প্রশিক্ষণ ছিল কি না, ‘ধোঁয়াশা’
সুচপুরে বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বিস্ফোরণে প্রাণ গেল পুলিশকর্মীর
লালগড়ের ঝিটকার জঙ্গলের স্মৃতি উস্কে দিয়ে ফের বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে মৃত্যু হল এক পুলিশকর্মীর। এ বার ঘটনাস্থল, নানুরের সুচপুর। ২০০৬ সালে উপযুক্ত সতর্কতা ছাড়াই বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বিপত্তি হয়েছিল ঝিটকায়। ল্যান্ডমাইন ফেটে মারা গিয়েছিলেন দুই পুলিশকর্মী। এ দিনও প্রায় একই রকম কাণ্ড হয়েছে বলে বীরভূম জেলা পুলিশ সূত্রের খবর। তার উপরে মৃত পুলিশকর্মীর বোমা নিষ্ক্রিয় করার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছিল কি না, তা নিয়ে পুলিশ ও পরিবারের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে।
ফুট আটেক দূরত্বে পাশাপাশি ফুট দু’য়েক গভীর দু’টি গর্ত। একটিতে বোমা নিষ্ক্রিয় করার দাগ। অন্য গর্তে খড়ের উপরে তখনও রাখা রয়েছে বেশ কিছু তাজা বোমা। একটু দূরেই আমগাছের নীচে ছড়িয়ে রয়েছে চাপচাপ রক্ত। এলাকা ঘিরে রয়েছে র্যাফ ও পুলিশ বাহিনী। সোমবার বিকেল ৩টেয় নানুরের সুচপুর গ্রাম। থমথমে, কার্যত পুরুষশূন্য। মহিলারাও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। গ্রামের শিশুশিক্ষা কেন্দ্র লাগোয়া পুকুরপাড়ের দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক পুলিশকর্মী। কী হয়েছিল এ দিন?

নওনেহাল মির্জা
রবিবার সুচপুর গ্রামের একটি পুকুরপাড়ে মাটি খুঁড়ে পুলিশ ৮টি ড্রাম ভর্তি প্রায় ৭০০ বোমা এবং আরও একটি ড্রামে বোমার মশলা উদ্ধার করে। ওই সব বোমা নিষ্ক্রিয় করতে এ দিন দুপুর ২টো নাগাদ গ্রামে গিয়েছিলেন সাব ইনস্পেক্টর নওনেহাল মির্জা (৫৯) ও তাঁর দুই সঙ্গী। পুলিশ সূত্রের খবর, প্রথম দিকে দু’টি গর্তে এক সঙ্গে অনেক বোমা রেখে আগুন দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছিল। প্রচণ্ড আওয়াজে গ্রামবাসী আপত্তি জানান। তখন সুতলি খুলে বারুদ বের করে বোমা নিষ্ক্রিয় করা শুরু হয়। নওনেহাল ড্রাম থেকে নিজের হাতে এক-একটা করে বোমা তুলে সুতলি খুলছিলেন। হঠাৎ একটি বোমা তাঁর হাত ফস্কে নীচে পড়তেই বিস্ফোরণ ঘটে। রক্তাক্ত অবস্থায় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে নওনেহালকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বিস্ফোরণে পুলিশকর্মীদের হতাহত হওয়াও নতুন ঘটনা নয়। ২০০৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর লালগড়ের ঝিটকার জঙ্গলরাস্তায় প্রচারমাধ্যমকে দেখানোর জন্য বিস্ফোরক ভর্তি দুধের ক্যান ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে খোলার চেষ্টা করতেই প্রবল বিস্ফোরণে মারা যান দুই পুলিশকর্মী। কালনায় বছর তিনেক আগে ভাগীরথীর ঘাটে বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বিস্ফোরণে সিআইডি-রই বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের এক সদস্যের হাত উড়ে গিয়েছিল। দু’টি ক্ষেত্রেই উপযুক্ত পোশাক ছাড়াই বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বিপত্তি ঘটেছিল। সুচপুরের ক্ষেত্রেও বোমা নিষ্ক্রিয় করার জন্য যে যে সুরক্ষাবিধি নেওয়া দরকার, তা মৃত পুলিশকর্মীর ছিল না বলেই প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রের খবর, মৃত পুলিশকর্মীর গায়ে বোমা নিষ্ক্রিয় করার উপযুক্ত পোশাক দেখা যায়নি। বরং পরনে শার্ট-প্যান্ট ছিল, যা বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
এখানেই ঘটে বিস্ফোরণ। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।
