অতি আত্মবিশ্বাস রাজনীতিতে অনেক সময় বিপদের কারণ হয়। ঠিক এমনই একটা অকস্মাৎ বিপদের মুখোমুখি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী।
ক’দিন আগেই মায়াবতী ঘোষণা করেছিলেন, আগামী বছরের বিধানসভা ভোটে (মে মাসে ভোট হওয়ার কথা থাকলেও অনেকের ধারণা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই ভোট সারতে পারেন মায়াবতী) দলের ৭০ জন বিধায়ককে টিকিট দেবেন না। কারা হারতে পারেন সেই সমীক্ষা করেই এই বাতিলের তালিকা তিনি তৈরি করেছেন বলে দলীয় সূত্রে খবর। এঁদের বদলে নতুন প্রার্থী কারা হবেন, তা-ও ঘোষণা করে দেন মায়াবতী। এখন সেই ৭০ জন বিধায়ক সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেসের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন যে, মায়াবতী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হলে তাঁরা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিতে রাজি।
৪০৩ আসনের বিধানসভায় মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির বিধায়ক ২০৬ জন। এঁদের মধ্যে ৭০ জন যদি এক যোগে বিদ্রোহ করেন, তা হলে মোট বিধায়ক সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হওয়ায় দলত্যাগ বিরোধী আইন লঙ্ঘিত হবে না। উল্লেখ্য, উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদীর পার্টির বিধায়ক সংখ্যা ৯৭, বিজেপি-র ৫১, কংগ্রেসের ২২ এবং নির্দল ২৭। আগামী ২০ তারিখ বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশন শুরু হবে।
বসপা-র টিকিট না-পাওয়া বিধায়কদের প্রস্তাব পেয়ে মুলায়ম সিংহ যাদবের তরফে তাঁর পুত্র অখিলেশ এবং রাজ্য কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রমোদ তিওয়ারি তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন। দিল্লি দরবারের খবর, সরকার ফেলতে কিছু বিধায়ক টাকা-পয়সা চাইছেন। কেউ কেউ চাইছেন টিকিট। বিএসপি-এর এক শীর্ষ নেতার মন্তব্য, “সাধে কি উত্তরপ্রদেশকে উল্টা প্রদেশ বলা হয়। আর বিধায়ক থাকবেন না বুঝে ওঁদের এখন সর্বহারা দশা!” আর প্রমোদ তিওয়ারির কথায়, “কলকাতায় বিধায়ক না থাকলেও গুরুত্ব থাকে। আর কিছু না থাকুক নাগরিক সমাজ বা কফি হাউস থাকে। কিন্তু লখনউয়ে বিধায়ক পদ গেলে সবই গেল। তাই এখানকার বিধায়করা গাড়িতে লাল বোর্ডের উপরে সোনার জল দিয়ে নিজেদের নাম লিখে জানিয়ে দেন, ইয়ে বিধায়ক কী গাড়ি হ্যায়।”
সুতরাং আসরে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ৭০ ক্ষুব্ধ বিধায়ক। তাঁদের এই তৎপরতার কথা যে মায়াবতীর অজানা, এমন নয়। পাল্টা রণকৌশল তৈরি করছেন তিনিও। আজ রাহুল গাঁধী যখন জহওরলাল নেহরুর নির্বাচন কেন্দ্র ফুলপুর থেকে প্রচার অভিযান শুরু করছেন, ঠিক তখন মায়াবতী স্পিকার সুখদেও রাজভরের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন যে, বিধানসভা বসলেই উত্তরপ্রদেশকে চার ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব পেশ করতে চান তিনি। এবং সেই প্রস্তাবের উপরে ভোটাভুটি চান।
কংগ্রেস নেতারা বলছেন, অনাস্থা প্রস্তাব আসার আগেই এই বিল নিয়ে ভোটাভুটি করে মায়াবতী একেই আস্থা প্রস্তাবে পরিণত করতে চাইছেন। উত্তরপ্রদেশকে চার রাজ্যে ভাগ করার বিষয়টি এমনই যে, কোনও দলের পক্ষেই তার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা কঠিন। কারণ, রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ সেটাই চান। উত্তরপ্রদেশ থেকে আলাদা হওয়ার পরে উত্তরাখণ্ডের আর্থিক উন্নতি ঘটেছে। তারা এখন আগের থেকে অনেক বেশি রাজস্ব দেয় কেন্দ্রকে। একই ভাবে উন্নতি ঘটেছে মধ্যপ্রদেশ থেকে আলাদা হওয়া ছত্তীসগঢ়ের ক্ষেত্রে। তাই মায়াবতীর অঙ্ক হল, আগে এই বিল এনে দলীয় বিধায়কদের উপরে হুইপ জারি করা। জনগণের আবেগের কারণেই সেই হুইপ অমান্য করে বিলের বিরোধিতা করা বাতিল হওয়া বিধায়কদের পক্ষে সহজ হবে না। তা ছাড়া, অন্য দলের বিধায়কদের ভোটও যদি বিলের পক্ষে পড়ে, তা হলে সরকার যে মজবুত সেই বার্তা দিতে পারবেন তিনি। তাই মায়াবতী এখন স্পিকারকে চাপ দিচ্ছেন, যাতে ওই বিলটি আসার আগে কোনও ভাবেই অনাস্থা প্রস্তাব আনার অনুমতি তিনি না দেন। অন্য দিকে, বসপা-র ক্ষুব্ধ ৭০ বিধায়কও দুয়ারে দুয়ারে কড়া নাড়ছেন, যাতে অধিবেশন শুরু হতে না-হতেই কংগ্রেস এবং সপা অবিলম্বে অনাস্থা প্রস্তাব আনার দাবিতে বিধানসভা অচল করে দেয়।
এই সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলিতে জড়িয়ে পড়েছেন অমর সিংহও। তিনি নিজে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই বারাণসীতে পুজো দিয়ে মায়াবতীর বিরুদ্ধে প্রচারে নেমে পড়েছেন। আর লখনউয়ে তাঁর শাগরেদরা নেমে পড়েছেন সরকার ফেলার খেলায় ঘোলা জলে মাছ ধরতে।
কিন্তু প্রশ্ন হল-মুলায়ম ও রাহুল কী চাইছেন? বিক্ষুব্ধদের সাহায্য নিয়ে সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করবেন, না কি মাত্র ক’মাসের জন্য আর ওই পথে না হেঁটে ভোটের অপেক্ষা করবেন? কংগ্রেস সূত্র বলছে, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন রাহুলই। এবং বিধানসভায় চার নম্বর দল হয়ে সরকার ভাঙার খেলায় নামার বিশেষ ইচ্ছে তাঁর নেই।
রাহুল না চাইলে কী হবে, সত্তর জন ‘সর্বহারা’ বিধায়ক এখন মরিয়া। |