‘কর দাও, আমায় কর দাও’ নয়। পুর-নাগরিক বৈঠকে চার দিক থেকে থেকে আওয়াজ উঠল,‘কর নাও, আমার কর নাও।’
প্রায় ‘অভূতপূর্ব’ ঘটনাটি ঘটল সল্টলেকে। আইনি জটিলতার জেরে যে উপনগরীতে সম্পত্তি-কর আদায় বন্ধ প্রায় বছর ছয়েক। নাগরিকদের অধিকাংশের দাবি, বকেয়ার বোঝা হাল্কা করতে এবং পাশাপাশি উন্নত পরিষেবা দিতে পুর-কর্তৃপক্ষ এ বার কর নিন। অর্থাভাবে পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছে না এই ‘সাফাই’ শুনতে তাঁরা আর রাজি নন।
এরই প্রতিফলন দেখা গেল রবিবার সকালে, বিধাননগর পুরসভার দু’নম্বর ওয়ার্ড কমিটির বার্ষিক সাধারণ সভায়। ওয়ার্ডের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ আমলা থেকে শুরু করে শিক্ষক, ব্যাঙ্ক অফিসার, সরকারি ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ব্যবসায়ী--- পুর-প্রতিনিধিদের কাছে কার্যত সকলেরই আর্জি, ‘কর নিন।
আমাদের বকেয়ার বোঝা বাড়াবেন না। বিনিময়ে আরও ভাল পরিষেবা দিন।’ রাজ্যের প্রাক্তন সচিব সুজিতশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “আমি পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে বকেয়া করের বোঝা চাপিয়ে যেতে চাই না।”
কারা শুনলেন ওঁদের দাবি?
মঞ্চে তখন বিধাননগর পুরসভার চেয়ারম্যান-ইন-কাউন্সিলের সদস্য, তৃণমূলের দেবাশিস জানা। সঙ্গে বিরোধী দলনেত্রী সিপিএমের ইলা নন্দী ও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, সিপিএমের শাশ্বতী মণ্ডল। সামনে বসা বিভিন্ন বয়স ও রাজনৈতিক মতের শ’তিনেক নাগরিক। গতানুগতিক বক্তব্যের পরে যাঁদের বলার সময় আসতেই বদলে গেল সভার সুর। উন্নততর পুর-পরিষেবার দাবির সূত্রে উঠে এল সম্পত্তি-কর আদায়ে পুরসভার ‘সার্বিক ব্যর্থতা’-র প্রসঙ্গ। নাগরিকেরা কার্যত পুর-কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করলেন “কেন নিচ্ছেন না কর? এখানে থাকব, পরিষেবা নেব, আরও সুবিধা চাইব, অথচ কর দেব না? কর নিন। বদলে ভাল পরিষেবা দিন।”
বস্তুত এই মুহূর্তে সল্টলেকের রাস্তাঘাটের হাল শোচনীয়। জঞ্জাল সাফাইয়ে ঢিলেঢালা ভাব, বাজারগুলোর অবস্থা জীর্ণ। উপনগরীর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিকাশি-সমস্যাও প্রকট হচ্ছে।
নাগরিকেরা জানিয়ে দেন, তাঁরা অবিলম্বে এ সবের সুরাহা চান। এবং এ ক্ষেত্রে পুরসভার ‘আর্থিক সঙ্কটের’ দোহাই মানবেন না। বরং তাঁরা চান পুরসভার কাছ থেকে পরিষেবা ‘কিনতে।’ ইলাদেবী-দেবাশিসবাবুরা আদালতে ঝুলে থাকা মামলার কথা শোনালে নাগরিকদের পাল্টা পরামর্শ, ‘ভাল আইনজীবী ধরুন। হাত গুটিয়ে বসে না-থেকে পুরসভা সক্রিয় হোক আয়ের পথ খুলতে।’
বকেয়া করের বোঝা ক্রমশ বাড়তে থাকায় আবাসিকদের উদ্বেগের ছবিটা ধরা পড়েছে ওই সভাতেই। তাপস সেনগুপ্ত বা জয়ন্ত ঘোষের মতো অনেকেই উপস্থিত পুর-প্রতিনিধিদের বলেন তাঁদের উদ্বেগের কথা পুর-প্রধানের গোচরে আনতে। সুজিতশঙ্করবাবুর পরামর্শ: পুরসভা আদালতে গিয়ে বলুক, যারা মামলা করেছে, কোর্টের নির্দেশ যেন তাদের মধ্যেই সীমিত থাকে।
ওই ‘মামলার’ই জটিলতায় ২০০৫ থেকে সল্টলেকে সম্পত্তি-কর আদায় বন্ধ। কেন?
