কখনও গোটা বাড়ি সেঁধিয়ে গিয়েছে পাতালে। কখনও সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে স্কুল। এ বার পুনর্বাসন দাবি করছেন এ রকমই ‘ধসপ্রবণ’ বাসিন্দারা।
জামুড়িয়ার বেলা গ্রাম ও আশপাশের বাসিন্দাদের এখনও চোখে ভাসে একের পর এক ধসের ছবি। গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় বাড়ি ছিল রাম গোপের। আশির দশকের মাঝামাঝি মরাই, গরু-সহ সমস্ত সম্পত্তি নিয়ে সেই বাড়ি ভূগর্ভে হারিয়ে যায়। রামবাবুর কথায়, “সকাল ১০টা নাগাদ হঠাৎই পায়ের তলার মাটি বসতে শুরু করে। বউ আর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই চোখের সামনে গরু-খামার সব কিছু নিয়ে পুরো বাড়িটাই অতলে তলিয়ে গেল।” সেখান থেকে কিছুটা দূরে তাঁদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে ইসিএল। কিন্তু রামবাবুর আশঙ্কা, “যে-কোনও সময়েই ফের বাড়ি ধসে পরিবারসুদ্ধ ভূগর্ভে ঢুকে যেতে পারি।”
বস্তুত, স্থানীয় বাবাজিতলা, বর্ডারপাড়া, গুরুজি কোলিয়ারি প্রভৃতি এলাকায় একের পর এক ধস জনজীবন তছনছ করে দিয়েছে। রামবাবুর বাড়ি ভূগর্ভে ঢুকে যাওয়ার আগেই পাশের বাগদিপাড়ার শল্লাপুকুরে ধস নেমে ফসল ও বহু জিনিসপত্র সমেত গোটা একটি বসতবাড়ি ঢুকে গিয়েছিল মাটিতে। কিছু দিন পরেই আবার উচ্চ বিদ্যালয়ের কাছে রোহিণীপুকুরে একই রকম ঘটনা ঘটে। দু’টি পুকুরে ধস নামার পরে জমি ভরাট করা হলেও তাতে আর জল নেই। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, আশির দশকে প্রথম গুরুজি কোলিয়ারি (কোম্পানি আমলে সেখান থেকে কয়লা কাটা হয়েছে) এলাকার উপরের দিকে প্রথম ধস দেখা যায়। মাটির ভিতরে আগুন জ্বলতে শুরু করে। তার পর থেকে একের পর এক ধসের ঘটনা ঘটেছে। |
বাবাজিতলার পাশে তিন বার ধস নেমে রাস্তা বসে গিয়েছে। কোলিয়ারি সংলগ্ন বর্ডারপাড়ায় ফাঁকা মাঠে তৈরি হয়েছিল বিরাট গর্ত। গুরুজি কোলিয়ারি এলাকায় মাঝে-মধ্যেই ভূগর্ভ থেকে শব্দ বেরোচ্ছে। ইসিএলের সীতারামপুর কোলিয়ারি সেকশনের কর্মী তথা গ্রামের বাসিন্দা অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, গ্রামের চারপাশে খনি। পূর্ব দিকে ৪ নম্বর এবং দক্ষিণে ২ ও ৩ নম্বর পিটের কাজ চলছে। ২ নম্বর খনি ভূগর্ভে কয়লা কাটতে কাটতে প্রায়ই বসে গিয়েছে গ্রামের জমি। উত্তর ও পশ্চিমে জাতীয় সড়কের আশপাশে আগেই কয়লা কেটে ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে ভূগর্ভ। শেষ ধস অবশ্য নেমেছে বছর তিনেক আগে। স্থানীয় শালডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয় শুরু হওয়ার আগেই ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়।
১৯৯৪ সালের ২০ জানুয়ারি দুপুর সওয়া ২টো নাগাদ এই এলাকাতেই একটি খনির ৪ নম্বর পিটে মিথেন বিস্ফোরণে ৫৫ জন কর্মী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। তার পর ভূগর্ভ ‘সিল’ করা হলেও চাপা পড়া সেই আগুন নিভেছে কি না, তা না নিভে থাকলে কোথায় ছড়াচ্ছে, সে ব্যপারে কারওরই কোনও ধারণা নেই। ইসিএলের সীতারামপুর কোলিয়ারি সেকশনের কর্মী তথা গ্রামের বাসিন্দা অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওই ঘটনার পরেই ডিজিএমএম-এর নির্দেশে বিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দা গ্রামের বাসিন্দাদের জানানো হয়েছিল, এলাকাটি বিপজ্জনক। এখানে কোনও নতুন নির্মাণকাজ বাঞ্ছনীয় নয়। অনুপবাবু জানান, এর পরে ১৩৯টি এলাকাকে ‘বিপজ্জনক’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে ইসিএল। পুনর্বাসন প্রকল্পেও অর্থ অনুমোদন করা হয়েছে। যদিও এখনও তেমন কোনও কাজ হয়নি।
এই পরিস্থিতিতেই মাসখানেক আগে ‘কেন্দা বাঁচাও কমিটি’ গড়ে পুনর্বাসনের দাবি তুলেছেন গ্রামবাসী। স্থানীয় বাসিন্দা তথা তৃণমূল নেতা প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, পুনর্বাসনের যে ‘প্যাকেজ’ আছে, তা যথেষ্ট নয়। সেখানে পুকুর, ধানজমি, বাগান এবং স্থাবর সম্পত্তির ক্ষতিপূরণের উল্লেখ নেই। বাজারদর, জমির বিনিময়ে চাকরি এবং ৫ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে পুনর্বাসনের দাবিতে তাঁরা জোটবদ্ধ হয়েছেন। আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান, কয়লা মন্ত্রক এবং কেন্দ্রীয় কয়লা ও ইস্পাত বিষয়ক স্থায়ী কমিটির কাছে চিঠি পাঠিয়ে সমস্ত দাবিদাওয়ার কথা জানানো হয়েছে। এডিডিএ-র চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কেন্দার বাসিন্দারা যে দাবিগুলি করেছেন তার সব ক’টি পুনর্বাসনের প্যাকেজের মধ্যে পড়ে না।” তবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে বলে তাপসবাবু ও ইসিএলের সিএমডি-র কারিগরি সচিব নিলাদ্রি রায় জানিয়েছেন। |