকাংশে মেনে নেওয়া হয়েছে বলে সিপিএম সূত্রের ইঙ্গিত।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছেন, মতাদশর্গত বিতর্কের এখনও অবসান হয়নি। গত তিন দিনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে চিনের সমাজতন্ত্রের পথে সিপিএমের হাঁটা উচিত কি না, তা নিয়ে নানা মত, পাল্টা মত উঠে এসেছে। ইয়েচুরি দলিলের যে খসড়া পেশ করেছেন, তাতে কিছু ‘আপত্তি’ জানিয়ে ‘ডিসেন্ট নোট’ দিয়েছেন ইয়েচুরিরই রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের সম্পাদক, পলিটব্যুরোর সদস্য বি ভি রাঘভুলু। তাঁর প্রস্তাব, চিন বা লাতিন আমেরিকা কোনও ‘মডেল’ই বিনা প্রশ্নে মেনে না-নিয়ে বরং বিদেশের দৃষ্টান্ত সামনে রেখে এ দেশের অভিজ্ঞতার নিরিখে নিজস্ব অবস্থান নিক সিপিএম। মত, পাল্টা মতের জেরে পার্টি কংগ্রেসে এ নিয়ে আদৌ কোনও অবস্থান নেওয়া সম্ভব হবে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। বুদ্ধবাবুকে বাদ দিয়ে এই বিতর্কের মীমাংসায় পৌঁছতে চাইছেন না কারাট। একই সঙ্গে পার্টি কংগ্রেসে যে রাজনৈতিক প্রস্তাব গৃহীত হবে, তার প্রথম খসড়া নিয়েও আলোচনা শুরু হবে। সেই খসড়া তৈরি হবে ডিসেম্বরে দিল্লিতে পলিটব্যুরো বৈঠকে। দু’টিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে কেন্দ্রীয় কমিটির পরবর্তী বৈঠকের জন্য চার দিন রাখা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে এখনও বুদ্ধবাবুকেই সামনে রেখে এগোতে চাইছেন কারাট। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের প্রচারেও বুদ্ধবাবু অংশ নেবেন। সম্মেলনের সময় জেলায় জেলায় যাবেন। ‘ব্যর্থ মুখ্যমন্ত্রী’র তকমা দিয়ে তাঁকে কোনও ভাবেই ‘কোণঠাসা’ করে রাখতে রাজি নন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
আলিমুদ্দিনের একাংশের ব্যাখ্যা, তা হলে কারাটের গায়েও ‘ব্যর্থ সম্পাদকে’র তকমা লেগে যাবে বলেই সুকৌশলে এই ‘সন্ধি’র পথে হাঁটছে এ কে জি ভবন। তাই পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে বুদ্ধবাবুর অনুপস্থিতি কারাটকে যতই ‘অস্বস্তি’তে ফেলুক, বরাবর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে ‘আড়াল’ করারই চেষ্টা করেছেন সাধারণ সম্পাদক। বুদ্ধবাবুর অনুপস্থিতি নিয়ে অন্য রাজ্যের নেতাদের প্রশ্নের মুখে কারাট জানিয়েছেন, শারীরিক অসুস্থতার জন্যই বুদ্ধবাবু আসেননি। পাল্টা ‘সৌজন্য’ দেখিয়েছেন বুদ্ধবাবুও। সদ্যসমাপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের আগে এ বার তিনি চিঠি লিখে কারাটকে অসুস্থতার জন্য বৈঠকে আসতে না-পারার কথা জানিয়েছেন।
এ কে জি ভবনের তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, কলকাতায় কেন্দ্রীয় বৈঠকের সঙ্গে অন্তর্দলীয় রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। জানুয়ারি মাসে দিল্লিতে প্রচণ্ড ঠান্ডার কথা ভেবেই কলকাতায় কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গত জানুয়ারিতেও কলকাতায় কেন্দ্রীয় কমিটি বসেছিল। কিন্তু দলীয় সূত্রের বক্তব্য, সেই বৈঠকও বুদ্ধবাবুর জন্যই কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরে বিধানসভা নির্বাচনে ফলপ্রকাশের ঠিক পরে পরেই হারের পর্যালোচনায় দিল্লিতে পলিটব্যুরো বৈঠক বসে।
দিল্লিতে আসা নিয়ে বুদ্ধবাবুর ‘অনীহা’র কথা ভেবে
জুন মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক নিয়ে যাওয়া হয় হায়দরাবাদে। সেখানেও যাননি বুদ্ধ। ফলে অগস্টে ফের কেন্দ্রীয় কমিটিকে কলকাতায় যেতে হয়। তারও পরে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আলোচনার স্বার্থে রাজ্য কমিটির
বৈঠক উপলক্ষে আলিমুদ্দিনেও গিয়েছেন কারাট। কিন্তু সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে দিল্লিতে দলের শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেননি বুদ্ধবাবু।
মহম্মদ আসতে চান না। তাই পর্বতকেই ফের মহম্মদের কাছে যেতে হচ্ছে! |