দেশের সমস্ত শহরে কর নির্ধারণের ভার ভ্যালুয়েশন বোর্ডের। সল্টলেকে মূল্যায়নে সমস্যা হয়নি। কিন্তু মূল্যায়নের পরে যখন দেখা গেল কর বেড়েছে, তখনই নাগরিকদের একাংশের তৈরি একটি সংগঠন মামলা করে। অভিযোগ: নাগরিকদের শুনানির সুযোগ না-দিয়ে ভ্যালুয়েশন বোর্ড একতরফা কর নির্ধারণ করেছে। কথাটা অবশ্য সত্যি। কারণ, আইনেই তেমন সুযোগ নেই।
বরং আইন বলছে, কর নির্ধারণের পরে নাগরিক পুর-প্রধানের কাছে তা কমানোর আবেদন করতে পারেন, এবং পুর-প্রধান তাঁর বিবেচনামতো ধার্য কর সর্বাধিক ২৫% পর্যন্ত কমাতে পারেন।
আদালত নির্দেশ দেয়, কর-হার চূড়ান্ত করার আগে নাগরিককে শুনানির সুযোগ দিতেই হবে। যার প্রেক্ষিতে রাজ্যের তদানীন্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের উদ্যোগে মূল্যায়ন-আইনে একটি চটজলদি সংশোধনী বিল আনা হয় বিধানসভায়। তাতে বলা হয়: চূড়ান্ত কর-হারের যে তালিকা ভ্যালুয়েশন বোর্ড তৈরি করেছিল, তাকে ‘খসড়া তালিকা’ ধরে তারই ভিত্তিতে শুনানি হবে। সল্টলেকের ‘কল্যাণকামী’ সংগঠনটি ওই ‘খসড়া তালিকা’-কে চ্যালেঞ্জ করে ফের কোর্টে যায়।
সেই মামলাই আপাতত ঝুলে রয়েছে। সেই সঙ্গে কর আদায়ও। তবে পুরনো হারে কর আদায়ে পুর-কর্তৃপক্ষের যে কোনও বাধা নেই, আদালত তা বলে দিয়েছে। অর্থাৎ, ২০০৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত কর নিতে হলে পুরনো হারেই নিতে হবে। মামলাকারী সংগঠনের দাবি, পুরসভা সে ভাবেই কর নিক।
কিন্তু পূর্বতন বামশাসিত পুরবোর্ড তাতে আগ্রহ দেখায়নি। বর্তমানের তৃণমূলশাসিত বোর্ডও নয়। পুর-প্রধান কৃষ্ণা চক্রবর্তী নিজেই অবশ্য জানাচ্ছেন, “এক দিন এক অতিবৃদ্ধ ভদ্রলোক টাকা নিয়ে আমার ঘরে হাজির! বললেন, কর নিয়ে আমাকে দায়মুক্ত করুন। শান্তিতে মরতে চাই। ওঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরত পাঠালাম।” তবু কর নিচ্ছেন না কেন?
পুর-প্রধান বলছেন, “ব্যাপারটা বিচারাধীন। আমাদের হাত-পা তো খানিকটা বাঁধা।” বরং মামলাকারীদের প্রতি তাঁর আর্জি, ‘মামলা তুলে নিন। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হোক।’ |