বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে লোকাল কমিটির সম্মেলন করার কথা বলেছিল আলিমুদ্দিন। দলের রাজ্য কমিটির বৈঠকে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু নির্দেশ দিয়েছিলেন, নিজেদের মধ্যে বিরোধ এড়াতে ভোটাভুটি না করে আলোচনার মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হোক। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে বা যাঁদের ভাবমূর্তি ভাল নয়, তাঁদের কমিটিতে না রাখার নির্দেশও দিয়েছিলেন বিমানবাবু। কিন্তু কলকাতায় লোকাল কমিটির সম্মেলন শুরু হতেই পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি ও ভোটাভুটি শুরু হয়ে গিয়েছে। কেবল তা-ই নয়, যাঁদের ভাবমূর্তি নিয়ে এলাকায় সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন রয়েছে, তাঁরাও কমিটিতে থাকছেন।
উত্তর কলকাতার সিঁথি লোকাল কমিটিতে সম্মেলন চলাকালীন হেনস্থা হতে হয়েছে রাজ্য কমিটির সদস্য রাজদেও গোয়ালাকে। গণ্ডগোল আটকাতে এসে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব। ভোট হয়েছে বাগবাজার লোকাল কমিটিতে। ভোটে হেরে বাদ পড়েছেন দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত দীপেন কর এবং তাঁর পুত্র রাজা কর। তবে সিঁথি লোকাল কমিটিতে রয়ে গিয়েছেন দমদম-কাণ্ড খ্যাত দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই বাবিন বন্দ্যোপাধ্যায়, দুলাল-ঘনিষ্ঠ কিরণশঙ্কর রায়। ঠিক তেমনই ‘সতর্ক’ করা দুই নেতা সলিল চট্টোপাধ্যায় এবং শ্যামল নন্দী যথারীতি বাগবাজার লোকাল কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে বেলেঘাটা, শ্যামপুকুর-সহ কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় লোকাল কমিটিতে ভোটাভুটি প্রায় অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচন, ২০১০-এর পুরভোট, ২০১১-য় বিধানসভা পরপর পরাজয়ের ধাক্কায় কলকাতায় সিপিএম বিপর্যস্ত। স্থানীয় স্তরে বহু কর্মীই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। তা সত্ত্বেও লোকাল কমিটি স্তরে বিরোধ যে এত প্রকট হয়ে দেখা দেবে, আলিমুদ্দিন অনুমান করতে পারেনি। সদ্য সমাপ্ত সিঁথি লোকাল কমিটির সম্মেলন প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়। গোলমাল থামাতে আলিমুদ্দিন থেকে ছুটে যান রবীনবাবু।
তিনি গিয়ে বলেন,
তাঁর পেটের সমস্যা সত্ত্বেও তিনি এসেছেন। কিন্তু তাতেও কমরেডরা তাঁকে রেয়াত করেননি। তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন করেন, দুর্নীতিগ্রস্তদের কমিটিতে রেখে দেওয়ার জন্য রবীনবাবু এলেন কেন?
কেন দুলাল-ঘনিষ্ঠদের কমিটিতে রেখে দেওয়া হবে? বিভিন্ন জায়গায় যখন একাধিক শাখা মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন কেন সিঁথি লোকাল কমিটিকে ভেঙে দু’টুকরো করে দেওয়া হবে? এ-সব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন তুলনায় স্বচ্ছ পার্টি সদস্যেরা। কিন্তু প্রশ্নকারীদের পাল্টা থামিয়ে দিয়ে রাজদেওবাবু বলেন, এ ভাবেই সম্মেলন হবে, যাঁর থাকার ইচ্ছে নেই, তিনি চলে যেতে পারেন। ক্ষুব্ধ কুমার দে যখন মঞ্চে উঠে রাজদেওবাবুকে প্রশ্ন করেন, তখন তাঁকে ধাক্কা মারা হয় বলে অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত রবীনবাবু আশ্বাস দেন, অভিযোগকারীদের বক্তব্য মেনে আগামী দু’মাসের মধ্যে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দলে ‘আমলাতন্ত্র’ ও ‘দুর্নীতি’-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ন’জন সদস্য তাঁদের নাম লোকাল কমিটি থেকে প্রত্যাহার করে নেন।
রাজ্য কমিটির নির্দেশের তোয়াক্কা না করে বাগবাজার লোকাল কমিটিতে যে অফিসিয়াল প্যানেল জমা পড়ে, তাতে দেখা যায়, দীপেনবাবু-সহ একাধিক ব্যক্তির নাম রয়েছে, যাঁদের ভাবমূর্তি নিয়ে আপত্তি রয়েছে খোদ কলকাতা জেলা কমিটির। কেন তাঁরা লোকাল কমিটিতে থাকবেন, তা নিয়ে বহু সদস্য প্রশ্নে তোলেন। বাধ্য হয়ে ভোটাভুটি করতে হয়। ভোটে দীপেনবাবুরা অবশ্য পরাজিত হন। কিন্তু পাল্টা চাল চেলে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী হারিয়ে দেয় স্বচ্ছ ভাবমূর্তির তরুণ এবং মহিলা নেত্রী সোনালি চৌধুরীকে ।
রাজ্য কমিটি নির্দেশ দিয়েছে, প্রতিটি লোকাল কমিটিতে এক জন করে মহিলা সদস্য নিতে হবে। কিন্তু যে ভাবে সম্মেলন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাতে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মহিলারা আদৌ এগিয়ে আসবেন কি না, তা নিয়ে দলের ভিতরেই সংশয় দেখা দিয়েছে। বহু সদস্য প্রশ্ন তুলছেন, বহু দিন ধরে পদ আঁকড়ে থাকা নেতারাই যদি এ বারেও লোকাল কমিটির সম্পাদক থেকে যান, তা হলে দল ‘শুদ্ধ’ হবে কী করে? নতুন রক্তই বা কী করে সঞ্চালিত হবে? যে ভাবে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত বৃদ্ধদের লোকাল কমিটির সম্পাদক হিসেবে রেখে দেওয়া হচ্ছে, তাতে সিপিএম নেতৃত্বের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। |