নওনেহালের বাড়ি মুর্শিদাবাদের লালবাগ পুরসভার হইপতগঞ্জ এলাকায়। থাকতেন সিউড়িতে জেলা পুলিশ লাইনের ব্যারাকে। এ দিন বর্ধমান মেডিক্যাল চত্বরে দাঁড়িয়ে তাঁর ভাই ফুল মির্জা ও ভাইপো মেহেদি বলেন, “২০০৬-এ ওঁর হৃদরোগ ধরা পড়ে। তার পর থেকে ওঁকে হাল্কা কাজ দেওয়া হত। হঠাৎ কেন তাঁকে বোমা নিষ্ক্রিয় করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নামানো হল, বুঝতে পারছি না। তা ছাড়া, ওই সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও ওঁর ছিল না।” বীরভূম জেলা গোয়েন্দা দফতরে (ডিআইবি) কর্মরত ছিলেন নওনেহাল (পুলিশ সুপার অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি জেলা বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের ‘টিম লিডার’ ছিলেন)। নওনেহালের অধীনে কর্মরত জেলা ডিআইবি-র এক কর্মী বলেন, “রবিবার রাতেই ওঁর ফোনে জেনেছিলাম সুচপুর যেতে হবে। এর আগেও আমরা বিভিন্ন বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করার কাজ করেছি। কিন্তু এমন কাণ্ড যে ঘটতে পারে, কখনও ভাবিনি।” এ দিন বিকেলে বীরভূম জেলা পুলিশের মাধ্যমে টেলিফোনে দুঃসংবাদ পৌঁছয় মুর্শিদাবাদের লালবাগ পুরসভার হইপতগঞ্জে মৃত পুলিশকর্মীর বাড়িতে। সাত ভাইয়ের চতুর্থ ছিলেন নওনেহাল। সম্পর্কিত এক জামাতা আসিফ ইকবাল বলেন, “পরিবারের অভিভাবক ছিলেন আমার এই খুড়তুতো শ্বশুরমশাই। রবিবারই বাড়ি এসেছিলেন। জরুরি বার্তা পেয়েই সিউড়ি চলে যান।”
পুলিশ সূত্রের খবর, নওনেহাল বীরভূম জেলা গোয়েন্দা দফতরে (ডিআইবি) কর্মরত ছিলেন। দুবরাজপুর, খয়রাশোল ও রাজনগর ব্লকের দায়িত্ব ছিল তাঁর উপরে। তা হলে এমন এক জনকে বোমা নিষ্ক্রিয় করার দায়িত্ব দেওয়া হল কেন? ফোনে যোগাযোগ করা হলে এ দিন বিকেলে বীরভূমের পুলিশ সুপার নিশাত পারভেজ বলেন, “ওই পুলিশকর্মীর বোমা নিষ্ক্রিয় করার প্রশিক্ষণ ছিল। উনি জেলা বম্ব স্কোয়াডের প্রধান (টিম লিডার) ছিলেন। উনি গোয়েন্দা দফতরে কাজ করতেন তো কী হয়েছে? গোয়েন্দা দফতরে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা তো পুলিশই।” সন্ধ্যায় বর্ধমান মেডিক্যালে গিয়ে ওই পুলিশ সুপার অবশ্য বলেন, “বোমা কী করে নাড়াচড়া করতে হয় (বম্ব হ্যান্ডলিং) তা জানা থাকলেও ওই পুলিশকর্মীর বোমা নিষ্ক্রিয় করার প্রশিক্ষণ ছিল না।” তা হলে তাঁকে সুচপুরে পাঠানো হল কেন? পুলিশ সুপারের জবাব, “কেন এমন হল, তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।” ডিআইজি সিআইডি (অপারেশন) কে জয়রামন বলেন, “আমাদের বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের দল ঘটনাস্থলে গিয়েছে।”
বর্ধমান পুলিশ লাইনে মৃত পুলিশকর্মীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা মুকুল রায়ের। ছবি: উদিত সিংহ।
বীরভূম জেলায় কাজ করে যাওয়া রাজ্য পুলিশের এক কর্তা অবশ্য জানিয়েছেন, সাধারণ ভাবে এ ধরনের দেশি বোমা নিষ্ক্রিয় করতে হলে সেগুলিকে জলে চুবিয়ে রাখা নিয়ম। এতে বারুদ গলে গিয়ে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা থাকে না। যদি কোনও ভাবে বারুদ না-ও গলে, তা হলেও বিস্ফোরণের তীব্রতা কম হয়। বোমার সুতলি খুলে বা গর্তের মধ্যে রেখে বিস্ফোরণ ঘটানোর ক্ষেত্রে বিপদের ঝুঁকি থেকেই যায়। এত দিন নানুরের বোমা নিষ্ক্রিয় করার ক্ষেত্রে জলে চোবানোর চিরাচিরত পদ্ধতিই নেওয়া হয়েছে। জেলা পুলিশের এক অফিসার বলছেন, “গ্রামবাসী বিস্ফোরণের শব্দে আপত্তি জানানোর পরেও বোমা নিষ্ক্রিয় করার অন্য রাস্তা ছিল। যে ড্রামে বোমাগুলো ছিল, তাতে জল ভরে রেখে দিলেই তো নিষ্ক্রিয় হয়ে যেত! আমরা বুঝতে পারছি না, এ ক্ষেত্রে কেন অন্য পদ্ধতি নিতে হল!”
নানুরে বোমা উদ্ধার নতুন ঘটনা নয়। রাজনৈতিক হানাহানিতে নিয়মিত তেতে থাকা এই অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিধানসভা ভোটের আগে ও পরে হাজার হাজার বোমার পাশাপাশি প্রচুর বেআইনি অস্ত্র ও বোমার মশলা উদ্ধার হয়েছে। সেই সব বোমা নিষ্ক্রিয়ও করা হয়েছে। এত দিন কোনও বিপত্তি ঘটেনি।
এ দিন সন্ধ্যায় হাসপাতালে যান তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় এবং রাজ্যের তিন মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, এইচ এ সফি এবং সুব্রত সাহা। পরে বর্ধমান পুলিশ লাইনে তাঁদের উপস্থিতিতে নওনেহালকে ‘গার্ড অফ অনার’ দেওয়া হয়। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, মৃত পুলিশকর্মীর পরিবার ক্ষতিপূরণ বাবদ ১০ লক্ষ টাকা পাবে। মুকুলবাবু বলেন, “কী ভাবে এমন হল, তদন্ত করা হবে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.