প্রথাগত চাষে ঝুঁকি কম নেই। কখনও অতিফলন, কখনও সংরক্ষণ ও বিপণনের অভাব ডেকে আনে সর্বনাশ। তবু ধান, পাট, আলু চাষ আঁকড়ে আছেন অনেকেই। বিকল্প চাষ কি দেখাতে পারছে মুক্তির পথ? আজ প্রথম কিস্তি।
এক বার তুললে ডোবায় দু’বার।
প্রথাগত চাষ সম্পর্কে এমনই বক্তব্য চাষিদের।
কালনা মহকুমার পাঁচটি ব্লক মিলিয়ে জনসংখ্যা দশ লক্ষেরও বেশি। অধিকাংশ মানুষই চাষবাসের উপরে নির্ভরশীল। প্রায় ৭৭ হাজার হেক্টর জমিতে সারা বছর ধরে মূলত চারটি ফসলের চাষ হয়। সেগুলি হল ধান, আলু, পাট ও পেঁয়াজ। এর মধ্যে সব থেকে বেশি ধান চাষ হয় মন্তেশ্বরে। আলুর এলাকা হিসেবে পরিচিত কালনা ১ ও ২ ব্লক। বছরের পর বছর ধরে এই সব প্রথাগত ফসলের চাষ করলেও ইদানীং তিক্ত অভিজ্ঞতা হচ্ছে বলে অভিযোগ চাষিদের। বছর বছর চাষের খরচ বাড়লেও লাভের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে উঠছে বলে তাঁদের দাবি।
মন্তেশ্বরের ধান চাষি সামাদ শেখের আক্ষেপ, বীজ, সার, কীটনাশক-সহ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসপত্রেরই দাম বেড়েছে। অথচ সেই অনুযায়ী ফসলের দাম মিলছে না। তিনি বলেন, “বছর দশেক আগেও জমি থেকে ফসল তোলার পরে গোলায় রেখে দিতাম। বছরে যে সময়ে ভাল দাম মিলত, ফসল বিক্রি করতাম। এখন মাঝে মধ্যেই জমি থেকে ধান তোলার পরে হু হু করে দর নেমে যাচ্ছে।” তিনি জানান, চলতি বছরে মাস তিনেক আগেও লাল স্বর্ণ প্রজাতির ধানের দাম ছিল বস্তা পিছু সাড়ে ছ’শো থেকে সাতশো টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র সাড়ে চারশো টাকায়।
আলু চাষে লাভের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অনিশ্চিত বলে দাবি করেছেন কালনার চাষিরা। কালনা ১ ব্লকের বাসিন্দা অরবিন্দ সরকারের কথায়, “আলু চাষ করা আর জুয়া খেলা তো এখন প্রায় সমান। যে বছর আলুর ভাল দাম মেলে, সে বার মোটা অঙ্ক লাভ হয়। কিন্তু যে বার মেলে না, পথে বসার উপক্রম হয়।” তাঁর দাবি, এক বার ভাল দাম মিললে, চাষিদের মধ্যে বেশি জমিতে আলু চাষ করার প্রবণতা দেখা দেয়। কিন্তু ঠিক মতো দাম না মিললে সঙ্কটে পড়েন চাষিরা। নান্দাই পঞ্চায়েতের প্রধান তথা আলু ব্যবসায়ী ঈদের আলি মোল্লার কথায়, ‘‘গত মরসুমে যখন হিমঘরে আলু রাখা হয়, তখনই বস্তা পিছু দর ছিল ২২০ টাকা। কমতে কমতে এখন তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯০ টাকায়। এর ফলে আলু চাষ ও ব্যবসায় যুক্ত থাকা কয়েক হাজার মানুষ বিপাকে পড়েছেন।”
এমন অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও আলু চাষে এত উৎসাহ কেন, সে প্রশ্নের জবাবে ওই পঞ্চায়েত প্রধানও অনেকটা একই রকম কথা বলেন। তিনি জানান, এক বার ভাল দাম মিললে বিপুল উৎসাহে চাষি ও ব্যবসায়ীরা হিমঘরে আলু রেখে পরের বারও লাভের আশায় থাকেন। কিন্তু দাম পড়ে গেলে বেশি বিপাকে পড়েন প্রান্তিক চাষিরা। কারণ তখন সার, কীটনাশক, বীজ-সহ চাষের নানা খরচ জোগাড় করতে প্রান্তিক চাষিরা মহাজনদের দ্বারস্থ হন। আলু চাষি জীবন বিশ্বাস জানান, চড়া সুদে ঋণ নেওয়ার পরেও আলুর ভাল দাম না মিললে সমস্যায় পড়তে হয়।
কালনা ও পূর্বস্থলীর চারটি এলাকায় রবি মরসুমে সুখসাগর প্রজাতির পেঁয়াজের চাষ হয়। তবে মহকুমায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য হিমঘর না থাকায় দাম যাই হোক না কেন, ফসল তোলার পরে অপেক্ষার কোনও সুযোগ নেই। জমি থেকে পেঁয়াজ তোলার পরেই বিক্রি করে দিতে হয়। পেঁয়াজ চাষি হানিফ শেখ জানান, বহু সময়ে চড়া দামে বীজ, সার কিনে লোকসানেই ফসল বিক্রি করতে হয়। পাট চাষের ক্ষেত্রেও চিত্রটা কম-বেশি একই রকমের। প্রথাগত এই চাষাবাদে লাভের অনিশ্চয়তার কথা স্বীকার করেছে কৃষি ধফতরও। মহকুমা কৃষি আধিকারিক স্বপনকুমার মারিক বলেন, “নিশ্চয়তা নেই ঠিকই। এত সব সমস্যা সত্ত্বেও চাষিরা চাষ করছেন।” লাভের নিশ্চয়তা না থাকা সত্ত্বেও ফলনের পরিমাণ বেড়েছে বলে জানান তিনি। কালনা ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শান্ত চালের অবশ্য দাবি, প্রথাগত চাষের এই অনিশ্চয়তা থেকে চাষিরা কী ভাবে মুক্তি পাবেন, সে ব্যাপারে তাঁদের উপযুক্ত পরামর্শ দেওয়া উচিত কৃষি দফতরেরই। |